মুসলিম সমাজের ‘পসমন্দা’ অংশের কাছে বিজেপিকে পৌঁছানোর বিশেষ নিশানা বানাতে বলেছেন নরেন্দ্র মোদী। ‘পসমন্দা’ অর্থে, যারা সামাজিক দিক থেকে ওবিসি (আজলাফ) ও দলিত (আরজাল) এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে গরিব শ্রেণীর। এরাই এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যাগুরু অংশ, দেশের ২০ কোটি মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৮৫-৮৬ শতাংশ। আর, মোট লোকসভা আসনের পাঁচভাগের একভাগ রয়েছে যে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে, ওই দুই রাজ্যে পসমন্দা জনতার বসবাস সবথেকে বেশী।
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক মুসলিম ভোট প্রচন্ড বিক্ষুব্ধ অবস্থান থেকে বিজেপি-বিমুখ হতে পারে। তাছাড়া, সংখ্যালঘু অপর দুই অংশ — খ্রিষ্টান ও শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে, এমনকি সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও নানা ক্ষোভের কারণে বিজেপিকে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হতে পারে। মোদী সেই সম্ভাবনা আঁচ করে, সেই সেই অংশের ভিতর থেকে তা সামাল দেওয়ার প্রয়াস রাখার পাশাপাশি মুসলিম সমাজের 'পসমন্দা' অংশ থেকে ভোট আত্মসাৎ করার নয়া কৌশল নেওয়া দরকার মনে করছেন। এটা তাঁদের কাছে বিশেষ বাধ্যবাধকতা হয়ে পড়েছে। তাই যে ইসলাম ও মুসলিম সম্প্রদায়ের অস্তিত্বকে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক প্রধান শত্রু বানিয়ে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্বের এতো আগ্রাসন, বাড়-বৃদ্ধি, আাধিপত্য বিস্তার, কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে শাসনক্ষমতা কায়েমের রমরমা; তা সত্ত্বেও গৈরিক সাম্প্রদায়িক শক্তি ’২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্রে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে বিশেষ নজর দিতে চাইছে একান্তই প্রয়োজনীয় মুসলিম ভোটে। এই লক্ষ্যে পসমন্দা অংশের কাছে কেন্দ্রীয় সরকারের কল্যাণকর প্রকল্প-সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার প্রচার নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হয়েছে। তার পরিকল্পনাও করা হয়ে গেছে। বিজেপির গতবছর জুলাইয়ে হায়দ্রাবাদে ও এবছর জানুয়ারিতে দিল্লীতে হওয়া পরপর দুটি জাতীয় কার্যনির্বাহী বৈঠকে সংশ্লিষ্ট পলিসি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ২০০টি জেলার ২২,০০০ গ্রামকে চিহ্নিত করে লক্ষ্যমাত্রায় রাখা হয়েছে। তার জন্য দলের নেতা-কর্মী, প্রচারক-সংগঠকদের নেমে পড়ার নির্দেশ জারী হয়েছে। এই কর্মসূচীর মানচিত্রে পশ্চিমবাংলার বেশ কিছু মুসলিম জনঅধ্যুষিত জেলা ধরা হয়েছে। যেসব রাজ্যে এবছর বিধানসভা নির্বাচন ও তার নিচের স্তরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন রয়েছে, যেমন এরাজ্যে আর ক'মাস পরে অনুষ্ঠিত হবে পঞ্চায়েত নির্বাচন; এইসমস্ত নির্বাচনে বিজেপি উপরোক্ত প্রচারকৌশলের প্রাথমিক মহড়া দিতে ও তার ফলাফল বুঝে নিতে চাইবে। মোদী এই নতুন কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোড়ন তোলার পয়লা নম্বর দায়িত্বে রেখেছেন নিজেকে। মোদীর জুড়ি হিসাবে থাকছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাছাড়া, তৃণমূলস্তরে আরএসএস-এর জালবিস্তারের দৌলতে মিলবে বিস্তর সাহায্য-সহযোগিতা। ইতিমধ্যেই ওপর থেকে তার সংকেত দিতে শুরু করেছেন খোদ আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের জাতীয় স্তরের মৌলানাদের একাংশের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন। এদেশে বসবাসের ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় না থাকার তথাকথিত আশ্বাস দিয়েছেন। এর উদ্দেশ্যই হল, বিজেপির পসমন্দামুখী অভিযানের জন্য আবহ তৈরি করা। মোদী প্রথমত, মুসলিম ভোট বিভাজনের লক্ষ্যে কলকাঠি নেড়ে চলার পক্ষে; দ্বিতীয়ত, তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ ব্যাপক মুসলিম ভোট পাওয়ার প্রতি, তা সম্ভব না হলেও তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় সংখ্যালঘু ভোট পেতে মুখিয়ে, আর সেটাই পসমন্দা অংশের ভোটের খোঁজে তাঁকে আরও মরীয়া করে তুলছে। ভাগবত ও মোদীর বার্তার লক্ষ্য অভিন্ন — তারা চাইছেন গোটা আরএসএস-বিজেপিকে তাতাতে — প্রকল্পগুচ্ছের চাল দিয়ে পসমন্দা ভোট