সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনে (আফস্পা) বলীয়ান হয়ে ভারতীয় সেনারা যে অসংখ্য নারকীয় হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত করেছে, সেই ইতিহাসে সর্বশেষ আখ্যানটা যুক্ত হল গত ১৬ ডিসেম্বর ২০২২ জম্মু ও কাশ্মীরের রাজৌরিতে। সেনার গুলিতে নিহত হলেন দুই যুবক সুরেন্দ্র কুমার ও কমল কিশোর, আর গুরুতর রূপে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা অনিল কুমার। নিহত দুই যুবকই রাজৌরির ফালিয়ানার মুরাদপুর গ্ৰামের বাসিন্দা। নিহতরা সেনা শিবিরের ক্যান্টিনে মালবাহকের কাজ করতেন। শুক্রবার সকালে কাজে যোগ দিতেই তাঁরা সেনা শিবিরের দিকে যাচ্ছিলেন, আর সে সময়েই সকাল ৬টা ১৫ মিনিট নাগাদ সেনা শিবিরের আলফা গেটে প্রহরারত সেনা জওয়ান গুলি চালিয়ে দু’জনকে হত্যা ও একজনকে গুরুতর রূপে আহত করে।
যেকোনো সংঘটিত অপরাধের পর সেনাবাহিনী যে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। গুলিচালনার ঘটনা প্রকাশ্যে ঘটলেও এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা সেনার গুলিতেই ঐ যুবকদের নিহত হতে দেখলেও সেনারা বলল যে, ঐ দুই যুবক জঙ্গিদের গুলিতেই নিহত হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে সেনা নিপীড়নের যেকোনো ঘটনাতেই সেনারা সাধারণত বিজেপির সমর্থন পেয়ে থাকে। ব্যাপক সংখ্যাধিক ঘটনাতেই নিহত হয় মুসলিম যুবকরা, আর বিজেপি তাই সেনাদের বিরোধিতা করার কোনো তাগিদ অনুভব করে না। কাঠুয়ায় যাযাবর সম্প্রদায়ের ৮ বছরের নাবালিকার ধর্ষণের ঘটনার কথা স্মরণ করুন। ধর্ষকদের সমর্থনে হিন্দু একতা মঞ্চ শুধু মিছিলই সংগঠিত করেনি, রাজ্য সরকারে থাকা বিজেপির দুই মন্ত্রীও ধর্ষকদের সমর্থনে বক্তব্য রেখেছিলেন, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে পুলিশি পদক্ষেপকে ‘জঙ্গলরাজ’ বলে অভিহিত করতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। পরিস্থিতির চাপে সেই বিজেপিও এবার সেনার বিরুদ্ধাচারণে বাধ্য হয়েছে। নিহত যুবকরা স্থানীয় অঞ্চলের বাসিন্দা যেটি বিজেপির প্রভাবান্বিত এলাকা বলেই সবাই জানে, এবং স্থানীয় জনগণের প্রবল সেনা-বিরোধী মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সেনার হত্যাকাণ্ডের পক্ষে দাঁড়ালে সমর্থন ভিত্তির ভিন্ন মুখে ঘুড়ে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিকূল প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়ার নয়। নিহত দুই যুবকই ছিলেন দলিত সম্প্রদায়ের। জম্মু ও কাশ্মীরের বিজেপির তফশিলি জাতি মোর্চার সহ-সভাপতি গারু সানেহি বললেন, “সেনারা বলছে যে এই দুই যুবককে মেরেছে জঙ্গিরা; আমি তাদের এই প্রশ্নটা করতে চাই যে তাদের কথাটা যদি সত্যিই হয় তাহলে তারা কেন তল্লাশি ও ঘেরাও অভিযান শুরু করল না? ওরা মিথ্যা কথা বলছে। ওরা সারা দিনে একবারও শিবির থেকে বেরোয়নি।” প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্যের সাথে বিজেপি নেতা বক্তব্যও জঙ্গিদের গুলিতে দুই যুবকের নিহত হওয়ার সেনা বিবৃতিকে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করছে, সেনা জওয়ানের গুলিতে যুবক দ্বয়ের নিহত হওয়া নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ আর থাকছে না।
সেনার গুলিতে যুবকরা নিহত হওয়ার পর স্থানীয় জনগণ যথারীতি প্রতিবাদে নামেন। জম্মু-পুঞ্চ সড়ক অবরোধ চলে সাত ঘণ্টা ধরে। সেনা পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিবাদে অংশ নেন তাঁদের মধ্যে অনেক প্রাক্তন সেনা কর্মীও ছিলেন। বিক্ষুব্ধ জনতা সেনা শিবির লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে যাওয়া পুলিশ বাহিনীও বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অপারগ হয়। প্রতিবাদরত জনগণ দোষী সেনাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নিহতদের পরিবারের জন্য ক্ষতিপূরণ ও কাজের দাবিকে তুলে ধরে। প্রাপ্ত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশ ১৯ ডিসেম্বর ২০২২ রাতে দুই যুবকের হত্যার তদন্তে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) গঠন করেছে, এবং সিট’এর রিপোর্ট হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পারে কিনা, এবং সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে হত্যাকারী যথাযোগ্য শাস্তি পায় কিনা তা দেখার জন্য নিহতদের পরিবার অবশ্যই সাগ্ৰহে অপেক্ষা করবে।
যদি বলা হয় যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে জম্মু ও কাশ্মীর পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রে সেনা নির্মমতার সমস্ত ঘটনায় উৎস হয়ে থেকেছে সেনা বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফস্পা, তবে সেই অভিমতকে অতিশয়োক্তি হিসাবে খারিজ করার খুব একটা ভিত্তি থাকতে পারে না। আসাম রাইফেলসের হাতে মনোরমার হত্যা সহ অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে; একবছর আগে ২০২১’র ডিসেম্বরের গোড়ায় সেনারা নাগাল্যান্ডের মন জেলার ওটিং গ্ৰামে ১৭ জন নিরপরাধ কয়লা শ্রমিক ও গ্ৰামবাসীদের হত্যা করে; গোটা জম্মু ও কাশ্মীর এখন সেনাদের বুটের তলায়, সেনা নির্মমতায় সেখানের কত পরিববার ধ্বংস হয়ে গেছে, উধাও হয়ে যাওয়া অসংখ্য যুবকের মা-বাবার হাহাকারে উপেক্ষা ও অমানবিকতাই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া হয়ে দেখা দেয়, কত অঘোষিত কবরস্থানে চোখের আড়ালে রাখার চেষ্টা হয় রাষ্ট্রীয় পৈশাচিকতাকে। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেনা উৎপীড়নের প্রতিটি ঘটনার পরই আফস্পার বিদ্যমানতা প্রশ্নের মুখে পড়ে, তার বাতিলের দাবি ওঠে। এমনকি রাষ্ট্রপুঞ্জ আয়োজিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের আলোচনাতেও কোনো কোনো দেশ ভারতকে আফস্পা বাতিলের পরামর্শ দেয়। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মূর্তিমান প্রতিভূ আফস্পাকে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পরিহাস কি চলতেই থাকবে?
- জয়দীপ মিত্র