বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্র কিম্বা টিএমসি শাসিত পশ্চিমবঙ্গ - কৃষকদের দুর্দশা কিন্তু অব্যাহত
tmcruled-west-bengal

মহারাষ্ট্রের দোল উৎসব রং-পঞ্চমী নামে খ্যাত। এই উৎসবের ঠিক পাঁচদিন আগে সেখানে হোলিকা দহন করা হয়, অনেকটা আমাদের চাঁচর বা নেড়াপোড়ার মতো। এ’বছর সেখানে হোলিকা দহনের দিন এক অভিনব ঘটনা ঘটেছে। ‘হোলিকা’র দু’দিন আগে, নাসিক জেলার ইয়েওয়ালা তালুকের মাথুলথান গ্রামের এক কৃষক কৃষ্ণ ডোংরে পার্শ্ববর্তী এলাকার কৃষকদের তাঁর খামারে বহ্ন্যুৎসব পালনের জন্য আমন্ত্রণ জানান। তাঁর আমন্ত্রণে বহু কৃষক উপস্থিত হলে, তিনি তাঁদের সকলের সামনে তাঁর দেড় একর জমির সমস্ত পেঁয়াজ আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেন। বিষ্মিত জনতাকে তিনি বলেন, “এটি শুধু মহারাষ্ট্রের নয়, সমগ্র জাতিরই এক কালো দিন হয়ে রইল কারণ একজন কৃষক তার সমস্ত পেঁয়াজকে জ্বালিয়ে দিয়ে ‘হোলিকা’ উদযাপন করতে বাধ্য হয়েছে।” (সূত্রঃ নিউজক্লিক, ৬ মার্চ ২০২৩)

মহারাষ্ট্রে তো ‘ডবল ইঞ্জিনের’ সরকার, তবুও ওই কৃষক এমন পথ বেছে নিলেন কেন? তাঁর দেড় একর জমিতে পেঁয়াজ ফলাতে মোট খরচ হয়েছিল দেড় লক্ষ টাকা। গড়ে প্রতি বিঘায় তাঁর আশি বস্তা (৪০ কেজি) পেঁয়াজ ফলেছিল। তিনি খবর নিয়ে জেনেছিলেন, নাসিকের কাছে লাসালগাঁও’এ (যেখানে রয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম পেঁয়াজের পাইকারি বাজার) তাঁর সমস্ত পেঁয়াজ পৌঁছাতে পরিবহন খরচ লাগত ৩০ হাজার টাকা। আর তিনি তাঁর সমস্ত পেঁয়াজ বেচে পেতেন মাত্র ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ কুইন্টাল প্রতি তাঁকে ১৭৩ টাকা দরে (এক টাকা তিয়াত্তর পয়সা কেজি) পেঁয়াজ বিক্রি করতে হত। এমন বীভৎস লোকসানে ফসল বিক্রি করতে তিনি রাজি হননি। তাই প্রতিবাদ জানাতে তিনি হোলিকা উৎসবের আবহকেই বেছে নিয়েছেন।

না, কৃষ্ণ ডোংরের ঘটনা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে শোলাপুর জেলার এক ক্ষুদ্র কৃষক জানাচ্ছেন, ৫১২ কেজি পেঁয়াজ বিক্রি করে, চাষের সমস্ত খরচ-খরচা বাদে তিনি লাভ করেছেন ২ টাকা ৪৯ পয়সা মাত্র! তিনি ১ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।

তাহলে মহারাষ্ট্রের কৃষকরা কি নীরবে এই যন্ত্রণা মেনে নিচ্ছেন? কখনোই না। ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তাঁরা লাসালগাঁও’এ পেঁয়াজ নিলাম বন্ধ করে দিতে বাজার কমিটিকে বাধ্য করেন। শিরসাগাঁও’এ (নাসিক) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভারতী পাওয়ারকে তাঁরা ঘেরাও করেন। তাঁরা দাবি জানান, সরকারকে ১৫০০ টাকা কুইন্টাল দরে পেঁয়াজ কিনতে হবে।

আন্দোলনের চাপে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ বিধানসভায় ঘোষণা করেছেন, ‘নাফেড’ ৯০০ টাকা কুইন্টাল দরে পেঁয়াজ কিনতে শুরু করেছে। তা, কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠান মহারাষ্ট্রে কত পরিমাণ পেঁয়াজ কিনেছে? ৮ মার্চ ২০২৩ অবধি ৮ হাজার টন মাত্র! সরকারী ক্রয়ক্ষমতার কেরামতি আছে বটে!