হাতাতে। এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে মোদী স্বাধীনতা পাওয়ার পরবর্তী ভারত-ইতিহাসের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। মন্তব্য করেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার এতো বছর বাদেও এহেন অংশের জনগণ গরিব ও পশ্চাদপদ থেকে গেছেন। সত্যিই তো তাই, এই শোচনীয় নির্মম বাস্তবতা শাসকশ্রেণীর কোনও ক্ষমতাসীন অংশই অস্বীকার করতে পারেনি, পারবে না। বিজেপি আমলের পক্ষেও এই প্রশ্নে সফলতা দাবি করা সম্ভব নয়। বরং, কেন্দ্রের দুদফা মোদী আমলে, রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি শাসনে ঐ গরিব-পশ্চাদপদরা সে তিমিরেই রয়ে গেছে। উপরন্তু সংবিধান প্রদত্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার, সামাজিক সম্মান, মর্যাদা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিকাশের দাবিতে আম জনতা নাছোড় হলে বেড়েছে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন, পসমন্দারাও তার নানাভাবে শিকার হয়েছেন। এটা সাধারণভাবে সম্প্রদায় নির্বিশেষে অতি নির্মম সত্য, বিশেষভাবে মুসলিমদের ক্ষেত্রে আরও নিষ্ঠুর সত্য। এখন মোদী আশ্রয় নিচ্ছেন নতুন নতুন বাহানার। বলছেন, তাঁদের সরকার এই ‘জনকল্যাণ প্রকল্প’ উৎসর্গ করছে ‘স্বাধীনতা ৭৫’ উদযাপনের ‘অমৃতকালে’। বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এর রূপায়ণে আন্তরিক হবে, কোনও কার্পণ্য করবে না, দুর্নীতি করবে না, বৈষম্য চালাবে না! বলছেন, পসমন্দা বর্গের জন্য বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ‘সংরক্ষণের’ ব্যবস্থা করা হবে। মজার কথা হল, এটা পরের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগের বছর, তাই এবছর এখন থেকেই মোদী চাইছেন নতুন করে তাঁদের সরকারের ‘জনদরদী সংস্কারকের’ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে।
কিন্তু যথেচ্ছ অবহেলা ও পীড়ন চালিয়ে আসার দুর্বিষহ পরিণাম মোদী-শাহরা ভোলাবেন ক করে? মানুষ তো দেখেছে বিজেপি জমানায় রাষ্ট্রীয় মদতে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা ও সামাজিক উৎপীড়ন চালানোর ‘গুজরাট মডেল’, ঘৃণা-বিদ্বেষ-বিভাজন-বুলডোজার রাজের ‘উত্তরপ্রদেশ মডেল’, এনআরসি’র জাঁতাকলে বন্দীশিবিরে অন্তরীণ করে রাখার ‘আসাম মডেল’ ইত্যাদি ইত্যাদি! আর, ক্রমাগত গণতন্ত্র ধংস করা, সংবিধান অমান্য করার তান্ডবলীলা! এইসমস্ত অন্যায়-অত্যাচার বিশেষত সংখ্যালঘু মুসলিম জীবনে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে অপরাধী সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ-প্রশাসন, শাসকদল ও সঙ্ঘী খুনে-গুন্ডা-স্যাঙাত-দাগীদের আঁতাত ক্ষমতার সন্ত্রাস চালিয়ে আসছে, আর সেসব নিয়ে উৎকট উল্লাস উপভোগ করে আসছে। সর্বস্তরে আদালতে বিচারের নামে চলছে প্রহসন। অপরাধীরা পায় ‘বেকসুর’ খালাস, ‘বীরের’ সম্বর্ধনা! বিপরীতে, বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে। হিন্দুত্ববাদী হিংসার বিরুদ্ধে ন্যায়ের সপক্ষে সওয়ালকারীদের নিরন্তর ভোগ করতে হয় হেনস্থা, নির্যাতন।
মোদী বলেছেন, উন্নয়নের জন্য চারই সদিচ্ছা এবং অর্থবরাদ্দ। মোদীর মুখে পসমন্দাদের প্রতি ‘সদিচ্ছা’ দাবি করা আসলে ভূয়ো উপলক্ষ মাত্র। এর সাথে বিচার করার থাকে বাজেটে সংখ্যালঘু খাতে আর্থিক বরাদ্দের বিষয়। নির্মম প্রহসনের মতোই চলতি কেন্দ্রীয় বাজেটে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ৩৮ শতাংশ। মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ কমেছে বিপুল। বিগত আর্থিক বছরে সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রক খাতে বরাদ্দ ছিল ৫০২০.৫০ কোটি টাকা। এবারের বরাদ্দের অঙ্ক ৩০৯৭.৬০ কোটি টাকা। মাদ্রাসা শিক্ষায় গতবার বরাদ্দ হয়েছিল ১৬০ কোটি টাকা, এবার বরাদ্দ হয়েছে ১০ কোটি টাকা মাত্র। বরাদ্দ কমানোর বিষয়ে দেখানো হয়েছে অতি চেনা অজুহাত, গতবারের খরচ না হওয়া উদ্বৃত্তের সাথে সাজুয্য রেখে এবারের বরাদ্দ মঞ্জুর হয়েছে! হিসাব মেলানো দূর অস্ত্, তবু তিনি মেলাবেন দাবি করবেন! তিনি অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী। কিভাবে মেলাবেন? তিনি যে সংসদে কোনও হিসাব কোনও কৈফিয়ৎ দিতে রাজি হন না।
সব মনে রাখতে হবে।
পসমন্দাদের কাছে এইসব পাল্টা প্রচার নিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে।
- অনিমেষ চক্রবর্তী