ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস প্রবল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে পাঁচ দিন ধরে চলার পর শেষ হল পাটনা শহরে। আমি প্রথম দুদিন আমন্ত্রিত ছিলাম খোলা অধিবেশনে। আমার যাতায়াতের টিকিটও কেটে দিয়েছিল ছাত্রফ্রন্টের আইসার ছেলেমেয়েরা, যারা আমাকে দেশব্রতী এবং লিবারেশন দেন বাড়িতে পৌঁছে। মূল গল্পটা সেখানে নয়। কেন জীবনের সায়াহ্নে এসে আমি প্রাক্তন জীবনে কোনো পার্টির একটা কংগ্রেসেও হাজির না থেকে শেষমেশ এই কংগ্রেসে যেতে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম? এর পেছনে যে দু-তিনটে প্রধান কারণ কাজ করছিল তা হল, ভয় এবং মিথ্যার জঘন্য শাসনের অবসান হোক এবং জনগণের স্তরে এক ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য যেন গড়ে ওঠে যাতে প্রজাতন্ত্রের শর্ত এবং ঘোষণা অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়ে সমতা, স্বাধীনতা ও সংহতির ভেতর দিয়ে আমরা খুঁজে পাই। যা পার্টি দলিলগুলি পাঠ করে আমি বুঝতে পেরেছি ঘৃণা ও ভয়কে প্রত্যাখ্যানের শব্দে। দ্বিতীয়টি হল বর্জিত রাজনীতির বদলে অন্তর্ভুক্ত রাজনীতির অনুশীলন। মুসলিম ও দলিত রাজনীতির অন্তর্ভুক্তি আম্বেদকর চর্চার মাধ্যমে। লিবারেশনে পেয়েছি দুটি বিপরীত গতিপথের ইতিহাস চর্চা। আম্বেদকর এবং আরএসএস। আম্বেদকরের ধম্মচক্র প্রবর্তন নিঃসন্দেহে ছিল মুক্তি, সমতা এবং সংহতির দ্যোতক, যার প্রতিফলন গত বছর দেখলাম ২২টি শপথ দিল্লিতে হাজার কণ্ঠে উচ্চারণের ভেতর দিয়ে। অন্যদিকে, আরএসএস-এর সামরিক এবং পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি হল ঘৃণা, হিংসা এবং নিপীড়ন।
এই দুটো বিষয় ছাড়াও একটি তৃতীয় কারণও কাজ করেছিল পাটনা কংগ্রেসে আসার। তা ছিল যৌথ কর্মসূচিতে আমার অংশগ্রহণ। ২০২১-এর পশ্চিমবাংলা নির্বাচনে আমরা একটি স্লোগান নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেই। নো ভোট টু বিজেপি। সেই সময়টাও আমাকে তৈরি করে লিবারেশনের কাছে আসতে। অতি সম্প্রতি মেধা পাটকরের আহবানে “ঘৃণা বিদ্বেষ ছাড়ো এবং সংবিধান বাঁচাও” যাত্রা মিছিলেও আর একবার কাছে আসার সুযোগ পাই। এ ছাড়াও অতীতে মব লিঞ্চিংএর সময় প্রতিটি জঘন্য হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে আহুত লিবারেশনের মিছিলে একসাথে হাত এবং আওয়াজ তোলার সুযোগ ঘটে। প্রিয় লেখক অরুন্ধতী রায়ও পার্টি কংগ্রেসে এসে শুধু সাফল্য কামনা করেছেন তাই নয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে লিবারেশনের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জনপ্রিয় ভাষায় বলেছেন, চার জন লোক ভারত চালাচ্ছেন। দুজন বিক্রি করছেন আর দুজন কিনছেন। রেল, এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে কি নয়, খনি থেকে বন্দর পর্যন্ত। লিবারেশন জাতভেদ বিনাশের সংগ্রাম এবং শ্রেণী – উভয় সংগ্রাম একপেশে না হয়ে একই সাথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। এসব বলেন তিনি। আমার আশাবাদ তাঁরই সঙ্গে এক সুরে বাঁধা হয়ে গেল।
