৬ ডিসেম্বর দেশে বহু মানুষ বহু গণতান্ত্রিক সংগঠন রাস্তায় নেমে স্মরণ করেছে ভারতের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জানক ও কলঙ্কিত ১৯৯২-এর দিনটিকে যেদিন বাবরি মসজাদক গুড়িয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদ ভারতে তার চূড়ান্ত জয়যাত্রার ভিত্তি স্থাপন করেছিল। দেশজুড়ে মানুষ রাস্তায় নেমে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে দেশে এই হিন্দুত্ববাদীফ্যাসিবাদকে রুখে দাঁড়ানোর। কলকাতায় একটি নাগরিক পদযাত্রায় সামিল হয়েছিল বিভিন্ন গণসংগঠন। হাজরা মোড়ে এই পদযাত্রার শুরুতে বক্তব্য রাখতে গিয়ে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন যে ১৯৯১ সালের আগে পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর দিনটা ছিল ভারতে আম্বেদকরের প্রয়াণ দিবস। ১৯৯২ সালে এই দিনে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাটা নিছক একটা মসজিদের ওপরই আক্রমণ ছিল না, তা ছিল ভারতের সংবিধান, ভারতের গণতন্ত্র, ভারতের সমাজের সম্প্রীতির বুনট, ভারতের জনগণের আশা আকাঙ্খার ওপরেই এক চরম আঘাত। সর্বোচ্চ আদালত এই ধ্বংসকাণ্ডকে চরম অপরাধ বলে চিহ্নিত করেও শেষ পর্যন্ত সেই অপরাধীদের হাতেই সেই জায়গাটা তুলে দেয় – এই রায় দেশবাসীকে হতভম্ব করে দিয়েছিল বলে বিবৃত করেন দীপঙ্কর। বিজেপি-আরএসএস তখন হোক বা এখন কিভাবে সরকারী ক্ষমতা ও রাস্তার ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সমন্বয় করে তার উল্লেখ করেন। গুজরাট ২০০২ গণহত্যা থেকে শুরু করে মুজফ্ফরনগর বা দিল্লি সহ সমস্ত গণহত্যার শিকারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে, আমাদের জেলবন্দী এক্টিভিস্ট শিক্ষক সাংবাদিকদের সকলের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দীপঙ্কর আরও একবার আম্বেদকরের সেই অমোঘ সতর্কবাণী সামনে আনেন এবং সকলকে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে যেমনভাবে পারে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
পদযাত্রার শুরুতে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেন সংবিধানের ওপর আক্রমণের নানা দিক। এরপর মেধা পাটকর তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জানান যে দেশের ৩০০টি জেলায় এই নফরৎ ছোড়ো, সংবিধান বাঁচাও অভিযান চলছে। সকলে সম্মিলিতভাবে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বানে সকলকে উদ্দীপ্ত করে হাজরা মোড় থেকে পদযাত্রাকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেন তিনি। শুরুতে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট প্রবীণ ব্যক্তিত্ব সমর বাগচি মহাশয়। ছিলেন কমরেড কার্তিক পাল। দক্ষিণ ও উত্তর বঙ্গের মৎস্যজীবী ফোরামের বহু সদস্য ব্যানার প্ল্যাকার্ডে সজ্জিত হয়ে পদযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন, উপকূল জুড়ে মেগাপ্রজেক্ট ও কর্পোরেট আগ্রাসনে বিপন্ন মৎস্যজীবীদের কথা উঠে আসে তাঁদের শ্লোগানে। মুসলমান ও শিখ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের কর্মী সমর্থকেরা ছিলেন। ছিলেন এনএপিএম ও বন্দীমুক্তি কমিটির সাথে যুক্ত বিভিন্ন কর্মী সমর্থক ও সংগঠকেরা। ধর্মতলা ওয়াই চ্যানেল পর্যন্ত পদযাত্রায় দু-একটি স্থানে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট ভাষণে ও চলতি পথে বিদ্বেষ ও হামলার বিপরীতে ভালোবাসা ও সংহতির কথা সহজ ভাষায় বলতে বলতে চলেন সুজাত ভদ্র। শ্লোগান তোলেন নৌশিন ও ফারহান সহ অন্যান্যরা।
ওয়াই চ্যানেলে সমাবেশিত হওয়ার পর অভীক সাহা, প্রদীপ চক্রবর্তী, মহম্মদ কামরুজ্জামান, নৌশিন বাবা খান সহ বিভিন্ন বক্তারা বক্তব্য রাখেন। বিসর্গ নাটকের দল একটি ছোট পথনাটিকা প্রদর্শন করে ‘কাগুজে বাঘ’-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বার্তা দেয়। মেধা পাটকর তাঁর ভাষণে পুনরায় সকলকে উজ্জীবীত করেন। তিনি বলেন, আমরা কাউকে ভয় পায় না, আর কাউকে ভয় পাওয়াই না। তিনি সামাজিক আন্দোলনে ফ্যাসিবিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দলকে স্বাগত জানান। আগামি ৩০ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর শহীদ দিবসে দিল্লিতে জমায়েত হওয়ার আহ্বান রাখেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সেখানে আমন্ত্রিত। তিনি জানান যে শহীদ দিবসে সাইরেন বাজানোর যে সরকারী প্রথা ছিল তা বন্ধ করে দিয়েছে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার ঘোষণা করে এদিনের কর্মসূচি সমাপ্ত হয়।