প্রতিবেদন
বিশ্ব জুড়েই কমছে প্রকৃত মজুরি
wages are falling

আইএলও প্রকাশ করল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক নথি — গ্লোবাল ওয়েজ রিপোর্ট, ২০২২-২৩, দ্য ইম্প্যাক্ট অফ ইনফ্লেশন অ্যান্ড কোভিড-১৯ অন ওয়েজেস অ্যান্ড পার্চেজিং পাওয়ার। বাংলায় তর্জমা করলে দাঁড়ায়, বিশ্ব মজুরি রিপোর্ট, ২০২২-২৩, মজুরি ও ক্রয় ক্ষমতার উপর মূল্যস্ফীতি ও কোভিড-১৯’এর প্রভাব।

অত্যন্ত উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে এই রিপোর্ট জানিয়েছে যে এই শতাব্দীতে এই প্রথম প্রকৃত উৎপাদশীলতা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি একেবারে তলানিতে নামতে নামতে ঋণাত্মক হয়েছে! এই শতাব্দীতে এই প্রথম প্রকৃত মাসিক মজুরি নেমে গেছে ঋণাত্মকে, -০.৯ শতাংশে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা ও মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি বেড়েই যাচ্ছিল, কিন্তু, রিপোর্ট দেখাল ১৯৯৯’র পর ২০২২ থেকে শ্রমের প্রকৃত উৎপাদনশীলতা (রিয়াল প্রডাক্টিভিটি) ও মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি চওড়া হয়েছে বিশেষ করে উচ্চ আয়সম্পন্ন দেশগুলোতে। সমস্ত স্তরের কর্মীই এই ক্রমাগত মজুরি হ্রাসের শিকার হলেও যে পরিবারগুলো নিম্ন আয় সম্পন্ন, সেই সমস্ত পরিবারগুলোর উপর এর অভিঘাত সবচেয়ে বেশি তীব্র হয়েছে।

রিপোর্ট দেখিয়েছে, কোভিড-১৯’এর গভীর সংকটকালীন সময়ে শ্রমিক ও তাদের পরিবারগুলো মারাত্মকভাবে মজুরি খুইয়েছে, আর কাজ হারানোর ফলেই ওই পরিবারগুলো সংকটের আবর্তে পড়ে যায়। কম মজুরির পেশায় যুক্ত শ্রমিক, ইনফর্মাল শ্রমিক ও শ্রমজীবী মহিলারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। অতিমারির নির্দয়তম সময়ে নিচু তলার ওই সমস্ত শ্রমজীবীদের মজুরি একেবারেই তছনছ হয়ে যায়, অবর্ণনীয় আর্থিক সামাজিক সমস্যার মুখে তারা পড়েন। ওই গভীর দুঃসময়ে খেয়ে পড়ে বাঁচতে ঋণ নিতে বাধ্য হন উচ্চহারে সুদের বিনিময়ে। কোভিড পরবর্তীতে আগের তুলনায় কম মজুরির কাজ পেলেও উচ্চসুদ ও হ্রাসপ্রাপ্ত মজুরির এই দ্বিমুখী চাপে আজ তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। আর এরফলে একটা দেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে বৈষম্য।

এই আর্থিক সামাজিক বিপর্যয়কারী প্রভাব থেকে সাধারণ মানুষকে পরিত্রাণ করার কার্যকরী পলিসির অভাবে শ্রমিক শ্রেণির প্রকৃত আয় ধারাবাহিকভাবে নিচের দিকে গড়াতে শুরু করে, যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। আয়ের মারাত্মক সংকোচন ভোগ ব্যয়ে রীতিমতো প্রভাব ফেলে, বাজারে চাহিদায় টান পড়ে বাড়তে থাকে মুল্যস্ফীতি, বিশ্বজুড়ে নানান দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো রক্ষণশীল মুদ্রানীতি অবলম্বন করায় তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। ফলে, রিপোর্ট জানাচ্ছে, অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো, কর্মসংস্থানের অবস্থা উন্নত হওয়ার বিপরীতে তা আরও ঘোরালো হয়ে উঠছে দুনিয়া জুড়ে, সামাজিক অস্থিরতা তীব্রতা পাচ্ছে।

