আমন ধান ও আলু, পেঁয়াজ উৎপাদনকরার পরও তার উপযুক্ত মূল্য মিলছে না। ঋণ করে চাষাবাদ করার পর ঋণ শোধ করতে মরিয়া কৃষকরা সহায়ক মূল্য না পেয়ে তা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি স্তরে এখন পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থ গ্রহণ না করায় কৃষকদের অভাবের সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণীর দালাল ও মুনাফোলোভী গোষ্ঠি। তারা সস্তাদরে ফসল কিনে তা মজুত করছে অধিক মুনাফার লোভে। এই অভাবী বিক্রি বন্ধ করতে অবিলম্বে সরকারি স্তরে লাভজনক সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে কৃষকদের কাছ থেকে ধান আলু পেঁয়াজ কেনার ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন ব্লকে মিছিল ও ডেপুটেশন সংগঠিত করে সিপিআইএমএল ও তার কৃষক সংগঠন এআইকেএম।
প্রধান দুই অর্থকরী ফসল আলু ও পেঁয়াজের উপযুক্ত দর না মেলায় কৃষকরা যখন দিশাহারা তখন হুগলী জেলার বিভিন্ন ব্লকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে পথে নামল কিষাণ মহাসভা (এআইকেএম)। ৯ মার্চ বিকেলে পান্ডুয়া ব্লকের খন্যানে সরকার কর্তৃক ১২০০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু কেনা ও কৃষকদের সমবায় ঋণ মকুবের দাবিতে জিটি রোড অবরোধ করা হয়। দীর্ঘক্ষণের অবরোধে যানজট সৃষ্টি হলেও উপস্থিত জনতা এই আন্দোলনকে সোৎসাহে সমর্থন জানান। পরদিন ১০ মার্চ কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি (আয়ারলা)’র উদ্যোগে বলাগড় ব্লকের মহিপালপুর হাটতলায় পথ অবরোধ করা হয়। অবরোধস্থল থেকে দাবি ওঠে, সরকারকে ১৫০০ টাকা কুইন্টাল দরে পেঁয়াজ কিনতে হবে। হাটবার হওয়ার কারণে বহু সাধারণ কৃষক এই অবরোধ কর্মসূচিতে স্বেচ্ছায় সামিল হয়ে যান। অবরোধ কর্মসূচিগুলি থেকে উজ্জীবিত কর্মীবাহিনী সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য ২০ মার্চ পান্ডুয়া কৃষি দপ্তর অভিযান করেন। সহকারী কৃষি অধিকর্তার (এডিএ) নিকট সাত দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। স্মারকলিপিতে, আলুর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ১২০০ টাকা কুইন্টাল দাবি করার সাথে সাথে হিমঘরে মজুত আলুর ২৫℅ সরকারী প্রস্তাব মতো যা ১৫℅) কৃষকদের থেকে ক্রয় করারও দাবি জানানো হয়। কৃষকদের সমবায় ঋণ মকুব, সার, বীজ, কীটনাশক সহ কৃষিতে ব্যবহৃত ডিজেল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, এ রাজ্যেই উন্নত মানের আলুবীজ পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদনেরও দাবি জানানো হয়।
এ ছাড়াও স্মারকলিপিতে, ষাট বছর ঊর্ধ্ব সমস্ত গরিব ও ক্ষুদ্র কৃষককে মাসিক কমপক্ষে ৫০০০ টাকা পেনশন প্রদান, সমস্ত ভাগচাষি, গরিব লিজ ও ঠিকা চাষিদেরও কৃষকবন্ধু প্রকল্পের আওতায় আনা এবং শস্যহানির ক্ষেত্রে মৌজাভিত্তিক ক্ষতির পরিমাণ মূল্যায়ন করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানানো হয়। এডিএ স্মারকলিপিতে দাবিগুলির সাথে সহমত প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে আলোচনার সময় এক অদ্ভুত তথ্য উঠে আসে। জানা যায়, কৃষক পেনশনের জন্য ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে আর কোনও কৃষকের কাছ থেকে আবেদন পত্র জমা নেওয়ার জন্য নূতন নির্দেশিকা জারি হয়নি। ২০১৮-১৯ এর সর্বশেষ সরকারি নির্দেশিকায় পান্ডুয়া ব্লকে নূতন মাত্র সত্তর জন বয়স্ক কৃষককে পেনশন দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এডিএ’র “হাত পা বাঁধা থাকায়” এর পর থেকে অতিরিক্ত আর কোনও কৃষককে পেনশন দেওয়া হচ্ছে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এডিএ দপ্তর অভিযানে অনেক গ্রামীণ মহিলা অংশ নেন।
নদীয়া জেলায় সারা ভারত কিষাণ মহাসভার পক্ষ থেকে ১৭ মার্চ বৃষ্টির মধ্যেও নাকাশীপাড়া ব্লকের এডিএ ও বিডিও দপ্তরে ডেপুটেশন হয়। দাবিগুল ছিল :
শিলাবৃষ্টিতে কৃষিতে প্রাকৃতিক বিপর্যস্ত ব্লক হিসাবে নাকাশিপাড়াকে সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করতে হবে। মাঠে মাঠে তদন্ত করে প্রতিটি কৃষকের ফসলের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। বিশেষ করে বিল্লগ্রাম মৌজায় করালির মাঠে সরেজমিন তদন্ত করতে হবে।
সেচে ব্যবহৃত ডিজেল ও বিদ্যুতের মূল্য কমাতে হবে, সারের কালোবাজারি বন্ধ করতে হবে। কৃষি-বীজ, সার কীটনাশক ন্যায্য মূল্যে সমবায়ের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হবে। ভাগ-চাষি, লিজ-চাষিদের সরকারি সহায়ক মূল্য পেতে কিষান ক্রেডিট কার্ড দিতে হবে। মৌজাভিত্তিক গ্রামে গ্রামে কৃষকের ধান ক্রয় করতে হবে। কিলো প্রতি ১২ টাকা দরে আলু ও ১৫ টাকা দরে পেঁয়াজ ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও এলাকার বিশেষ দাবি ছিল বিডিও দপ্তরে আদিবাসীদের জমির অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, শালিগ্রাম পশ্চিম পাড়ায় আইসিডিএস ঘর নির্মাণ ও রাস্তা সংস্কার প্রভৃতি।
শুরুতে ডেপুটেশন নেওয়ার ব্যাপারে কৃষি অধিকর্তা সময় দিতে নারাজ হওয়ায় তীব্র বিতর্ক হয়। শেষে তিনি নিজের ত্রুটি স্বীকার করে নেন। বলেন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে শিলাবৃষ্টির বিপর্যয় কতটা কী জানা যাবে, এজন্য তিনি উপরিস্তরে জানাবেন। উল্লিখিত করালির মাঠ দন্ত করবেন। ভাগ-চাষি ও লিজ-চাষিদের কিষান ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার ব্যবস্থা করবেন বলে তিনি জানান। এজন্য একটা গণস্বাক্ষর সহ দরখাস্ত দিতে বলেন।
অবিরাম বৃষ্টির ফাঁকে গত ২০ মার্চ ধুবুলিয়া ব্লক দপ্তরে এআইকেএম ও আয়ারলার প্রতিনিধি ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
