গত সপ্তাহে চীনের বহু মানুষ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামে। একের পর এক শহরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে চীনে দেশব্যাপী এমন প্রতিবাদ এই প্রথম। মাত্র কিছুদিন আগেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। চীনে এই পার্টির একদলীয় শাসন চলে। পার্টি এবং পার্টিনেতাই দেশের নেতা। এবারও শি জিনপিং পার্টির সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন। পরপর তৃতীয়বারের জন্য তিনি ক্ষমতায় এলেন। জাতীয় মহাসম্মেলনের পর দেশের মানুষ ভেবেছিলেন একটু স্বস্তি পাবেন অত্যন্ত কড়াকড়ির হাত থেকে। চীনে কোভিডবিধির কড়াকড়িতে মানুষ অতিষ্ঠ। তৃতীয়বারের জন্য জিরো কোভিড নীতি নিয়েছে শি জিনপিং সরকার। যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে অত্যন্ত অনিশ্চিত ও হয়রান করে তুলেছে। এরই মধ্যে এক আবাসনে আগুন লেগে ১০ জনের মৃত্যু হলে তাকে এই সরকারী নীতির ফল হিসেবেই দেখে মানুষ এবং মানুষের বুকের ধিকিধিকি আগুন বিক্ষোভ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো।
গোটা বিশ্বই মহামারির ধাক্কা সয়েছে, কিন্তু চীনের মানুষের মতো এত বাধ্য ও অনুগত বোধহয় আর কেউ ছিল না নিজ নিজ দেশের কোভিড বিধির প্রতি। কোভিড মোকাবিলায়, সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যার নিরিখে অন্ততপক্ষে, বিশ্বে অনেকটাই এগিয়ে থেকেছে বৃহত্তম জনতার দেশ চীন। কিন্তু সবশেষে এসে দেখা যাচ্ছে প্রায় সারা দুনিয়া এই ভাইরাসটিকে শরীরে ধাতস্থ করে নিয়ে মহামারী থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও চীন এখনও পারল না। আবার লকডাউন। চীনের মতো কর্তৃত্ববাদী তথা নাগরিকের সর্বস্ব নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রে লকডাউন বাস্তবে চরম পুলিশী নিপীড়নের রূপ নেয়। চীনের কোথাও কোনও হাউসিং কমপ্লেক্সে একজন সংক্রমিত হলে সমগ্র হাউসিং সম্পূর্ণ বন্ধ, সংক্রমিতর সমস্ত নিকটাত্মিয়কে জোর করে কেন্দ্রীয় কোয়ারান্টাইন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এরকম একটি কোয়ারান্টাইন বাস দুর্ঘটনায় পড়ে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। এরকম বেশ কিছু মিসহ্যাপ খবর হয়। উরুমকির যে আবাসনে আগুন লেগে ১০ জন পুড়ে মরল, সেই আবাসন গত ১০০ দিন ধরে লকডাউন ছিল। ঝেংঝাউ প্রদেশে আইফোনের ফক্সকম এসইজেড ও সাংহাই’এ আইকিয়া স্টোর থেকে শ্রমিকদের দলে দলে পালিয়ে আসা ও পুলিশের সাথে সংঘাত আমাদের দেশের পরিযায়ী শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা মনে করিয়ে দেবে। এসবই চীনের যুবসমাজের নজরে আসে। বেজিং’এ প্রতি দু’দিন অন্তর লাইনে দাঁড়িয়ে কোভিড টেস্ট করাতে হয় সকলকে। টেস্টের রেজাল্ট আসবে কিউআর কোডের মাধ্যমে অ্যাপে। চীনের নাগরিকদের জীবন এখন এই কিউআর কোড তথা অ্যাপ দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। শহরে বা কোনও অফিস ইত্যাদিতে কেউ ঢুকতে পারবে কিনা তা সম্পূর্ণত অ্যাপ দ্বারা ঠিক হয় এবং নিজের মোবাইলে অ্যাপ ইনস্টল না করা অপরাধ। লকডাউনের এসব ইমিডিয়েট হয়রানি, অনিশ্চয়তা ও আশঙ্কার সাথে মিশে গেছে আর্থিক সমস্যা। চীনে বেকারত্ব ২০ শতাংশ ছুঁয়েছে। বর্তমান প্রতিবাদ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে কলেজগুলিতে। সামনে আছে যুবসমাজ। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে গণতন্ত্রের প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারছে।
চীনের সরকার এখন পাঁচ হাজার বছরের চীনা সভ্যতার তত্ত্ব সামনে এনেছে। ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব কাউন্টার করতে ‘সভ্যতাগুলির মধ্যে দেওয়া নেওয়া’ তত্ত্বের কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রাচীন সভ্যতার দাবিদার ও ব্যাখ্যাকার হিসেবে নিজেকে তুলে ধরে এটা আসলে দেশের অভ্যন্তরে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সর্বজনীন দাবিকে সম্পূর্ণ স্তব্ধ করে দেওয়ার কৌশল। ভারত, রাশিয়া ও অন্য কিছু রাষ্ট্রের বর্তমান শাসকদের মুখেও একই ধরনের তত্ত্ব শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে কন্যাভ্রূণ হত্যার প্র্যাক্টিস ভারতীয় ও চীনা সমাজে এখনও অত্যন্ত জোরালো।
“আপনারা জানেন আমি কী বলতে চাইছি” — কেবল এই কথাগুলি লেখা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরে একা এক যুবক যদি দাঁড়িয়ে পড়ে জনবহুল কোনও প্রকাশ্য স্থানে, আর পুলিশ এসে তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, আর সেই বার্তা হুহু করে ছড়িয়ে পড়ে দিগ্বিদিকে প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে একই আগুন অনেকের বুকে ধিকিধিকি জ্বলছে অনেকদিন। সমস্ত প্রতিবাদগুলোতে তরুণ প্রজন্ম যখন কিচ্ছু না লেখা সাদা কাগজ তুলে ধরে তখন তার নিঃশব্দ ধ্বনি বুকে বুকে জমে থাকা পাথরে পাথরে প্রতিধ্বনিত হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে আলোর গতিতে। আপাতত এই আগুন স্তিমিত হয়ে গেলেও চীনের মহান জনতার বুকে যে অভিমানের পাথর জমছে তা দেখিয়ে দিয়ে গেল।
– মলয় তেওয়ারী