যুক্তরাষ্ট্রীয়তাবাদকে ক্রমে ক্রমে নির্বাসনে পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ তাঁবে রাজ্যগুলোকে নিয়ে আসা হল মোদী ফ্যাসিবাদের এক চরিত্রলক্ষণ, যা মোদীর শাসনতন্ত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠেছে। আর, এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে মোদী সরকারের হাতে রাজ্যপাল পদটি সম্প্রতি বিরাট এক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটি অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালদের ভূমিকা নির্লজ্জ ও খোলাখুলিভাবে প্রমাণ করল যে এই সাংবিধানিক পদটি আজ কেন্দ্রীয় সরকারের কদর্য এক ক্রীড়নকে অধঃপতিত হয়েছে। অনেকগুলো অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে, যেমন, পঞ্জাব-মহারাষ্ট্র-কেরল-তামিলনাড়ু-তেলেঙ্গানা-পশ্চিমবঙ্গ-ঝাড়খন্ড-দিল্লী প্রভৃতিতে আমরা দেখেছি রাজ্যপাল কতটা নিচে নেমে কেন্দ্রের পক্ষাবলম্বন করেছে।
কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে। মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল ভগত সিং কোশিয়ারি ২০২২-এ উদ্ধব ঠাকরেকে বিধানসভার ফ্লোরে আস্থাভোটের মাধ্যমে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের ফরমান দেন, যার পরিণতিতে উদ্ধব সরকারের পতন হয়। এই ঘটনাকে তীব্র সমালোচনা করে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি বলেন, “শাসক পার্টির অভ্যন্তরে বিক্ষোভ মাথা চাড়া দিয়েছে এই যুক্তিতে রাজ্যপাল তার সাংবিধানিক পদকে অপব্যবহার করে যদি আস্থা ভোটের নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তবে তা গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করে আর আইনত নির্বাচিত এক কার্যকরী সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।... রাজ্যপালদের এমন কোনও ক্ষেত্রে প্রবেশ করা ঠিক হবে না, যা কোনও এক সরকারের পতনকে ডেকে আনে।” কিছুদিন আগে দেখা গেল, তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর এন রবি হঠাৎ হিন্দুত্ববাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে ব্যাখ্যা করে সেখান থেকে তামিল জনগণকে শিক্ষা নেওয়ার উপদেশ দিলেন।
দিল্লীর মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে আপ জয়ী হয়। কিন্তু নির্বাচনের পর মেয়র পদটি নিজেদের দখলে রাখতে মরিয়া বিজেপি দিল্লীর রাজ্যপালকে ময়দানে নামায়। গণতন্ত্রকে কবরে পাঠিয়ে, দু’কান কাটা এই রাজ্যপাল তাঁর মনোনীত ১০ জনকে মেয়র নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুমতি দেন। শীর্ষ আদালত তৎক্ষণাৎ ওই নির্দেশকে খারিজ করে জানায়, মনোনীত কোনো সদস্য মেয়র নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, আর দিল্লীর মেয়রের বিরাট গুরুত্ব থাকায় ২৪ ঘন্টার মধ্যে এই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে, যে নির্বাচন দিল্লীর রাজ্যপাল ভি কে সাক্সেনা এর আগে তিন তিনবার স্থগিত করে দেন।
রাজ্যপালের ক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক বিতর্ক হয়। ১৮৫৮-তে ভারত যখন উপনিবেশ ছিল, সেই সময় ব্রিটিশরা আঞ্চলিক রাজ্যপালদের নিয়োগ করত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের এজেন্ট হিসাবে, তারা তখন ছিলেন গভর্নর জেনারেলদের নিয়ন্ত্রণে, কাজ করতেন তাদের নির্দেশ অনুসারে। আজ বিজেপি সেই ঔপনিবেশিক ধারাকেই ফিরিয়ে আনল, যে বিজেপি সমস্ত প্রশ্নে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য থেকে ভারতকে মুক্ত করার বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে।
ব্রিটিশ তৈরি সংবিধানে রাজ্যপালের ক্ষমতা নিয়ে সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় সংবিধান সভায় অনেক বিতর্ক হয়। সেই বিতর্ক চলাকালীন আম্বেদকর ৩১ মে ১৯৪৯-এ স্পষ্ট ভাবেই ঘোষণা করেন, “সংবিধান রাজ্যপালকে এমন কোনও দায়িত্ব বা কাজ দেয়নি যা তিনি নিজের ইচ্ছেমতো করতে পারেন। তার পদটি আলঙ্কারিক, ক্ষমতা খুবই সীমিত ও নামমাত্র। তাঁর শুধু কিছু কর্তব্য রয়েছে, আর নতুন সংবিধান অনুযায়ী, তা তিনি পালন করবেন মন্ত্রীসভার পরামর্শ মেনে।” পরবর্তীতে একাধিক রায়ে শীর্ষ আদালত বলেছে, “নিজের বিচার বিবেচনা ও বিচক্ষণতা অনুযায়ী রাজ্যপালের পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রটিও খুবই সীমিত। এই সীমিত ক্ষেত্রেও তিনি নিজের খেয়ালখুশি মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। সেই সিদ্ধান্তের পেছনে থাকবে যথেষ্ট যুক্তি, সতর্কতার সাথে তা পরিচালিত হবে, আর তা নিতে হবে সৎ উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে।”
বিচারব্যবস্থাকে নিজেদের পকেটে পুরতে বিজেপি-আরএসএস বাহিনী নগ্নভাবেই মাঠে নেমেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এই আক্রমণের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী ও রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীশ ধনকড়। মহারাষ্টের রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে শীর্ষ আদালত তীব্র সমালোচনা করার পর বিজেপির ট্রোল বাহিনী প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কুৎসা, হুমকি, কুভাষণের বন্যা বইয়ে দেয়, যার বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত প্রতিবাদ জানিয়েছে। আর গোটা ঘটনাক্রমে নীরব প্রধানমন্ত্রী। আজ ভারতের গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যে কত বিপন্ন, কতটা আক্রান্ত তা এই সমস্ত ঘটনাই প্রমাণ করে।
বিপন্ন দেশ, আক্রান্ত মানবতা, ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে গণতন্ত্র, কণ্ঠরুদ্ধ মানবাধিকার। মোদীর শাসনতন্ত্র আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি আজ টেনে নিয়ে যাচ্ছে অধঃপাতের অতলে।