‘অমৃত মহোৎসব’-এর বছরেও ভারতবর্ষের বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে শীতার্ত রাত কাটাবেন। কাটাতে বাধ্য হবেন। বহু মানুষের মাথা গোঁজার একটা আস্তানা থাকলেও ‘পাকা’ ঘর নেই। মাঝে মাঝে সরকারের ‘দাক্ষিণ্যে’ কিছু গৃহহীন মানুষ ঘর পান, কারও ভাঙা মাটির ঘর ‘পাকা’ হয়। নির্বাচনের আগে সরকারি বিজ্ঞাপন আলো করে। কংগ্রেসী জমানায় ১৯৮৫ সালে শুরু হওয়া ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ই এখন মোদী সরকারের ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’। অঙ্ক কষেই কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্যে সম্প্রতি এই যোজনায় কিছু অর্থ বরাদ্দ করেছে। সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর বিজেপি’র রাজ্য নেতৃত্ব তাতে এমন হুঙ্কার ছাড়ছেন যেন টাকাটা তাদের পৈতৃক জমিদারি থেকে এসেছে। যদিও ভুলে গেছেন ১০০ দিনের কাজে আমাদের রাজ্যের বকেয়াই সব চেয়ে বেশি (২৭৪৪ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা যেখানে যোগীরাজ্যের বকেয়া মোটে ৫২ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা!)।
মোদী সরকার ‘লুঠ’কে প্রাতিষ্ঠানিক করে ফেলেছে। রাজ্যে শাসকদলের মন্ত্রী- নেতা-কর্মীরা, এমনকি কিছু আমলাও, দুর্নীতিকে তাই-ই করতে চলেছেন – নিয়োগ দুর্নীতি থেকে বগটুই-এর শিহরণ জাগানো মর্মান্তিক ঘটনা – সবই তার প্রমাণ। স্বাভাবিকভাবেই অনতি অতীতে আবাস যোজনার কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন থেকে গেছে। এই আবহে আবাস যোজনার সমীক্ষার, অর্থাৎ সঠিক প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ চাপিয়ে দেওয়া হল অঙ্গনওয়াড়ি ( আইসিডিএস কর্মী ) ও আশাকর্মীদের ওপর। যারা অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে তৃণমূল স্তরে মাটির সঙ্গে থেকে গোটা রাজ্যে শিশুশিক্ষা, প্রসূতি ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিচর্যার দেখভাল করেন। আশাকর্মীদের কাজটি এমনিতেই যথেষ্ট ঝুঁকি পূর্ণ। আসন্নপ্রসবাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কোনো সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো, সুস্থ থাকার বার্তা পৌঁছে দেওয়া, রাত- বিরেতে পথে-ঘাটে কত রকমের বিপদ ও সমস্যার ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করেন। তার ওপর আবার মাটির বাড়ি চিহ্নিত করার কাজ।
কাজটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্বপূর্ণ। কিন্তু আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কেন দেওয়া হল এই গুরুদায়িত্ব? তারা তো অন্য দায়িত্ব পালন করছেন? সম্ভবত তাদের পরিষেবার মান, দক্ষতা, কাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশাসনের কাছে গ্রহণযোগ্য শুধু নয়, প্রশ্নাতীত। আশাকর্মী হিসাবেই নয়, প্রাথমিকভাবে মহিলা হিসেবেই তাদের হাতে অতীতের কলঙ্ক মোচনের এই ভার তুলে দেওয়া হল।
একেবারে তৃণমূলস্তরের এই কর্তৃত্ব নিঃসন্দেহে একজন হতদরিদ্র মহিলার কাছে উপভোগ্য। একজন দোতলাবাড়ির মালিকের নাম নাকচ করা আর একটা পাকা ঘরের স্বপ্ন দেখা গরিব মানুষের স্বপ্নকে বাস্তব করার প্রথম সিঁড়িটা তৈরি করে দেওয়া – এর মধ্যে অবশ্যই একটা কর্তৃত্ব, একটা মর্যাদার স্বাদ আছে। কাজের প্রশ্নে আছে একটা আত্মতৃপ্তি। বিশেষ করে যারা চিরকাল মাথা নিচু করে অন্যের কর্তৃত্ব মেনে চলতেই অভ্যস্ত।
গ্রামে অশিক্ষা অজ্ঞতা কুসংস্কার জাত পাত বর্ণবিভাজনের অন্ধকার ঠেলে আশা-দিদিরা, আইসিডিএস কর্মীরা কীভাবে শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টির নিভু নিভু প্রদীপটি অনির্বাণ রেখেছেন, রাখছেন তার পরিচয় আমরা পেয়েছি কোভিড ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধকতা বোধ হয় রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা পেশীশক্তির আস্ফালন। সেখানে শাসক- বিরোধী দলে কোনো ফারাক নেই। মাত্রায় হয়তো কম-বেশি। সমাজে থাকা পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে এই ক্ষমতাতন্ত্রের মোকাবিলা করা কতটা দুরূহ যারা হাতে কলমে কাজটা করেন, তারাই জানেন। দোতলা বাড়ির মালিকের নাম কাটার পরে তার আস্ফালন, গালি-গালাজ, অসম্মান এমনকি প্রাণে মারার হুমকির ভয়কে এই গরিব স্বল্পশিক্ষিত মহিলারা উপেক্ষা করবেন কীভাবে? কাজের সময়ে তাদের সঙ্গী শুধু একজন গ্রামীণ পুলিশ। কে দেবে তাদের নিরাপত্তা? বাকি সময়ে? এই চরম টানা পোড়েন, মানসিক চাপের মূল্য প্রাণ দিয়ে দিয়ে গেলেন স্বরূপনগরের শাঁড়াপুল নির্মাণ পঞ্চায়েতের আশাকর্মী রেবা বিশ্বাস। এই চাপ সইতে না পেরে আত্মঘাতী হয়েছেন তিনি। আর প্রচ্ছন্নভাবে বলে গেলেন, গরিব মানুষেরও একটা শিরদাঁড়া থাকে, কর্তব্যের প্রতি দায়বদ্ধতাও থাকে! প্রশাসন তার প্রাণ মান রক্ষা করতে পারুক আর না-ই পারুক!
