সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখার ১১তম রাজ্য সম্মেলন আগামী ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ অনুষ্ঠিত হতে চলেছ। কথা হবে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে, আজকের জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পুরনো ও নতুন সংগ্রাম ও সংগঠন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে।
সম্মেলনের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। দুনিয়াজুড়ে আজ মেয়েদের ওপর শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন হরেক রূপে বেড়ে চলেছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। ইরানের মেয়েরা হিজাব বাধ্যতামূলকভাবে ও ঠিকমতো পরার ব্যাপারে নীতি-পুলিশের হিংস্র খবরদারির বিরুদ্ধে এমনই জোরদার সংগ্রাম গড়ে তুললেন যাতে পিতৃতান্ত্রিক মৌলবাদী শাসকেরা পিছু হটে নীতি পুলিশ ব্যাপারটাকেই তুলে দিতে বাধ্য হল। তাঁদের এই প্রাথমিক জয় আমাদের উৎসাহিত করেছে। এদেশে আবার হিজাব পরলে স্কুল-কলেজে ঢুকতেই দেবে না বলে হাঁক পেড়েছে ক্ষমতাসীন সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি। এভাবে স্বাধীনতা হরণের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই আরো ছড়িয়ে দিতে হবে। সোচ্চার হতে হবে নির্লজ্জ বিজেপি’র বিরুদ্ধে, যারা নারীদেহ-লোলুপ ভন্ডবাবা রামরহিমকে জেল থেকে চল্লিশ দিনের জন্য ছাড়িয়ে আনে নিজেদের নির্বাচনী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। সেই বিজেপি, যারা বিলকিস বানোর ধর্ষণকারী ও তার আত্মীয়দের হত্যাকারী নরপিশাচদের সাজা মকুব করেই ক্ষান্ত হয় না, তাদের মহান বীরের সম্মান দেয়। চরম নারী বিদ্বেষী প্রকৃতই গণশত্রু এই শাসকের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সংগ্রামে বাংলার মেয়েরা যে সামনের সারিতেই রয়েছেন, তার প্রমাণ গত বিধানসভা নির্বাচনেই দেখা গেছে। আগামী সম্মেলনের মর্মবাণীও হবে — ফ্যাসিস্ট শক্তিকে পরাস্ত করো, গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবিত কর।
‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ — গত বিধানসভা নির্বাচনে স্লোগান তুলেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। হ্যাঁ, বাংলার মেয়েরা উজাড় করে ভোট দিয়েছেন বাংলার মেয়েকেই। তবে তা শুধুমাত্র ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ বা ‘রূপশ্রী’র মতো নানা প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার তাগিদে নয়। তাঁদের ভোট ছিল ফ্যাসিস্ট বিজেপির নারী-বিদ্বেষী, জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মেয়েদের রাজনৈতিক চেতনার ভোট। অর্থাৎ, “নো ভোট টু বিজেপি”র ডাকে সাড়া দিয়েছেন তাঁরাও। কিন্তু ‘বাংলার মেয়ে’ আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে বাংলার মেয়েদের কী দিয়েছেন, কী দিচ্ছেন?
তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের অপশাসন ও পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির পাপের বোঝা চেপেছে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যুবতী-যুবকদের ওপর। এর প্রতিবাদে এবং কাজের দাবিতে তাঁদের দীর্ঘ আন্দোলনের ওপর লাগাতার চলেছে, এখনো চলছে বর্বর পুলিশি অত্যাচার। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা উত্তরপ্রদেশের মতো এরাজ্যেও প্রায় দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একুশ শতকেও মেয়েরা পণপ্রথার বলি হচ্ছেন, বধূ নির্যাতন ও অ্যাসিড হামলায় শীর্ষে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্ট, ২০২১)। আর এসব ন্যক্কারজনক ঘটনায় বহু ক্ষেত্রেই শাসকদলের নেতা, কর্মী ও মস্তানরা জড়িত থাকছে। কন্যাশ্রী প্রকল্প সত্ত্বেও নাবালিকা বিয়ে অব্যাহত রয়েছে। পুলিশ প্রশাসনও উদাসীন। ঘরেবাইরে মেয়েদের উপর হিংসার ঘটনায় নির্যাতিতারা যাতে দ্রুত ন্যায়বিচার পান সেজন্য পুলিশমন্ত্রী ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট গঠন সহ যেসব প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন তা স্রেফ ‘জুমলা’ বলে প্রমাণিত হয়েছে।
গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবার, বিশেষত: গর্ভবতী মা ও শিশু চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল খুব খারাপ। সেদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কোনো নজরই নেই।
লকডাউন পর্যায়ে গরিব ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে না পারার দরুণ মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলোর দ্বারা প্রতিদিন অসম্মানের শিকার হচ্ছেন। স্বনির্ভরতার নামে মেয়েদের নানা প্রকল্পের কাজে কম পারিশ্রমিকে কাজে লাগানো হয়। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল রন্ধন কর্মীদের দিনভর খাটিয়ে নিচ্ছে অথচ তাঁদের আইন মাফিক ন্যূনতম মজুরিটুকুও দেওয়া হয় না, স্থায়ীকরণ, শ্রমিকের স্বীকৃতি তো দূরের কথা। কর্মসংস্থানের নামে এঁদের সঙ্গে চলছে ধোঁকাবাজি। আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্মসংস্থান মানুষকে শুধুমাত্র স্বনির্ভরতা দেয় না, নিজস্ব পরিচয়ও গড়ে দেয়। সেই কর্মজগত থেকেই মেয়েদের ক্রমশ সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ‘অক্সফাম’এর সমীক্ষা ‘দ্য ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট ২০২০’ বলছে, শিক্ষা, যোগ্যতা, দক্ষতায় মেয়েরা যেখানে পুরুষের সমকক্ষ, সেখানেও মেয়েদের অগ্রগতি রোধ করা হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার পাল্লা দিয়ে হরেক নামে নানা প্রকল্প চালু করেছে, তাতেও কর্মসংস্থান হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবে ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতের অন্তত দু’কোটি মহিলা কর্মজগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। এতে মহিলাদের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ সংরক্ষণের আইন যাতে পুরোপুরি কার্যকর হয় সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক মঞ্চে মেয়েদের সমান ও সক্রিয় ভূমিকা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীমুক্তির লড়াই এগিয়ে যেতে পারে না। মেয়েদের ক্ষমতায়ন মুখ্যমন্ত্রীও মুখে বলেন, কিন্তু আমরা জানি কিভাবে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে শাসক দল বিগত নির্বাচনে অন্যান্য পার্টির মহিলা প্রার্থীদের ওপর জঘন্য সন্ত্রাস চালিয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেস এবার গুন্ডামি আরো বাড়াবে। বিজেপিও বোমাবাজি থেকে শুরু করে মদ ও টাকা দিয়ে ভোট কেনা পর্যন্ত কোনো কিছুই বাকি রাখবে না। সবরকম চাপ ও সন্ত্রাসের মোকাবিলা করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্যে ও স্বাধীনভাবে ভোট দেওয়ার জন্য মেয়েদের সাহসের সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। বিধানসভার মতো পঞ্চায়েতে ভোটেও ফ্যাসিস্ট বিজেপিকে রুখে দিতে হবে।
নারীর কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন ও শঙ্কাহীন স্বাধীনতা এবং সকলের জন্য অবাধ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এগিয়ে চলো — এটাই হোক আসন্ন সম্মেলনের সংগ্রামী আহ্বান।
- চৈতালি সেন