বৈশ্বিক আর্থিক — শ্রমবাজার ও তার প্রেক্ষিত

কোভিড-১৯ — ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ ইউক্রেন যুদ্ধ — ২০২১ থেকে জীবন ধারণ ক্রমাগত ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠার এই একগুচ্ছ কারণগুলোর সম্মিলিত ফলাফলে ২০২২ থেকেই জীবনযাপনের খরচ ব্যাপকবৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল জুড়ে। এরকমই এক অনিশ্চয়তার পরিমন্ডলে আইএমএফ ২০২২’র জন্য বৈশ্বিক আর্থিক বৃদ্ধিকে ৩.৬ থেকে ৩.২ শতাংশে নামিয়ে আনল আর অক্টোবরে তারা যে চিত্রটা তুলে ধরেছে তা আরও কম। সেখানে তারা জানিয়েছে, ২০২৩এ বৃদ্ধির হার হবে আরও মন্থর, আর দাঁড়াবে ২ থেকে ২.৭ শতাংশের মধ্যে। অনেকেই মনে করছেন, ২০২৩ সারা দুনিয়া মন্দার কবলে পড়বে। ২০২২’র দ্বিতীয়ভাগে উন্নত দেশগুলোতে কর্মসংস্থানের চেহারা আগের তুলনায় ভালো হলেও মধ্য বা নিচু রোজগেরে দেশগুলোতে কর্মসংস্থান ২ শতাংশের নিচে নেমে গেছে — যা প্রাক অতিমারীর তুলনায় বেশ কম। দেখা যাচ্ছে, ইনফর্মাল অর্থনীতি ফর্মাল অর্থনীতির তুলনায় অনেক দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অনুমান ২০২২’র শেষে সারা দুনিয়ায় মুল্যস্ফীতি ৮.৮ শতাংশে ঠেকবে। ২০২৩-এ তা নামবে ৬.৫ শতাংশে আর ২০২৪-এ ৪.১ শতাংশ হারে। আইএলও তার রিপোর্টে জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতির সাপেক্ষে শ্রমিকদের আয়ে সামঞ্জস্য না আসলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানে যে অধোগতি নেমে এসেছে তা রোধ করা যাবে না।

মজুরির আন্তর্জাতিক প্রবণতা

আইএলও’র রিপোর্ট মারাত্মক এক উদ্বেগজনক প্রবণতাকে চিহ্নিত করেছে। ২০২২’র প্রথম অর্ধে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজুড়েই মাসিক মজুরি প্রকৃত অর্থে হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে -০.৯ শতাংশে নেমেছে, এই শতাব্দীতে যা আগে কখনো লক্ষ্য করা যায়নি। রিপোর্ট দেখিয়েছে, অন্যান্য দেশের তুলনায় চিনে মজুরি বৃদ্ধির হার বেশ খানিকটা বেশি। তাই, চিনের মজুরি বৃদ্ধি যদি উল্লিখিত মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে না ধরা হয় তবে মোট বৃদ্ধি আরো নেমে ওই পর্যায়ে এসে দাঁড়াবে -১.৪ শতাংশ। জি-২০ দেশগুলোর মধ্যে, যেখানে রয়েছে বিশ্বের ৬০ শতাংশ মজুরি প্রাপক শ্রমিক, সেই সমস্ত অগ্রণী দেশগুলোতে ২০২২’র প্রথম অর্ধে মজুরি হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে (-২.২ শতাংশ) হারে। আর, আত্মপ্রকাশমান দেশগুলোতে খুবই মন্থর হারে ০.৮ শতাংশ হিসাবে তা বজায় ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, বহু দেশ মজুরি বৃদ্ধির কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি।

কোভিডের সময়ে অগুন্তি শ্রমজীবী পরিবারের মজুরির হ্রাস ঘটে লক্ষণীয়ভাবে। বিশ্বজুড়ে গড় মজুরি বৃদ্ধি ২০২০ ও ২০২১ সালে হয় যথাক্রমে ১.৫ এবং ১.৮ শতাংশ হারে। কিন্তু ঘোর অতিমারীর সময়ে এই বৃদ্ধির জন্য মূল্য চোকাতে হয়েছে বিরাট মাত্রায় কাজ খুইয়ে, কর্মসংস্থানের ধরন বা গঠন বিন্যাসে বদল ঘটিয়ে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই উচ্চ আয় সম্পন্ন দেশগুলোতে অতিমারীর সময়ে বিশাল পরিমানে খেটে খাওয়া মানুষ যারা কাজ খুইয়েছেন, তারা হলেন স্বল্প আয় সম্পন্ন শ্রমজীবী মানুষ, আর বিপরীতে খুবই উচ্চ আয় সম্পন্ন কর্মীদের কাজ বজায় ছিল। এরফলে বেড়েছে বৈষম্য, গড় মজুরির হার হয়েছে আরও চওড়া।

জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোতে মজুরি বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি

আইএলও’র রিপোর্ট দেখিয়েছে, জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে (যাতে ভারত ও রয়েছে) ২০০৮ থেকে ২০২২’র এই তুলনামূলক লম্বা পর্যায়ে একমাত্র চিনেই প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ২০০৮-এ মজুরির প্রকৃত মূল্যের তুলনায় চিনে প্রকৃত মাসিক মজুরি ২.৬ শতাংশ হারে বেড়েছে। বিপরীতে, চারটি দেশে — ইতালি, জাপান, মেক্সিকো এবং গ্রেট ব্রিটেনের ইউকে ও নর্থান আয়ারল্যাণ্ডে ২০০৮’র তুলনায় ২০২২’র প্রকৃত মজুরি বেশ কম হয়ে যায়। জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর প্রকৃত মজুরি ২০২২’র প্রথম অর্ধে হ্রাস প্রাপ্ত হয়েছে -২.২ শতাংশ হারে, কিন্তু জি-২০’র আত্মপ্রকাশমান দেশগুলোতে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে ০.৮ শতাংশ হারে, যা ২০১৯’র সাপেক্ষে (অর্থাৎ কোভিডের আগের বছরে) ২.৬ শতাংশ কম। জি-২০ ভুক্ত দেশ ভারতে মজুরির প্রকৃত বৃদ্ধি নিচে গড়িয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালে ৯.৩ শতাংশ থেকে নামতে নামতে ২০২১-এ ঋণাত্মকে, -০.২ শতাংশে এসে ঠেকেছে। অতিমারীর পর থেকে ঋণাত্মক বৃদ্ধি শুরু হয়েছে।

শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়েছে, কমেছে প্রকৃত মজুরি

নয়া উদার অর্থনীতির অন্যতম ‘অবদান’ হল শ্রমের উৎপাদনশীলতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও বিপরীত মেরুতে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়েছে প্রকৃত মজুরি। ১৯৮০’র আগে থেকেই দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত মজুরির গড় বৃদ্ধির তুলনায় শ্রম উৎপাদনশীলতার গড় বৃদ্ধি অনেক বেশি! অনেকগুলো উন্নত দেশে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আইএলও’র রিপোর্ট দেখিয়েছে, ২০০০’র পর থেকে উচ্চ-আয় সম্পন্ন উন্নত অর্থনৈতিক ৫২টা দেশে (যতটুকে তথ্য পাওয়া যায়) উৎপাদনশীলতা ক্রমাগত বেড়ে চললেও সেই তালে বাড়েনি মজুরি। একবিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে, ২০২২’র পর উৎপাদনশীলতা ও মজুরির বৃদ্ধির হার রীতিমতো চওড়া হতে শুরু করে — মজুরি বৃদ্ধির সাপেক্ষে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ১২.৬ শতাংশ।

Real wages are falling

নারী-পুরুষের মধ্যে আয়-বৈষম্য

অতিমারী শুরু হওয়ার আগে নারী-পুরুষের মধ্যে যে আয়-বৈষম্য বজায় ছিল, তার কোনো হেরফের এখনও হয়নি। প্রকৃত মজুরি ক্ষয়ের ক্ষেত্রে অতিমারী দায়ী থাকলেও আয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য আগেও যেমন ছিল, তেমনটাই রয়েছে। রিপোর্ট দেখিয়েছে, ৮০টি দেশে এই আয়-বৈষম্য রয়েছে ২০ শতাংশ।

ভারত কোথায় দাঁড়িয়ে?

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, লিঙ্গ আয়ের বৈষম্যের ক্ষেত্রে ভারত আরো নিচে তলিয়ে ১৪৬টা দেশের মধ্যে স্থান করেছে ১৩৫ নম্বরে! এর অর্থ হল তালিবান শাসিত আফগানিস্থান থেকে ভারত মাত্র ১১ ধাপ উপরে, যে আফগানিস্থানে মেয়েদের স্কুলে প্রবেশই নিষিদ্ধ। অন্যন্য প্রতিবেশী দেশ — নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভূটান, চিন ও শ্রীলঙ্কার অবস্থা ভারত থেকে বেশ খানিকটা উপরে রয়েছে। মাত্র ৬ বছর আগে, ২০১৬-তে, এপ্রশ্নে ভারতের স্থান ছিল ৮৭ নম্বরে।

ক্রমাগত মজুরি হ্রাসের এই বিপজ্জনক প্রবণতাকে ঠেকাতে আইএলও প্রস্তাব — স্বাক্ষরকারী দেশগুলো ন্যূনতম মজুরির কাঠামোকে সংশোধন করুক, নিয়মিত ব্যবধানে মজুরি বৃদ্ধির বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিক। নারী পুরুষের মধ্যে এই যে মজুরির ব্যবধান ক্রমেই বেড়ে চলেছে তার জন্য ইতিবাচক কর্মনীতি গ্রহণ করুক, আলাপ আলোচনার কাঠামোগুলোকে আরও প্রসারিত ও মজবুত করুক, শক্তিশালী করুক শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর দরকষাকষির ক্ষমতাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকর্তা ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্ব যথাযথ করার উপর ও জোর দেওয়া হয়েছে।

পরিহাস এটাই, আইএলও’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেশ ভারত এই সমস্ত পরামর্শ বা সুপারিশকে আজ বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষিপ্ত করেছে। ট্রেড ইউনিয়নকে ঠেলে দিয়েছে প্রান্তিকে, ন্যূনতম মজুরির বদলে আনছে ফ্লোর স্তরের মজুরি। মোদীর আমল আজ ভারতকে নিয়ে যাচ্ছে চরম অধঃপাত ও সর্বনাশের কিনারে।

- অতনু চক্রবর্তী

খণ্ড-29
সংখ্যা-48