এই প্রসঙ্গে মহারাষ্ট্রের সাথে আমাদের রাজ্যের পেঁয়াজ চাষিদের এক তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলে মন্দ হয়না। পশ্চিমবঙ্গে পেঁয়াজ চাষের প্রধান এলাকাগুলি হল হুগলীর বলাগড় ব্লক এবং বর্ধমানের ভাগিরথী তীরবর্তী কালনা ও নাদনঘাট থানার গ্রামাঞ্চল। এ’রাজ্যে পেঁয়াজের যা প্রয়োজন তার মাত্র ৩০ শতাংশ এ’রাজ্যে উৎপাদিত হয়। আর এর প্রায় সবটাই উৎপন্ন হয় পূর্বে উল্লিখিত এলাকাগুলিতে। বলাগড়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে খরচ হয়েছে গড়পরতা ৩৫ হাজার টাকা। বিঘেয় সর্বাধিক ৮০ বস্তা (৪০ কেজি) পর্যন্ত ফলন হয়েছে। একটা সময় ১৮০ টাকা বস্তা দরেও চাষিকে পেঁয়াজ বেচতে হয়েছে। এখন দর বেড়ে হয়েছে ৩৫০ টাকা বস্তা। এখনকার দর ধরলেও, একজন চাষি বিঘেপিছু সর্বাধিক ৩০ হাজার টাকা দাম পেয়েছেন। তাহলেও তাঁর বিঘা প্রতি লাভ দূরের কথা, ৫ হাজার টাকা লোকসান হয়েছে। এ’রাজ্যে হিমঘরে পেঁয়াজ সংরক্ষণের তেমন রেওয়াজ নেই। সুতরাং নানা বুদ্ধি খাটিয়ে কোনো চাষি (অবশ্যই তাঁকে স্বচ্ছল চাষি হতে হবে) যদি তাঁর বাড়ি বা খামারে কয়েকমাস পেঁয়াজ মজুত করে রাখতে পারেন, শেষে তিনি কিছুটা লাভের মুখ দেখলেও দেখতে পারেন। একেবারে গরিব চাষি — যিনি পারিবারিক শ্রমের ওপর নির্ভর করে চাষ করেন, তিনি ‘না লাভ, না লোকসান’ — এই অবস্থায় এ মরশুমটা পার করে দেবেন। আর গরিব যে ঠিকা চাষি, বিঘে কড়া ৫ হাজার টাকা জমি মালিককে দেওয়ার শর্তে চাষ করেছিলেন, এবার তাঁর ডাঁহা লোকসান। এ’রাজ্যের সরকার মহারাষ্ট্রের বিজেপি ও দলভাঙ্গানো শিবসেনা সরকারের মতো পেঁয়াজ কেনা বা সহায়ক মূল্য ঘোষণার সামান্য নাটকটুকুও করেনি। করবেই বা কেন? মুখ্যমন্ত্রী তো পেঁয়াজি ভাজার কথা বলেননি। তিনি বলেছেন ‘চপ শিল্পের’ কথা।

