প্রতিবেদন
ওয়েব দৈত্যদের উদগ্র লোভ, ছাঁটাই ও শ্রমিক বিক্ষোভ
Web giants

ধনপতি এলন মাস্ক কর্পোরেট জগতের এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। তিনি খবরে থাকতে ভালোবাসেন, মাঝেমধ্যেই চমকপ্রদ সব প্রকল্প ঘোষণা করেন। তাঁর কোম্পানি টেসলার চালকহীন গাড়ি এখনো বিশবাঁও জলে, দু-দুবার ট্রায়াল রানে দুর্ঘটনা করেছে। প্রস্তাবিত সাইবার ট্রাক যা নাকি স্পোর্টস কার তুল্য আরামদায়ক ও ত্বরিতগতি সম্পন্ন এবং, যা মনে করা হচ্ছে পণ্য পরিবহনে নতুন যুগ সূচিত করবে, তা এখনো ভবিষ্যতের গর্ভে। আর মঙ্গল গ্রহে কলোনি স্থাপন করার প্রস্তাব ঘোষণা করে তিনি তো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। এহেন মাস্ক যখন টুইটার ক্রয় করলেন, তখন টেক জগতে এমন এক কম্পন দেখা গেল যা অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এক আসন্ন বিশ্বজোড়া মন্দার নিশ্চিত পূর্বাভাস।

সমাজমাধ্যমের এই জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মটি তিনি ৪৪ বিলিয়ান ডলারে ক্রয় করেছেন যার জন্য তাঁকে বিপুল অঙ্ক ঋণ নিতে হয়েছে। তিনি তো বিশ্বের সবচেয়ে ধনশালী ব্যক্তি, হঠাৎ তাঁর টুইটার কেনার এই খামখেয়ালীপনা কেন? তাঁর নিজের কথায় উদ্দেশ্য মহৎ — বাকস্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা। যা অনুচ্চারিত, সর্বসমক্ষে অব্যক্ত তা হচ্ছে তাঁর অন্যান্য ব্যবসার প্রচারের একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। তিনি ক্রয় করার পর থেকেই সংস্থাটি সংকটে। বাকস্বাধীনতার বুকনি দিয়ে শুরুতে তিনি বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন। দুটি ঘটনা তাঁদের মধ্যে টুইটার সম্পর্কে অনীহা সৃষ্টি করল। প্রথমত তিনি ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্টের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। দ্বিতীয়ত ব্যবহারকারীদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করলেন, যা তথাকথিত ‘টুইটার ব্লু’ সার্ভিস বলা হচ্ছে। এরজন্য প্রতি মাসে ৮ ডলার করে মূল্য গুনতে হবে। মনে করা হচ্ছে এই দুটি কারণের ফলে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট ও ঘৃণা ভাষণের রমরমা বাড়বে। ইতিমধ্যেই যুদ্ধাস্ত্র-নির্মাণকারী লকহিড মার্টিন, জ্বালানির একচেটিয়া সংস্থা বিপির (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম) নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়ে গেছে। তাই প্রথমে আগ্রহ দেখালেও বিজ্ঞাপনকারীরা প্রমাদ গুণলেন, তাদের মধ্যে টুইটার সম্পর্কে সংশয় তৈরি হল। এরসাথে আছে বিপুল ঋণের চাপ, যারফলে সংস্থাটির সংকট আরও ঘনীভুত হল।

এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য এলন মাস্ক প্রথাগত রাস্তাই ধরলেন — কর্মী সংকোচন, অর্থাৎ বাংলা ছাঁটাই, তিনমাসের মাইনে দিয়ে বিদায় করা, আর উপভোক্তাদের থেকে পয়সা আদায় করা। এরফলে ৭,৫০০ কর্মী বাহিনীর প্রায় ৫০ শতাংশ তিনি ছাঁটাই করে দিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে অতি উচ্চপদস্থ প্রযুক্তিবিদরাও রয়েছেন। যেটা দেখা গেল সংকটটা খালি টুইটারেই সীমাবদ্ধ নয়। মেটা যা ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটস-অ্যাপের মূল আধার, তারা ১১,০০০ কর্মী ছাঁটাই করেছে, যা তাদের কর্মী সংখ্যার ১৩ শতাংশ। এছাড়া অ্যামাজন ১০,০০০ কর্মী, ক্রিপ্টো.কম তাদের কর্মী সংখ্যার ৩০ শতাংশ, এয়ারবিএনবি ২৫ শতাংশ, স্ন্যাপচ্যাট ২০ শতাংশ, উবের ১৪ শতাংশ, ইত্যাদি আরও অনেক সংস্থা ব্যাপক হারে কর্মী বিদায় করেছে। শুধুমাত্র সফটওয়্যার বা পরিষেবা ক্ষেত্রেই নয়, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার ক্ষেত্রেও চাকরি চলে যাওয়ার করাল ছায়া। হিউলেট প্যাকার্ড আগামী তিন বছরে ৬০০০, হার্ড ড্রাইভ নির্মাণ সংস্থা সিগেট ৩০০০, ইন্টেল ২০ শতাংশ কর্মী কমাবে। অর্থনৈতিক সংকট অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়িয়েছে। রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন কারণ বাড়ি কেনা ৩০ শতাংশ কমে গেছে। এমনকি বাইজুস, যে কোম্পানির নাম ২০২০’র আগে কেউ শোনেনি, করোনাকালে যাদের উল্কার মতো উত্থান হয়েছে এবং বিশ্বকাপ ফুটবলের স্টেডিয়ামে যাদের বিজ্ঞাপন কাতার এয়ারওয়েজ, কোকাকোলার পাশে জ্বলজ্বল করছে, তারাও ২৫০০ কর্মী ছাঁটাই করছে। তাদের নাকি প্রচুর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে যে কারণে তাদের খরচ কমাতে হবে।

 rampant greed for layoffs and labor protests

জানা যাচ্ছে শুধুমাত্র টেক কোম্পানিগুলোতে ইতিমধ্যেই ৭৮০টির অধিক সংস্থায় ১,২০,০০০ কর্মী ছাঁটাই হয়ে গেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিপর্যয় প্রত্যাশিত ছিল। করোনাকালে টেক সংস্থাগুলির ব্যবসা বিপুল বিস্তার লাভ করে। লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষ কম্পিউটার ও অনলাইন পরিষেবার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। খাদ্য সরবরাহ সংস্থা স্যুইগি, জোম্যাটো এবং বাইজুসের মতো অনলাইন পড়াশুনার সংস্থার অভুতপূর্ব উত্থান ঘটে। অতিমারীর কারণে বাড়ি থেকে কাজ করার প্রথা চালু হয়। বলা হচ্ছে এক দশকে টেক সংস্থাগুলির ব্যবসা প্রায় ১১.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যে কারণে কোম্পানিগুলি প্রচুর কর্মী নিয়োগ করে। কম্পিউটার ও অন্যান্য হার্ডওয়্যারের বিক্রি বিপুল বৃদ্ধি পায়। এই দু’বছর সময়ে এই সংস্থাগুলি আশাতীত মুনাফা অর্জন করে যারফলে প্রায় প্রতিটি দেশে অভুতপূর্ব অসাম্য দেখা যায়। করোনা স্তিমিত হওয়ার পরেই বাজারে মন্দা দেখা যায়। পার্সোনাল কম্পিউটার, অনলাইন সার্ভিসের চাহিদা কমে যায় যারফলে চলতি আর্থিক বছরে এই সংস্থাগুলির ব্যবসা অধোমুখি।

এরসাথে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি। ডিজিটাল দুনিয়ার ওয়েব ২.০ থেকে ওয়েব ৩.০এ দ্রুত পরিচলন ঘটছে যা টেক কোম্পানিগুলিকে ভীত করে তুলেছে। ওয়েব ৩.০ এসে গেলে যাঁরা কনটেন্ট তৈরি করেন তাঁদের আর কোনও মধ্যস্থ (intermediate) সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হতে হবে না। এতদিন আমি যদি কোনও বিষয়ের ওপর কোনও ভিডিও, পডকাস্ট ইত্যাদি নির্মাণ করি তবে তা ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাকে এই ওয়েব দৈত্যদের সার্ভারের ওপর নির্ভর করতে হতো। এতে আমার কনটেন্ট বিকৃত বা পরিবর্তিত হওয়ার সুযোগ থাকত, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। নতুন ওয়েব জমানায় আমি সরাসরি ক্রেতার কাছে পৌঁছে যেতে পারছি, অন্যদের সার্ভারের ওপর আমাকে নির্ভর করতে হচ্ছে না। একইভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্য আমাকে কোনও সরকারি বা বেসরকারি ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। ব্লকচেন প্রযুক্তি ও ক্রিপ্টোকারেন্সির উদ্ভবের ফলে এই পরিসরটাও কনটেন্ট বিক্রেতার কাছে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। ওয়েব দৈত্যরা স্পষ্টতই বুঝতে পারছে যে এরফলে ডিজিটাল দুনিয়ায় তাদের আধিপত্য খর্ব হতে চলেছে। তাদের ব্যবসা হ্রাস পাবে, যে কারণে খরচ কমানোর জন্য তারা মরীয়া হয়ে উঠেছে। এছাড়া কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকে অ্যালগরিদম (কম্পিউটারে কোনও সমস্যা সমাধানের গাণিতিক প্রক্রিয়া) নির্মাণে এখন মনুষ্য শ্রমের প্রয়োজন অনেক কমে গেছে। এটা এই ওয়েব কোম্পানিগুলিকে কর্মচারী ছাঁটাইয়ের আরও সুযোগ করে দিয়েছে।

