নারী তথা সমগ্র দেশের মানুষের গণতন্ত্রের উপর হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট আক্রমণকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে, নারীর কর্মসংস্থান, সমানাধিকার, মর্যাদা, গণতন্ত্র ও নির্ভয় স্বাধীনতার লড়াইকে জোরদার করার বার্তা নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর কলকাতার মৌলালী যুবকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হল সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ১১ তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন। রাজ্যের ১৩টি জেলা থেকে মধ্যবিত্ত গৃহবধু, শিক্ষিকা, গবেষক, ছাত্রী, গৃহ সহায়িকা, বিড়ি বাঁধা শ্রমিক, চা-শ্রমিক, তাঁত শিল্প কিংবা অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী, আশা ও মিড-ডে মিল কর্মী, কৃষিমজুর নারীরা, আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও সমাজের অনগ্রসর অংশের সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ জন মহিলা প্রতিনিধি অংশ নেন। এসেছিলেন সমিতির প্রতিষ্ঠা লগ্নের সমকালীন নেত্রীগণ ও বর্তমান সময়ের নতুন লড়াকু শ্রমজীবী ও চিন্তাশীল প্রজন্ম। তেভাগা আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলন উপলক্ষে কলকাতা শহরকে নামাঙ্কিত করা হয়েছিল শহীদ ‘অহল্যা মা’র নামে, সভাগৃহ উৎসর্গ করা হয় ফ্যাসিস্ট শক্তির হামলায় নিহত নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের নামে, আর সমিতির লড়াকু রাজ্য নেত্রী কণা সরকারের নামে মঞ্চের নামকরণ করা হয়েছিল।
এমন একটি সময় এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল যখন সারা দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তি নারীদের উপর ব্যাপক মাত্রায় আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, আধুনিক বহুত্ববাদী সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করে এক প্রাচীনপন্থী, মনুবাদী, সংকীর্ণ হিন্দুরাষ্ট্র গড়তে চাইছে ওরা। একদিকে “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” স্লোগান, অন্যদিকে সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার ও স্বাধীনতার কথা বললে তাদের ওপর চরম হেনস্থা ও হামলা। বিলিকিস বানোর দলবদ্ধ ধর্ষণকারীদের মুক্তি দিয়ে সরকার প্রমাণ করে দিল দেশের নারীদের ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা দিতে তারা বিন্দুমাত্রও ভাবিত নন। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের দাম হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় সংসার চালাতে মেয়েদের নাভিশ্বাস উঠছে। দেশে যুবক-যুবতীদের কর্মসংস্থান নেই।
এদিকে এই রাজ্যেও আজ ৬০০ দিনের বেশি হবু শিক্ষকরা রাস্তায় বসে। চাকরি নিয়ে দুর্নীতিতে শিক্ষামন্ত্রী জেলে। আশা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিডডেমিল কর্মীরা ন্যুনতম ভাতায় কাজ করছে। কেন্দ্ররাজ্যের টালবাহানায় ১০০ দিনের কাজের মজুরি নেই। রাজ্যে বাড়ছে ধর্ষণ ও নারীনির্যাতনের ঘটনা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হাঁসখালি, টিটাগড় সহ বেশ কিছু ধর্ষণ ঘটছে তৃণমূল দলের সদস্যদের দ্বারা। বধু নির্যাতনের শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ।