প্রশ্নটা শুধু সেখানে নয়। এই রেবা বিশ্বাসরা নিয়মিত যে কাজটা করে থাকেন – সেই প্রসূতি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি পরিচর্যার তদারকি – সেটা কি থেমে থাকবে? সেটা কি থামিয়ে রাখার মতো কাজ? প্রশাসনের কাছে সে কাজটি কি গুরুত্বহীন? নাহলে তারা চাপালেন কীকরে এই বাড়তি দায়িত্ব?
কোভিড-এর আগের থেকেই একশো দিনের কাজ প্রায় বন্ধ। কাজের টাকাও বকেয়া রাখা হয়েছে। সমানেই চলেছে চাপান-উতোর কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে। তাতে কি আয়হীন নিরন্ন মানুষের পেট ভরবে? রোগের চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা হবে? সেগুলোও তো তর্জনীর ইঙ্গিতে থেমে থাকার বিষয় নয়! তাহলে এই আবাস যোজনার সমীক্ষার কাজটি গ্রামের অন্য মহিলাদের দেওয়া গেল না কেন? সময়ের তাড়া, না কোষাগারের টাকা বাঁচানো? এক আশাকর্মী জানালেন, তাদের নাকি বাড়তি কিছু টাকা দেওয়া হবে। হবে তো বটেই, কিন্তু এই সমীক্ষার কাজে যে দায়িত্ব শ্রম এমনকি প্রাণের ঝুঁকি পর্যন্ত জড়িয়ে আছে, তার সঙ্গে এই ‘বাড়তি’ টাকা কতটা সাযুজ্যপূর্ণ? কতটা উপযুক্ত? নতুন কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ, তাছাড়া তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে গেলে সরকারি কোষাগারের অনেক টাকা খরচ! মানে অনেক হ্যাপা! তাড়াতাড়ি কাজটা নামাতে হবে ন্যূনতম ব্যয়ে। তাই প্রশাসনের চোখে আশা-দিদিরাই মুস্কিল আসান, আসলে ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’!
আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা এর বিরুদ্ধে মুখর হয়েছেন অনেক জেলার অনেক ব্লকেই। তাদের সংগঠন থেকেও সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এই তাড়াহুড়োর বেগার শোধের কাজে নানা কারণেই প্রচুর অসঙ্গতিও থাকছে। সংবাদে নজর রাখলেই সেইসব অনিয়ম ধরা পড়ছে। কোনো কোনো অঞ্চলে মানুষ বিশেষ করে মহিলারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন।
আসল কথাটা হল, নারীর শ্রম এখন ঘরের বাইরে এসেছে, পণ্যায়িত হয়েছে কিন্তু তার দাম লিঙ্গ বৈষম্যের এই সমাজে বড়ই কম। খুবই সস্তা! কল্পনাতীত সস্তা নারীর রক্ত ঘামের দাম! তাই তো মিড ডে মিল-এর দিদিদের মাসে মাত্র ১৫০০ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাদের অত্যন্ত দায়িত্ব ও ঝুঁকিপূর্ণ দৈনিক কয়েক ঘণ্টার শ্রম কিনে নেওয়া যায়! ষাট বছর পেরোলে বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে, একেবারে খালি হাতে বিদায় দেওয়া যায়! এক কথায় ব্যয় সংকোচের নাম করে নির্দ্বিধায় নারীর শ্রম লুঠ চলছে! লুঠ করছে সরকার – কেন্দ্রে-রাজ্যে। আর তাই আজ ‘নারীশক্তি’র এত মাহাত্ম্য কীর্তন! নারী ‘সেবাপরায়ণা’, ‘মায়ের জাত’, ‘ধরিত্রীর মতো সহিষ্ণু’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে সেই লুঠ চলছে। করপোরেট আধিপত্যের নয়া উদারবাদী অর্থনীতি নারীশ্রম শোষণে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
কিন্তু ধরিত্রীও উপেক্ষিত নির্যাতিত হতে হতে আজ চরম অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন। নারীদেরও সহিষ্ণুতার বাঁধ ভাঙছে! শুধু একজোট হওয়ার অপেক্ষা!
- জয়ন্তী দাশগুপ্ত