প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন অর্থনীতির রূপ প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। কাজের ক্ষেত্র, কাজের চরিত্র রাতারাতি পাল্টে যাচ্ছে, আজকের দক্ষ কর্মী আগামীকাল অদক্ষ হয়ে যাচ্ছেন, নতুন একদল কর্মী যাঁরা নতুন প্রযুক্তিতে সরগর তাঁরা উঠে আসছেন। এই টালমাটাল অবস্থায় কাজ, চাকরি, অর্থনীতি কোন দিকে মোড় নেবে তা রীতিমতো অনিশ্চিত। এমনকি এই দানবাকৃতি ওয়েব সংস্থাগুলি আগামী দশকে টিকে থাকবে কিনা তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না।

আমাদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ধনকুবেরদের খামখেয়ালিপনা ও প্রযুক্তির উল্লম্ফনের ফলে যেসব শ্রমিক/কর্মচারী/প্রযুক্তিবিদ নিত্যনতুন পরিবর্তিত অবস্থায় ‘বাতিল’ হিসাবে গণ্য হচ্ছেন তাঁদের কী হবে? তাঁদের বিকল্প জীবিকা, রুটিরুজি, কাজের কী ব্যবস্থা হবে? বিশ্বজুড়ে মেহনতি মানুষ আজ এই অনিশ্চিত, অমানবিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সমাবেশিত হচ্ছেন। গত ২৫ নভেম্বর ২০২২ অ্যামাজন ওয়্যারহাউস কর্মীরা ভারত সহ তিরিশটি দেশে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তাঁদের দাবি কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের উন্নতি, কাজের নিরাপত্তা, শ্রমিকের অধিকার। তাঁরা মাসিক নুন্যতম ২৫,০০০ টাকা বেতন, আট ঘণ্টার কাজ, শ্রমিকদের বিশ্রামের জন্য আরামকক্ষ, শিশুদের জন্য কর্মক্ষেত্রে ক্রেশের ব্যবস্থা করার দাবি করেছেন। এই বিক্ষোভের মূল উদ্যোক্তা ‘মেক অ্যামাজন পে কোয়ালিশন’ যাঁদের অধীনে ৮০টি ট্রেড ইউনিয়ান, নাগরিক ও পরিবেশ সংগঠন রয়েছে। ভারতে ২৩টি শহরে ‘গিগ ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘হকার্স জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি’ এই বিক্ষোভ সংঘটিত করেছে যাতে অ্যামাজন ছাড়াও স্যুইগি ও জম্যাটোর কর্মীরা অংশগ্রহণ করেছেন। এছাড়া টেক কর্মীরা নানা ইউনিয়নে সমাবেশিত হচ্ছেন, যারমধ্যে অন্যতম ‘ইউনাইটেড টেক এন্ড আল্যায়েড ওয়ার্কার্স’। এঁরা অ্যামাজন, মেটা, গুগল, টুইটার ইত্যাদি অতিকায় টেক কোম্পানিগুলিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনার দাবি করছেন যাতে এদের ওপর কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করা যায়। প্রযুক্তির রূপান্তরের ফলে যেসব মানুষকে কর্মক্ষেত্রে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করা হচ্ছে তাঁদের কাজ, জীবিকা নিশ্চিত করার দায়িত্ব এই অতিমুনাফা লোভী সংস্থাগুলিকে নিতে হবে। তারা এটা এড়িয়ে যেতে পারে না, এটা তাদের সামাজিক দায়িত্ব।

- সোমনাথ গুহ

খণ্ড-29
সংখ্যা-46