একজন ব্যক্তি তাঁর কাজের মধ্যে দিয়ে নিজেই হয়ে উঠছেন এক প্রতিষ্ঠান – এমন খুব বেশি দেখা যায় না। আমাদের সৌভাগ্য আমাদের মধ্যে ছিলেন এরকমই একজন – সন্দীপ দত্ত।
সন্দীপ দত্তকে বাংলার সাংস্কৃতিক মহল একডাকে চেনে যে প্রতিষ্ঠানটির জন্য সেটা হল লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী। লিটল ম্যাগাজিন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলা সংস্কৃতির এক অনন্য ও বিশিষ্ট সম্পদ। কিন্তু দীর্ঘদিন অবধি তা ছিল ক্ষণিক আলো ছড়িয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার এক আবেগদীপ্ত প্রয়াস। এই হারিয়ে যাওয়া আটকাতে যিনি এক প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিলেন তিনিই সন্দীপ দত্ত।
কীভাবে লিটল ম্যাগাজিনের সংরক্ষণ ও চর্চার অসামান্য প্রতিষ্ঠান লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী গড়ে উঠেছিল সে কাহিনী আমরা অনেকেই সন্দীপদার মুখে স্বকর্ণে শুনেছি। একদিন ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে গিয়ে তিনি দেখেন অনেক লিটল ম্যাগাজিন, যা লাইব্রেরীতে দান হিসেবে এসেছিল, তা স্থান সঙ্কুলানের জন্য ফেলে দেওয়া হচ্ছে। লিটল ম্যাগাজিনকে স্থান দিতে গেলে মহার্ঘ পুস্তকাবলীর নাকি জায়গা জুটবে না। সন্দীপ দত্ত সেই বইগুলি চেয়েচিন্তে নিয়ে এসে শুরু করলেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী তৈরির কাজ।
এমন নানা কাজ আমরা অনেকেই শুরু করি উৎসাহ নিয়ে। তারপর সেই কাজ থেমে যায়। আমরা আবার অন্য কাজে নেমে পড়ি। ফেলে আসা কাজটির খোঁজও রাখি না। সন্দীপ দত্ত এই নিরিখে ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি কাজটি শুরু করলেন এবং তারপর দশকের পর দশক ধরে সেই কাজটি নিয়ে লেগে রইলেন। ছোট্ট চারা থেকে ক্রমশ মহীরূহ হল লিটল ম্যগাজিন লাইব্রেরী।
শুধু লিটল ম্যাগাজিনের সংগ্রহশালা গড়ে তোলা নয়। একে কীভাবে পাঠকের জন্য, গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায় সেই নিয়েও তিনি নিরন্তর কাজ করে গিয়েছেন। সীমিত সাধ্য নিয়েই এই বিরাট লাইব্রেরীর ডিজিটাইজেশনের কাজ একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কতটা সাহায্যই বা এই কাজে তিনি সরকার, বিখ্যাত সব প্রতিষ্ঠান বা গ্রন্থাগারগুলির থেকে পেয়েছেন! দু-চারজন সাথীকে নিয়ে প্রায় একক সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে তাঁকে।
সন্দীপদাকে সবাই জানেন একজন সংগ্রাহক হিসেবে। তুলনায় কম জানা তাঁর লেখক ও গবেষক সত্তাটি। বিভিন্ন ব্যক্তি বা বিষয়ের ওপর যখন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে পত্রিকা বা প্রতিষ্ঠান, সেখানে প্রায়শই স্থান পেয়েছে সন্দীপ দত্তের প্রবন্ধ। সন্দীপদা মূলত লিখতেন সেই ব্যক্তি বা বিষয়ের ওপর কোন লিটল ম্যাগাজিনে কে কী লিখেছেন তার এক ইতিবৃত্ত। এই কাজটি কতখানি পড়াশুনো থাকলে করা সম্ভব – তা অভিজ্ঞ যে কোনও ব্যক্তিই জানেন।
যাঁরা ১৮ নম্বর টোমার লেন, কলেজ স্ট্রিটের গা-ঘেঁষা এই ঠিকানায় গেছেন, তারাই জানেন লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরীর সংগ্রহ কী বিশাল। নিজের বাড়ির একটি বিরাট অংশই এই লাইব্রেরীর জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, যার বার্ষিক ভাড়াই ঐ অঞ্চলে হত বেশ কয়েক লক্ষ টাকা। সন্দীপদা অবশ্য একে আর্থিক কৃচ্ছসাধন হিসেবে কোনওদিন ভাবেননি। বাংলা ভাষা সাহিত্য পড়াতেন সিটি স্কুলে। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার টানেই নিজের সবটুকু তিনি উজাড় করে দিয়েছিলেন এই লাইব্রেরীর জন্য।
সন্দীপদার কী কোনও আক্ষেপ ছিল না? ছিল। কিন্তু সে আর্থিক নয়। একটা দুর্ভাবনা তাঁকে কুড়ে কুঁড়ে খেত। অনেকবার মুখোমুখি আলাপে তিনি দুর্ভাবনা ব্যক্ত করে বলেছেন – তিনি চলে গেলে এই লাইব্রেরীর কী হবে? এত অমূল্য সম্পদ কী এমন যত্নে রক্ষিত হবে? এই বিরাট সম্পদ ডিজিটাইজেশন ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় কী সঠিকভাবে পাঠক গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত হবে? ছড়িয়ে পড়বে?
আজ সন্দীপদার প্রয়াণের পর এই প্রশ্নটা আমাদের সকলেরই। বাংলা সংস্কৃতির কাছে একটা সামগ্রিক চ্যালেঞ্জও এটা। এই চ্যালেঞ্জটা নেওয়া ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা সম্পন্ন করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। এই কাজটা করতে পারলে সেটাই হবে এই আশ্চর্য মানুষটির প্রতি আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য।
- সৌভিক ঘোষাল