শীতের ফসল বা রবিশস্যের মধ্যে সরষে হল এক গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। আর সরষে চাষে অগ্রণী রাজ্যগুলির মধ্যে হরিয়ানা অন্যতম। বিজেপি-জেজেপি’র জোট সরকার চলছে এখানে। উন্নত কৃষির এই রাজ্যে এ’বছর ৬.৫০ লাখ হেক্টর জমিতে সরষে চাষ হয়েছিল। সেখানকার কৃষি দপ্তরের আশা ছিল, রাজ্যে এবার সরষের মোট উৎপাদন হবে ১৩.৬৫ লক্ষ টন। সহজ হিসেবে, বিঘে পিছু সেখানে ২৮৪ কেজি সরষে ফলার কথা। বাস্তবে সেখানে ফলন হয়েছে অনেক কম। প্রচণ্ড শীতে এবার ফুল ঠিক ফুটতে পারেনি। কমপক্ষে ৫০ শতাংশ উৎপাদন মার খেয়েছে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে লোকসানের পরিমাণ ৮৫ শতাংশ ছুঁয়েছে)। বিঘেতে গড়পরতা এবার সরষের ফলন হয়েছে মাত্র এক কুইন্টাল। ব্যবসাদাররা কুইন্টাল পিছু সরষে কিনছে ৪৬০০ থেকে ৫০০০ টাকায়। কেন্দ্রীয় সরকার সরষের এমএসপি বা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য্য করেছে ৫৪৫০ টাকা। প্রবল লোকসানের মুখে দাঁড়িয়ে ক্ষুব্ধ কৃষকরা সরষের এমএসপি বৃদ্ধির দাবি তুলেছেন। অন্যদিকে হরিয়ানা সরকার এমএসপি বাড়ানো দূরে থাক, সরকারী উদ্যোগে সরষে কেনাই শুরু করতে পারেনি। পাঁজি-পুঁথি দেখে টেখে তাঁরা স্থির করেছেন, আগামী ২৮ মার্চ ২০২৩ থেকে সরকারী উদ্যোগে সরষে কেনা শুরু হবে। ততদিনে ফড়ে-ব্যবসায়ীরা ছোট চাষিদের অভাবি বিক্রির আরও যে সুযোগ নেবে সে তো জানা কথা। তা না হলে, এই ক’দিন আগেও মানুষকে ২২০ টাকা কেজি সরষের তেল কিনতে হল কেন? সস্তায় কেনা সরষে ঘুরপথে আদানি মার্কা কোম্পানিগুলোর কাছে পৌঁছায় আর আমরা ‘হাঁ’ করে ‘ফরচুন কাচ্চি ঘানি সরষের তেলের’ বিজ্ঞাপন দেখতে থাকি।

এরাজ্যে অবশ্য জলবায়ু সরষে চাষের অনুকূল না হওয়ায় খুব কম সংখ্যক কৃষকই এখানে সরষে চাষ করেন। ফলন হয় বিঘে পিছু মোটামুটি এক কুইন্টাল, দেড় কুইন্টাল হলে তো ‘বিরাট ব্যাপার!’ দাম ওঠে ৪২০০ থেকে ৪৪০০ টাকা। কৃষকের দু’মুখ সমান হয়ে যায়। তবু তাঁরা সহ্য করে নেন কারণ ঘরে ব্যবহারের তেলটুকু তো আর কিনতে হচ্ছে না!