এবার আসি বিনোদ মিশ্র নগর (পাটনা) আসার ইতিবৃত্ত নিয়ে। কেমনভাবে যৌথ ভ্রমণ হয়। যার মধ্যে চিরপুরাতন সুর মিশে রয়েছে। ছোট বয়েস থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির আবহাওয়ায় পালিত হবার জন্য যৌথ জীবনের প্রতি এক প্রবল ও তীব্র আকর্ষণ ছিল বরাবর। মনে আছে স্ট্যান স্বামী যখন মিথ্যে মামলায় গ্রেফতার হয়ে তালোজা জেলে বন্দী হয়েছিলেন তখন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তা নিয়ে কভার করেছিল, তালোজা জেল ইজ ব্রিমিং উইথ হিউমানিটি। মানবতা ভাসিয়ে দিয়েছে তালোজা জেলকে। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি জনশতাব্দী এক্সপ্রেস যেন ভালবাসার বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। দরদী নীতু, দেশোয়ালি বাবুন, নাটুকে শেখর, মরমী বাবুনের দাদা বউদি, আইসার স্বর্নেন্দু, অনন্যা, রণজয়, পরে সায়ন, শীলা, প্রাচীন ইন্দ্রানী এমনকি দীর্ঘ দিন পরে দেখা কমরেড বরেনের মেয়ে অবন্তী, অত্যন্ত সিরিয়াস অতনু, দিবাকর, সিনিয়ার চৌধুরিদা, কে নয়? প্রত্যেকে পরস্পরের দিকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিচ্ছে। সে রুটি-সব্জির গ্রাস বা জলের বোতল যাই হোক না কেন। শোয়ার জায়গা ঠিক করে দেয়া, টুথ ব্রাশে একটুকু পেস্ট এগিয়ে দেয়া সবগুলি সহমর্মিতার অমুল্য নিদর্শন। আসার দিন সকালে ট্রেন, ঘুম থেকে জাগিয়ে দেওয়া। অবন্তী পরে মন ছোঁয়া লেখা লিখেছে। সেই ছোট্ট মেয়েটা। সে লিখেছিল, এই যাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভালবাসার ও খুব নিজের। তার বাবার রাজনৈতিক বন্ধু, সহকর্মী বা কমরেড তাকে মনে রেখে দিয়েছেন। এই সব কাকু জেঠু, পিসি সবার মধ্যেই সে তার বাবাকে দেখছে। তাই পাটনার মতো অচেনা এক শহরে অনায়াসে সে ঘোরাফেরা করেছে। কত কি জানার, কত কি শেখার, কত মানুষ চেনার মাধ্যমে সে তার বাবাকে অনুভব করেছে।
সংক্ষেপে পার্টি কংগ্রেস থেকে পাওয়া শিক্ষার সার আলোচনা এই রকম –
১) ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের সমস্ত সদর্থক পদক্ষেপ পার্টি নেতৃত্ব নিয়েছেন। যার প্রমাণ হল কংগ্রেস ও বাম সহ সমস্ত সংসদীয় বিরোধী নেতাদের সক্রিয় ভুমিকা। পাটনা কংগ্রেস-এর পর সমস্ত নির্বাচনের ফল থেকে কিছুটা ইতিবাচক দিক উঠে এসেছে।
২) গান্ধী ময়দানে প্রকাশ্য সমাবেশে লাখ দেড়েক লোক হয়েছিল। কমরেডরা বললেন এটা নাকি স্বাভাবিক জমায়েত। যত কর্মী ছিলেন তাঁদের শৃঙ্খলা প্রশংসনীয়। কোথাও কোনো অসহিষ্ণুতা না থাকা প্রশংসার যোগ্য। জন আন্দোলন এবং প্রতিরোধ একসাথে চলে।
৩) বিহারে স্বাভাবিকভাবেই পার্টির শ্রেণী ভিত্তি এবং বর্ণ ভিত্তি এক। পশ্চিম বাংলায়ও এইদিকটা দেখার অবকাশ আছে। দিকে দিকে দেশব্রতী ও লিবারেশন পাঠচক্র গড়ে উঠতে পারে। নতুন সদস্যদের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ঘাটতি দূর করার ব্যাপারে সহায়ক। কংগ্রেস আশাতিরিক্ত প্রাপ্তি দিয়েছে। দায়িত্ব একসাথে।
– অসিত রায়