কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতির নির্দেশে রাজ্যে শিক্ষা দপ্তর সম্প্রতি ৮,২০৭ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে যাদের বর্তমান ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৩০ জনের কম। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মাত্র ৭ দিনের মধ্যে শিক্ষা দফতর এই তালিকা প্রকাশ করেছে এবং বিভিন্ন সমাজ মাধ্যমে তা প্রচার করা হচ্ছে। যদিও, এ সম্পর্কে কোনো নির্দেশিকা ও পদক্ষেপ নেবার কথা বলা হয়নি।
ইতিমধ্যে, গত ১০ বছরে রাজ্যের ৭০১৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় তুলে দেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে রাজ্যে বিদ্যালয় ছিল ৭৪,৭১৭টি। ২০২২ সালে ৬৯,৬৯৯টি। অর্থাৎ, বর্তমান তালিকা যোগ করলে তুলে দেওয়া স্কুলের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫,২২৫টি। ২০% স্কুল (২০১২ সালের নিরিখে)। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কি গত ১০ বছরে এই হারে কমেছে? উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিমধ্যেই বিদ্যালয় তুলে দেবার তালিকায় রয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন জোনের ১৩টি ব্লকের ১১৯২টি স্কুল। পশ্চিম মেদিনীপুর আদিবাসী প্রধান এলাকার ১০৪৭টি স্কুল। পূর্ব মেদিনীপুরের ৮৬৮ টি স্কুল।
কেবল শহরাঞ্চলেই নয়, রাজ্যের সেই সব প্রান্তিক জনগোষ্টির এলাকায় দীর্ঘ বছর পর্যাপ্ত বা প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ না করে, পরিকাঠামো উন্নত না করে ছাত্রদের বিদ্যালয় ছুট করা বা বেসরকারি বিদ্যালয়ে চলে যেতে বাধ্য করা হল। শিশুশ্রমকেও কার্যত বর্তমানে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বহু নন ফরমাল সেক্টরে ঢালাও শিশু শ্রম নিয়োগ চলছে। আর এখন “নয়া শিক্ষানীতি ২০০৯”-কে শিখন্ডি হিসাবে কাজে লাগিয়ে বিদ্যালয়গুলিকে তুলে দেবার চক্রান্ত চলছে। যেখানে নয়া শিক্ষানীতি অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩০:১। যদিও রাজ্য তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের সিলেবাস কমিটির সুপারিশ ছিল, শ্রেণী ভিত্তিক শিক্ষক। দীর্ঘ সময় ধরে ‘পরিকল্পিত হত্যা করে মৃত ঘোষণা’ করার কাজ হাতে নিতে চলেছে রাজ্য সরকার। যার পরিণাম প্রচুর উদবৃত্ত শিক্ষক, নতুন নিয়োগ বন্ধ। প্রান্তিক ও দরিদ্র, আদিবাসী, তফসিলি, জনজাতির সন্তানদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করা। যাদের টাকা থাকবে, তারা বেসরকারি স্কুলে পড়বে। এ হল কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতি রূপায়ণের নীল নকশা। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামোন্নয়ন সমস্ত প্রশ্নেই বাংলার সরকার কেন্দ্রের নীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে শুধু ভোটস্বার্থে দিল্লিবিরোধী ভাষণ দিচ্ছেন।
এই সমস্ত বিদ্যালয়গুলিকে হয়তো বা নিকটবর্তী কোনো স্কুলের সাথে যোগ করা হতে পারে। কিন্তু, তার ফলাফল, ঐ সব শিশুরা দূর দুরান্তে পড়তে যাবে না। লেখাপড়াই ছেড়ে দেবে। কেননা, তাদের পিতামাতার সময় নেই হাত ধরে স্কুলে দেওয়া-নেওয়া করবে। সে কারণেই, নিয়মানুযায়ী, প্রাথমিক স্কুল ছাত্রদের বাড়ির ১ কিমির মধ্যে হওয়ার নির্দেশ আছে।
উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্তরেও এর প্রস্তুতি চলছে। নিয়োগের জন্য চাকুরী প্রার্থীরা রাস্তায়, আর সরকার বিদ্যালয়ই তুলে দেবার কাজে ব্যস্ত।
যখন আমাদের সামনে দিল্লীর রাজ্য সরকারের (কেন্দ্রের নিয়) শিক্ষা দফতর মডেল তৈরি করে দেখালো, কিভাবে সরকারি স্কুলগুলিকে গুণমানে উন্নত করে বেসরকারি স্কুলের থেকেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার দেখাতে চলেছেন কিভাবে সরকারি বিদ্যালয়ের ঝাপ বন্ধ করে দিতে হয়।
রাজ্যের শ্রমজীবী মানুষ, শিক্ষক, অভিভাবক সকলের মিলিত প্রতিরোধে এই প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে।
ইতিমধ্যেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সোচ্চার হতে শুরু করেছেন। সামাজিক দায়বদ্ধ প্রতিটি ব্যক্তি, সংগঠনকে গ্রাম ও ওয়ার্ড স্তরে ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক, অধিবাসীদের নিয়ে জনমত গঠন করে “বিদ্যালয় বাঁচাও” কমিটি গঠন করা দরকার। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা দফতরকেই বিদ্যালয় বাঁচানোতে দায়বদ্ধ করতে হবে। জেলা বা রাজ্য স্তরেও “সরকারী শিক্ষা বাঁচাও” কমিটি গঠন করা যেতে পারে।
জেলাওয়ারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তালিকা (৩০ জনের নীচে ছাত্র ছাত্রী)
আলিপুর দুয়ার - ১৬২টি, বাঁকুড়া - ৮৮৬, উঃ২৪ পরগণা - ৫৫০, বীরভূম - ৩২১, কোচবিহার - ১৪৮, দক্ষিণ দিনাজপুর - ২২৩, দার্জিলিং - ৫১৯, হুগলী - ৪১৪, হাওড়া - ২৭৮, জলপাইগুড়ি - ২১৮, ঝাড়গ্রাম - ৪৭৯, কালিম্পং - ২১৫, কলকাতা - ৫৩২, মালদহ - ১৩৭, মুর্শিদাবাদ - ২২৭, নদীয়া - ২৫০, প: মেদিনীপুর - ৬৯৬, পূর্ব বর্ধমান - ৩৩৮, পূর্ব মেদিনীপুর - ৩৬৯, পুরুলিয়া - ৬৯৪, শিলিগুড়ি - ৯৭, দ: ২৪ পরগণা - ৩৯১, উঃ দিনাজপুর - ৭৩ ।
– অজয় বসাক