প্রধান অর্থকরী ফসলের মধ্যে আর বাকি থাকল আলু। বিশেষ করে আমাদের রাজ্যে, বেশ বড় অংশ চাষি (কমপক্ষে ৩০ লক্ষ কৃষক) আলু চাষ করে থাকেন। কিন্তু আলু চাষ হল সাপ লুডোর মতো। একবছর দারুন লাভ হল, তো পর পর দু’বছর মাথায় হাত। যেমন ২০২০তে চাষিদের অনেকেই বস্তা পিছু ৭০০ টাকাও দাম পেয়েছিলেন। লাভের আশায় ২০২১এ বেশি জমিতে আলু চাষ করে সর্বনাশের এক শেষ। দাম উঠল না। গতবছর অসময়ে বৃষ্টির কারণে ডবল করে চাষ করতে হল। দাম ভালোই উঠল। কিন্তু নাবি চাষে একে ফলন হল কম তার ওপর ডবল চাষের খরচা। চাষিদের বড় লোকসান হল। কিন্তু চাষ ছেড়ে তাঁরা যাবেন কোথায়? কর্মসংস্থানের আর তো সুযোগ নেই। এবার আকাশ ভালো ছিল। গতবারের লোকসান পোষানোর আশায় এবার অধিকতর জমিতে চাষ হল। রাজ্য সরকারের কৃষিপণ্য বিপনন দপ্তর থেকে বলা হল, আলুর ব্যাপক ফলন হবে (দেশব্রতী, ২ মার্চ ২০২৩ দ্রষ্টব্য)। হয়তবা এমন রটনার পিছনে বৃহৎ ব্যবসাদারদের ছক ছিল। চাষিরা ভয় পেয়ে মাঠ থেকেই আলু বিক্রি করতে থাকলেন। দাম পেলেন ২৭০-২৮০ টাকা বস্তা (৫০ কেজি)। চাষিদের মধ্যে হাহাকার দেখা দিল। সরকার বলল, ৬৫০ টাকা কুইন্টাল দরে আলু কিনবে। কিন্তু এই সামান্য সহায়ক মূল্যে কী হবে? বিঘে পিছু আলু চাষে খরচ ২৮-২৯ হাজার টাকা। আলু মাত্রায় জমি থেকে তোলার পর দেখা গেল, বেশিরভাগ জমিতেই ফলন খুব কম হয়েছে। মেরে কেটে বিঘেয় ৬০ বস্তা। সরকারী দাম পেলে তো বিঘেয় ২০ হাজার টাকাও হচ্ছেনা। তবু কৃষকদের জন্য সামান্য স্বস্তির কথা হল, এবার রাজ্যে মোট ৩০ শতাংশ উৎপাদন কম হওয়ায় রাজ্যের হিমঘরগুলি সম্পূর্ণত ভর্তি হবেনা। হিমঘর মালিকরা স্টোর ভরাতে আলু কেনার জন্য টাকা ঢালছেন। (বৃহত্তম আলু উৎপাদক রাজ্য উত্তরপ্রদেশের ছবিটা একটু ভিন্ন। সেখানে সমস্ত হিমঘর ভর্তি হয়ে গেছে। গড়ে চাষিরা সেখানে দাম পেয়েছেন ৩০০ টাকা বস্তা। তবে ফলন বেশি হওয়ায় চাষিরা ক্ষতি অনেকটা সামলে নেবেন।) আলুর দাম সাড়ে চারশোর দিকে এগিয়ে চলেছে। তাতেও চাষির লোকসানের পরিমাণ কমলেও লাভ হওয়ার আশা নেই। আর আগেই সস্তায় ফসল বেচে দিয়েছেন যে ক্ষুদ্র কৃষকরা তাঁদের দুর্দশা তো ঢের ঢের বেশি।

কৃষি ও কৃষকের এই সঙ্কট দেখে অনেকে ভাবেন, “এ থেকে উদ্ধারের রাস্তা নেই। লড়াই করে লাভ নেই।” তবু লড়াই হচ্ছে, হবে। তবে রাস্তার লড়াইকে যুক্ত করতে হবে সরকারগুলির নীতি পরিবর্তনের দাবির সাথে। কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন খাতে সরকারগুলি ফি বছর বরাদ্দ কমিয়েই চলেছে। এই অভিমুখের বদল ঘটানোর জন্য কৃষক সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক সমাজকে সোচ্চার হতে হবে। বলতে হবে, “কর্পোরেটদের তৈল মর্দন করা চলবেনা। কৃষিতে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি কর। সার, বীজ, বিদ্যুৎ, ডিজেল, কীটনাশকের দাম কমাও। কৃষককে সহজ শর্তে ঋণ দাও এবং ফসলের পর্যাপ্ত দাম পাওয়ার গ্যারান্টি সৃষ্টি কর।” 

- মুকুল কুমার

খণ্ড-30
সংখ্যা-6