সম্মেলনের শুরুতে শহীদ বেদীতে মাল্যদান ও পতাকা উত্তোলনের পর প্রতিনিধি সম্মেলনের পর্ব শুরু হয় মীরা চতুর্বেদির উদ্বোধনী সংগীতের মাধ্যমে। সৌমি জানা আমির আজিজের ‘সব মনে রাখা হবে’ কবিতার হুঁশিয়ারি ধ্বনিত করেন। সভাপতি মন্ডলী ও সহায়ক সঞ্চালক মন্ডলী গঠন হয়। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৃষ্ণা অধিকারী তাঁর ভাষণে বলেন, “নারীর বহু লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও স্বাধিকারকে কেড়ে নিয়ে মনুবাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেবার জন্য ফ্যাসিস্ট বিজেপি নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। নারী অর্ধেক আকাশ, তাই তাদেরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ফ্যাসিস্টরা সংবিধান প্রদত্ত আইনগুলোতে দলিত-বিরোধী ও নারী-বিরোধী পরিবর্তন আনছে। গরিব মহিলাদের মিথ্যে আর্থিক প্রলোভন দেখাচ্ছে। সমাজকে বিভাজিত করার জন্য ধর্মীয় উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। সিভিল কোর্ট, তিন তালাকের বিরোধিতার কথা বলে মনুবাদী সংস্কৃতির ঠান্ডা জল ছিটিয়ে মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের আগুনকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। নতুন প্রজন্মকে তাই আজ মনুবাদ-বিরোধী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। তাদের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি জানতে হবে, মার্কসবাদসহ অতীত ইতিহাসকে অধ্যয়ন ও অনুধাবন করতে হবে। মধ্যপন্থী সংগঠনগুলো ক্ষমতার প্রশ্নে বিজেপি-বিরোধী হলেও মহিলাদের দাবিয়ে রাখার প্রশ্নে বিজেপির সঙ্গে তাদের অবস্থানে কোনো পার্থক্য নেই। মহিলাদের জন্য এটা এক অন্ধকার যুগ হলেও মেয়েরা প্রতিবাদে জ্বলে উঠছেন। এনআরসির বিরুদ্ধে, হিজাবের বিরুদ্ধে মেয়েদের লাগাতার সাহসী লড়াই আমাদের অনুপ্রেরণা।”
সম্মেলনে আমন্ত্রিত সিপিআই(এমএল) পলিটব্যুরোর সদস্য কার্তিক পাল বলেন, আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ততা চাই। অধিকারের প্রশ্নে রাস্তায় আন্দোলন চলছে। মহিলা সংগঠনে এসব উপাদান আগামীদিনে খুঁজতে হবে। গ্রামীণ শক্তির কথা মাথায় রেখে আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে মহিলাদের ভূমিকার কথা ভাবতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে শুধু প্রতিবাদ সংহতিতে সীমাবদ্ধ থাকা নয়, পরিকল্পিত ও ধারাবাহিকভাবে সংগঠিত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামাজিক শক্তি হয়ে উঠতে হবে।
এরপর আইপোয়া রাজ্য সম্পাদিকা ইন্দ্রাণী দত্তর পেশ করা খসড়া প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে প্রতিনিধিরা প্রাণবন্ত আলোচনা করেন। উঠে আসে তাঁদের জীবনের, লড়াইয়ের নানা অভিজ্ঞতা। একজন একশো দিনের কাজে মেয়েদের উপর চাপ ও হেনস্থা বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ন্যায্য পাওনা আদায়ের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। আধার লিংক ছাড়া রেশন মিলছে না। বয়স্কদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলছে না অনেক ক্ষেত্রে। এই সমস্যায় সমিতিকে পাশে থাকার পরামর্শ দেন জনৈকা প্রতিনিধি। চা বাগানে মজুরি বৈষম্য ও নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং আদিবাসী মহিলাদের হেনস্থা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তুলে ধরেন উত্তর বাংলার চা শ্রমিক সেমন্তী এক্কা। কলকাতার এক প্রতিনিধি বলেন যে নারী নির্যাতনের ধরন আজ আরও উগ্র হচ্ছে। সমাজে মূল্যবোধ পাল্টাচ্ছে বহিরঙ্গে। এই পরিবর্তনের সাথে সঙ্গতি রেখে মহিলা আন্দোলনের ধরনকেও পাল্টাতে হবে। একজন প্রতিনিধি রাস্তাঘাটে জল ও আলোর জন্য