কৃষকদের সাধারণ দাবিগুলি ছাড়াও ব্লকের নির্দিস্ট ইস্যুগুলি তুলে ধরা হয়। যথা অভাবী বিক্রির পর এখন অধিকাংশ চাষির ঘরে ধান নেই, অথচ কিষাণ মান্ডিতে ব্যবসায়ীরা লরি লরি ধান বিক্রি করে চলেছে কিভাবে? এ বিষয়ে অবিলম্বে বিডিওকে তদন্ত করতে হবে, চাষিদের স্বার্থে প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এক্ষেত্রে একটা দালাল চক্র কাজ করছে বলে বিডিও মেনে নিলেন। এছাড়া সমবায়গুলিকে কার্যকরী করে তোলা সহ কৃষকদের অন্যান্য দাবিগুলি তুলে ধরা হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে রাস্তা নির্মাণ ও সংস্কারের যে কাজ চলছে তাতে চুড়ান্ত অনিয়ম ও নিম্নমান সম্পর্কে নির্দিষ্ট অভিযোগগুলি জানানো হয়। ১০০ দিনের কাজ বা বকেয়া সম্পর্কে বিডিও জানালেন কেন্দ্র টাকা না দিলে এগুলির কোনোরকম সুরাহা হবে না। এ সমস্ত প্রশ্নে এলাকায় এলাকায় প্রচারকে তীব্র করে তোলা হবে বলে প্রতিনিধিরা ঘোষণা করেন। উপরোক্ত কর্মসূচির প্রতিনিধি দলে ছিলেন, কৃষ্ণ প্রামানিক, দিলীপ ঘোয, আনসারুল হক, অমিত মন্ডল, সালেমা বিবি, জয়তু দেশমুখ প্রমুখ।
এবছর আলু ও পেঁয়াজের দাম মরশুমের প্রথম থেকেই খুব কম দামে চাষিরা দুশ্চিন্তায় পড়েছিল। যত দিন এগোচ্ছে দাম আরও কমতে থাকে। পোখরাজ আলু ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কুইন্টাল বিক্রি হতে থাকে। জ্যোতি আলু ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা কুইন্টাল দামে বিক্রি হতে থাকে। যা উৎপাদন খরচের থেকেও কম। কৃষকরা লোকসানের ফলে দুরবস্থায় পড়ে। তার উপর ঋণের দায়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘঠতে থাকে। এই অবস্থায় টিএমসি সরকার ৬৫০ টাকা কুইন্টাল দামে ১০ লক্ষ টন আলু সংগ্রহ করার বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা করল। যার বিরুদ্ধে ১৫ মার্চ কালনা-কাটোয়া রোডের কালনা শহর সংলগ্ন বৈদ্দীপুর মোড়ে শতাধিক লোকের জমায়েতে রাস্তায় আলু রেখে ১ ঘন্টার মতো রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। পুলিশী হস্তক্ষেপে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। ২০ মার্চ রাজ্যব্যাপী কর্মসুচির অংশ হিসাবে কালনা ২নং, মন্তেশ্বর, গলসী ও পুর্বস্থলী ২নং ব্লকে ডেপুটেশন সংগঠিত হয়। রাজ্যভিত্তিক দাবির সাথে সাথে স্থানীয় দাবি যুক্ত করে বিডিওকে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। এবং বিডিও মারফত ১০ দফা দাবিতে কৃষিমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়। এই আন্দোলনে নেতৃত্বে থাকে সিপিআই(এম-এল) লিবারেশনের জেলা সম্পাদক সলিল দত্ত, এআইকেএম নেতা রফিকুল ইসলাম, আয়ারলার নেতা আনসারুল আমান মন্ডল, মোজাম্মেল হক, শিবু সাঁতরা, হরেকৃষ্ণ ঘোষ ও সজল পাল সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
অভাবী ফসল বিক্রির ক্ষতিপূরণ ও সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে চাষিদের থেকে সবরকম ফসল কেনার দাবি সহ একাধিক দাবিতে ২১ মার্চ ২০২৩, ওন্দার ব্লক এডিও অফিস ঘেরাও এর ডাক দিয়েছে সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের কৃষক সংগঠন সারা ভারত কিষাণ মহাসভা। এই কর্মসূচিকে সফল করার লক্ষ্যে ১৮ মার্চ সকালে নিকুঞ্জপুরের হাটে মিছিল করা হয় ও চাষিদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর নিমিত্তে দাবিগুলি নিয়ে আলোচনা করা হয় সংগঠনের নেতা বৈদনাথ চীনা ও পার্টির জেলা সম্পাদক বাবলু ব্যানার্জীর নেতৃত্বে।