রাজদম্ভের বিরুদ্ধে, রাজরোষের বিরুদ্ধে, রাজ্য সরকারের চরম অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাজারে হাজারে রাজ্য সরকারি কর্মীরা এবার রুখে দাঁড়ালেন। তৃণমূলী জামানায় এই প্রথম রাজ্য সরকারী কর্মীদের এই প্রতিবাদ প্রতিরোধ রাজ্যের গণতান্ত্রিক শ্রমিক কর্মচারী আন্দোলনে নিঃসন্দেহে এক নতুন মাইল ফলক রচনা করল। হাজারো প্রশাসনিক হুমকি, ডায়াস নন’এর চোখ রাঙানি, ধর্মঘটে সামিল হলে কারণ দর্শানোর হুশিয়ারী — সব যেন ফুৎকারে উড়িয়ে ধর্মঘটে সকলে সামিল হয়ে, শাসকের চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দিলেন এটা নতুন এক আরম্ভ! তুমি সতর্ক হও। সরকারি কর্মীরা নিজেদের হক এবার বুঝে নিতে বদ্ধপরিকর।
প্রচারের কেন্দ্রবিন্দুতে বকেয়া মহার্ঘ ভাতা প্রদানের বিষয়টা সামনে এলেও, রঙ বেরঙের ধূর্ত প্রচার মাধ্যম কিন্তু আন্দোলনকারীদের তুলে ধরা আরো দু’টো দাবি — ৬ লক্ষাধিক সরকারি শূন্যপদে নিয়োগ ও হাজার হাজার চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের স্থায়ীকরণ — সমধিক গুরুত্বপূর্ণ এই দাবিগুলির কোনো উল্লেখই করল না। আর্থিক পাওনা-গণ্ডার মোড়কে জাগ্রত এই উত্থানকে আটকে রাখার শত শয়তানি অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত জোরালো এক রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়েই আত্মপ্রকাশ করল, আর তাই, এই আন্দোলনকে দমন করার হরেক কৌশল নিতে রাজ্য প্রশাসন কোনো কসুরই করল না। এমনকি ধর্মঘটের দিনে তৃণমূল আশ্রিত গুন্ডাবাহিনীও রাজ্যের নানা প্রান্তে তান্ডব চালিয়েছে।
ভারতে ‘সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিক’ কর্মী ধর্মঘটের দিনই তার সম্পাদকীয় নিবন্ধে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতার বিষয়টিকে ‘অন্যায্যপূর্ণ’ এক ব্যবস্থা হিসাবে দাগিয়ে তা বন্ধ করে সমাজের প্রান্তিক, বিপন্ন মানুষের স্বার্থরক্ষার্থে সর্বজনীন উন্নয়ন খাতে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের সপক্ষে ওকালতি করেছে। কারণ, পত্রিকার ভাষায়, এরাই হলেন সমাজের ‘নিরাপদতম’ শ্রেণি। আর, দেশের সমগ্র শ্রমশক্তির মাত্র ২.২ শতাংশ সরকারি কর্মীদের জন্য মহার্ঘ ভাতার এই অন্যায্যতা কখনই বরদাস্ত করা যায় না! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র ভারতবর্ষ সরকারি ক্ষেত্রে সবচেয়ে কম কর্মসংস্থান করে থাকে। তারমধ্যেও বিপুল সংখ্যক সরকারি পদ বিলুপ্ত করা, বা শূন্যপদ পূরণ না করা সমস্ত ধরনের সরকারের এক সাধারণ নীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দরিদ্র বিপন্ন শ্রমশক্তির আর্থিক উন্নয়নের জন্য তাঁদের ন্যায্য মজুরি বৃদ্ধির বিপরীতে দাঁড়িয়ে স্বঘোষিত জ্যেঠামশাইয়ের দল সরকারি বদান্যতায় সামাজিক আর্থিক প্রকল্পগুলোকেই উন্নয়নের সোপান হিসাবে দেখাবার চেষ্টা করেছে, যার অর্থ হল দরিদ্র শ্রমজীবীরা সরকারি কোনো অনুদানের গ্রহীতা হিসাবেই, প্রজা হিসাবেই সরকারি অনুগ্রহ-নির্ভর জীবন কাটাবেন। তাঁদের থাকবে না আইনসিদ্ধ ন্যূনতম মজুরির অধিকার। আর, মজুরির আইনত অর্থই হল মহার্ঘ ভাতার অধিকার।
উল্লিখিত পত্রিকাটি আরও অভিযোগ করেছে, “কোনো বিবেচনা ব্যতিরেকে নিয়মিত ব্যবধানে বেতন বৃদ্ধি ঘটলে উৎপাদনশীলতার ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়”। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার প্রকাশিত সাম্প্রতিক সমীক্ষা ‘গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০২২-২৩’ প্রণিধানযোগ্য। উক্ত সমীক্ষা জানিয়েছে, এই শতাব্দীতে এই প্রথম বৈশ্বিক প্রকৃত মজুরি ঋণাত্বক স্তরে গড়িয়ে পড়েছে — ২০২২’র প্রথম অর্ধে বৈশ্বিক প্রকৃত মজুরি সংকুচিত হয়েছে (-)০.৯ শতাংশ হারে! শুধু তাই নয়, সমীক্ষার মতে, ২০২২ দেখাল যে ১৯৯৯’র পর এই প্রথম প্রকৃত উৎপাদনশীলতা ও প্রকৃত মজুরির বৃদ্ধির হারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তফাত তৈরি হয়েছে। প্রকৃত মজুরি সর্বত্র কমলেও তরতর করে বেড়েছে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা। আরও প্রণিধানযোগ্য, বিশ্বজুড়ে সমস্ত স্তরের শ্রমিক কর্মচারীর ক্ষেত্রেই এই সংকোচোন ঘটেছে আর উচ্চ আয় সম্পন্ন দেশগুলিতে এই তফাত সবচেয়ে বেশি। এই নির্মম তথ্যটি গোপন রাখল ‘সর্বাধিক প্রচারিত প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিক’টি।
রাজ্য সরকারি কর্মীদের বৃহত্তম সাবেক বামপন্থী সংগঠনের ডাকে নয়, এই প্রথম ৫৫টি বিভিন্ন সরকারি সংগঠন ও মঞ্চ একত্রে ‘সংগ্রামী যৌথ মঞ্চ’এর পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই নতুন অধ্যায় রচনা করলেন। নতুন সংগঠন ও সংগ্রামের রূপ হাজার হাজার সরকারি কর্মীদের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠে। এখানেই রয়েছে সংগঠনের সার্থকতা ও সাফল্যের চাবিকাঠি।
আগামীতে এই আন্দোলন কিভাবে এগিয়ে যাবে, রাজ্য সরকারের আচরণও কী হবে তা পর্যবেক্ষণ করা দরকার। তবে সরকারি কর্মী আন্দোলনে যে নতুন প্রাপ্তি, ইতিবাচক অধ্যায় সংযোজিত হল, বিপ্লবী-বাম-গণতান্ত্রিক মহল তাকে কুর্নিশ জানায়। নতুন আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে যাবে এই হার-না-মানা জেদ।