নামেই দুয়ারে সরকার! কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুই! তাই সরকারের দুয়ারে ধাক্কা দিতে এসেছিলেন নাকাশীপাড়ার গরিব আদিবাসী মানুষেরা। তাঁদের মৌন মলিন মুখে ধ্বনিত হল প্রতিবাদের ভাষা-অধিকারের দাবি। গত ১৪ ডিসেম্বর বেলা ২ টায় শতাধিক মানুষের অংশগ্রহণে নাকাশীপাড়া ব্লক দপ্তরে সংগঠিত হল প্রবল বিক্ষোভ ডেপুটেশন। দপ্তরে গিয়ে মহিলারা জোরের সাথে বললেন, ১০০ দিনের কাজ চালু হবে কবে? বকেয়া মিটবে কবে? সরকারি প্রচারে শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন দপ্তরের কাজে নাকি জবকার্ডধারীদের নিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু তার তথ্য কোথায়? কাদের নিয়োগ করা হচ্ছে? কোন পদ্ধতিতে? ব্লক আধিকারিক কিছুই বলতে পারলেন না। বরং তিনি জানালেন আধার সংযোগ না করলে দু-চার দিনের মধ্যে সমস্ত জবকার্ড নাকি বাতিল হয়ে যাবে। এ বিষয়টি বাধ্যতামূলক কেন? এ নিয়ে যথেস্ট প্রচার করা হয়নি কেন? প্রশাসন নিরুত্তর! বোঝা গেলো কেন্দ্রের মোদী সরকার প্রথমে বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। এখন বড় মাত্রায় জবকার্ড বাতিল করে দেওয়ার চক্রান্ত করছে। আর তৃণমূল গরিবদের প্রতি বঞ্চনা প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিনিধিরা বললেন, দরখাস্ত করেও এক বছর হয়ে গেল আদিবাসীদের জাতিগত সংশাপত্র পাওয়া যায়নি কেন? প্রমান স্বরূপ মীরাইপুর গ্রামের ৫০ জনেরও বেশি সংখ্যক বঞ্চিত আদিবাসীদের অনলাইন দরখাস্তের তথ্য তুলে ধরলেন তারা। তাহলে কি ঘুষ না দিলে কাজ হবে না? আদিবাসীদের শিল্পী-ভাতার দাবি জানানো হল। কয়েকটি নাচের দল ডেপুটেশনে অংশ নিয়েছিল। এ বিষয়ে জেলা তথ্য সংস্কৃতি আধিকারিকের কাছে যাওয়ার কথা ব্লকের আধিকারিকরা জানালেন।
এখন গ্রামবাংলায় আবাস যোজনা নিয়ে চলছে তুমুল সোরগোল। পঞ্চায়েত ভোটের আগে গ্রামে গ্রামে শুরু হয়েছে সেই দাতা গ্রহীতা রাজনীতির চেনা ছকের খেলা! বিজেপি? না তৃণমূল! কোন সরকার ঘর দিচ্ছে যেন চলছে তার কৃতিত্ব নেওয়ার প্রতিযোগিতা! উপভোক্তা বা অনুগ্রহ পাওয়ার দলে মানুষকে ঠেলে পাঠানোর রাজনীতি! এই ছক ভাঙ্গার লক্ষ্যে তুলে ধরা হল আবাসের অধিকারের প্রশ্ন! দলতন্ত্র ও ঘুষের মিশেলে ২০১৯ সালে তৈরি এই আবাস যোজনা তালিকায় ধরা পড়েছে মোটাদাগের অসঙ্গতি। প্রশ্ন উঠেছে তালিকায় বহু সংখ্যক গরিবের নাম নেই অথচ ঘর পাওয়ার উপযুক্ত, সেই বঞ্চিত মানুষেরা ঘর পাবে কিভাবে? বিপরীতে এই “আবাস প্লাস তালিকা”য় যাদের নাম রয়েছে দেখা যাচ্ছে তাদের ৮০ ভাগেরই পাকা ঘর রয়েছে। সেই ভূয়া নামগুলি বাদ যাবে তো? ওদিকে গ্রামে গ্রামে শাসক দলের মাতব্বররা বলে চলেছে, যতই “দল বহির্ভূত” “নিরপেক্ষ” তদন্ত অনুসন্ধান হোক না কেন, সব তালিকাই নাকি তাদের মর্জিতে হবে! কিন্তু বাস্তবে বিষয়টা এতো সহজে হবে না। মানুষ এখন শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন, প্রশ্ন তুলছেন। সম্পূর্ণ বিনা পারিশ্রমিকে যে প্রকল্প কর্মীরা সরেজমিন তদন্ত করছেন, দলীয় মাতব্বরদের চাপের মুখে কিংবা অনেক বাধা বিপত্তি সত্বেও তারা কিছুটা মাত্রায় সত্যকে তুলে ধরছেন। ডেপুটেশনের প্রতিনিধিরা বললেন, যে তালিকায় বিপুল বিয়োজন ঘটার সম্ভাবনা সেখানে সংযোজন হবে না কেন? ওরা বললেন আদেশ নেই। প্রশাসনের কর্তারা গতেবাঁধা নিয়মবিধির কথা শুনিয়ে বললেন, আবাস তালিকা নিয়ে আপত্তি ও দাবি দুটোই জানান। ডেপুটেশনে জমায়েত মানুষ জানিয়ে দিলেন, আবাসের অধিকারের দাবিতে, দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে মাঠে ময়দানের লড়াই জারি থাকবে। শালিগ্রাম গাছা এলাকার মানুষেরা প্রশ্ন তুললেন, দীর্ঘ দুই বছর ধরে পশ্চিমপাড়ার একটা রাস্তা নির্মাণের কাজ আটকে রয়েছে কেন? গ্রামের মানুষ নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সরকারি জমি উদ্ধার করে রাস্তা ও অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্র তৈরি করার প্রস্তাব পাঠিয়েছে। কিন্তু সর্বসাধারণের উন্নয়নের এই কাজে শাসকদল নিজের বাহাদুরি দাবি করতে পারবে না বুঝেই তারা চুপ করে বসে আছে? প্রশাসনের কর্তাদের জানিয়ে দেওয়া হলো আগামীদিনে গ্রামের মানুষ প্রয়োজনে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে সেই রাস্তা বানাবে।
বিএলএলআরও তথা জমি দপ্তরের ঘুঘুর বাসায় তীব্র বিক্ষোভ জানিয়ে পার্টি ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা জানালেন, জমির রেকর্ডে নাম অদলবদল করে দেওয়া হচ্ছে কোন নিয়মে? দুর্নীতি অনিয়মের জ্বলন্ত উদাহরণ, তথ্য প্রমাণ তুলে ধরে রীতিমতো জবাবদিহি চাইলেন তারা। উপস্থিত বিএলএলআরও ও দপ্তরের কর্মচারীরা ভুল হয়েছে বলে মেনে নিলেন। একের পর এক অনিয়ম বঞ্চনা দীর্ঘসূত্রিতার উদাহরণ তুলে ধরা হল। যথা আদিবাসী মানুষদের জমি বেদখল হয়ে রয়েছে, সেই জমি অ-আদিবাসী মানুষেরা বেআইনিভাবে রেকর্ড করে নিয়েছে, খাস বাস্তু জমিতে ৩০ বছর ধরে বসবাস করেও গরিব মানুষেরা পাট্টা পাচ্ছে না, গ্রামের তপশীলী সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবহৃত জমি খাস হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার কথা, কিন্তু সচ্ছল কিছু মানুষ সেগুলি ভূয়া রেকর্ড করে নিয়েছে। এ ধরনের বিষয়গুলি প্রমাণ সহকারে নিয়ে এসে জমির অধিকারের দাবি তুলে ধরা হল। জমিদপ্তরের আধিকারিকরা দায়সারা গোছের উত্তর দিলেন। উপস্থিত মানুষেরা জানিয়ে দিলেন লড়াই জারি থাকবে। পাট্টার জন্য জেলা স্তরে আদিবাসী দপ্তরে দাবি জানিয়ে কর্মসূচি নেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হল।
সমগ্র কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন কৃষ্ণ প্রামাণিক, সন্যাসী ওঁরাও, ইয়াদ আলি, হবিবুর রহমান, জীবন কবিরাজ, কাজল দত্তগুপ্ত, জয়তু দেশমুখ প্রমূখ।