আন্দোলনে মহিলা সমিতিকে পাশে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। মুর্শিদাবাদের এক প্রতিনিধি বলেন যে মহিলারা আজ প্রকল্পের কাজে বাড়ির বাইরে পা রেখেছে। আশা, মিড-ডে মিলের ডেপুটেশনে অংশ নিচ্ছে। এদের মধ্যে থেকে মহিলা সমিতি গড়ে তোলা প্রয়োজন বলেন তিনি। হুগলির এক প্রতিনিধি প্রতিবেদনে পরিবেশের তথা দূষণ সমস্যার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে মত দেন। গার্হস্থ হিংসা সমাজে সুনির্দিষ্টভাবে কিভাবে রয়েছে তার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন মনে করেন তিনি। আরেকজন সাথী তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন যে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে মেধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়ার পরও কর্মক্ষেত্রে অসম্মানিত হতে হয় শুধু ‘মহিলা’ বলে। প্রতিমুহূর্তে পুরুষ সহকর্মীদের কাছে নিজের পেশাগত দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাওয়ার নিত্যদিনের লড়াইটা লড়তে হয় আজও মেয়েদের। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগত কাজেও পিতৃতন্ত্র লিঙ্গ হিংসা ও নারীবিদ্বেষের মুখোমুখি হতে হয় প্রতিদিন। নদীয়ার এক প্রতিনিধি বিড়ি শ্রমিকদের সমস্যার আরো উল্লেখ দাবি করে জানান যে তিনি নিজে বিড়ি-শ্রমিক ছাড়াও অন্যান্য স্তরের মহিলাদের নিয়ে সমিতির কাজে অংশ নেন ও সমিতির প্রসারে সচেষ্ট হন। অন্য এক প্রতিনিধি জানান যে হস্তশিল্পী ও সুচি শিল্পে নিযুক্ত কর্মীদের অত্যন্ত কম মজুরি দেওয়া হয় অথচ সেসব সামগ্রী বিদেশে চড়া দামে রপ্তানি হয়। এদের নিয়ে আন্দোলনের দাবি রাখেন তিনি।
বর্ষীয়সী নেত্রী মীনা পাল সম্মেলনের আয়োজকদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রগতিশীল মহিলা সমিতির আত্মপ্রকাশের পটভূমি এবং এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস তুলে ধরেন। উত্তরসূরিদের তিনি সতর্ক করে দেন যে শুধু দাবি দাওয়ার আন্দোলনে আটকে থাকলে হবে না, সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ব্যাপক মানুষকে সামিল করে এগোতে হবে।
এআইসিসিটিইউ-এর রাজ্য সম্পাদক বাসুদেব বসু বলেন, বিজেপির বুলডোজার রাজে শ্রম-কোড মহিলাদের নির্যাতন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শ্রমজীবী মহিলাদের সামাজিক মর্যাদার জন্য লড়তে হবে। আইসার রাজ্য সভাপতি নীলাশিস বসু মহিলা সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। সভায় ৪৩ জন বক্তার মধ্যে ৩৬ জন প্রতিনিধি বক্তব্য রাখেন। এরপর বিদায়ী কমিটির সম্পাদিকা ইন্দ্রানী দত্ত জবাবী ভাষণে বলেন যে সারা দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে মহিলা আন্দোলনের ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে।
সংযোজনী সহ খসড়া প্রতিবেদন সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ৭৩ জনের রাজ্য কাউন্সিল ও ২৯ জনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন। কমরেড ইন্দ্রানী দত্ত রাজ্য সম্পাদিকা এবং কমরেড চৈতালি সেন সভানেত্রী হিসাবে ঘোষিত হন। এছাড়া কাজল দত্ত চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরী ও মিতালী বিশ্বাস সহ-সম্পাদিকা এবং অর্চনা ঘটক, মমতা ঘোষ ও মলিনা বক্সি সহ সভানেত্রী হিসাবে ও কল্যাণী গোস্বামী কোষাধ্যক্ষ মনোনীত হন। নীতীশ রায় মীরা চতুর্বেদী এবং সুমেলী মোহলির গান সম্মেলনকে উদ্দীপ্ত করে। আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।