প্রতিবেদন
লাচিত বরফুকন ও সংঘ পরিবারের ইতিহাস নির্মাণ প্রকল্প
Lachit Barfukan

লাচিত বরফুকন ছিলেন আসামের এক সেনানায়ক। ২০২২ সালে তাঁর জন্মের চারশো বছর হল। চার শতাব্দী আগের এই সমরনায়ককে নিয়ে ইদানীং বিশেষ করে সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভা আয়োজিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লাচিত কে ছিলেন, কী তাঁর কীর্তি সেই নিয়ে এই লেখায় যেমন আমরা কথা বলতে চাইবো, তেমনি বুঝতে চাইবো বিজেপি ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে লাচিত বরফুকনকে নিয়ে সংস্কৃতির রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়েছে। এও দেখার চেষ্টা করব লাচিত কী কেবল এই ভাষ্যে বা দৃষ্টিকোণেই ব্যাখ্যাত হতে পারেন, না কী অন্য আঙ্গিক থেকেও তাঁর জীবন ও কাজকে দেখা যায়, যে দেখা আবার সংঘ ও বিজেপির চলমান রাজনীতিকে বিপদে ফেলতে পারে।

সেইসব প্রসঙ্গে যাবার আগে দেখে নেওয়া যাক লাচিতের জীবন ও কর্মের কিছু তথ্য। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার সময়কালেই লাচিতের জীবন নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য বই বেরিয়েছিল। এসকে ভুঁইয়া লিখিত Lachit Barphukan and His Times নামের সেই বই আমাদের জানাচ্ছে যে লাচিত ছিলেন ছেঙ-কালুক মছাই নামের একজন তাই-অহোম পাদ্রীর চতুর্থ পুত্র। তিনি শৈশব কৈশোরে সামরিক ও অসামরিক দু’ধরনের শিক্ষাতেই শিক্ষিত হন। তারপর অহোম রাজা সুসেনফার অধীনে সেনাপ্রধান (অথবা ‘ফু-কান’)-এর দায়িত্ব পালন করেন।

লাচিত বরফুকনের প্রকৃত নাম ছিল লাচিত লাও। অহোম সাম্রাজ্যে প্রধান সেনাপতিকে বরফুকন উপাধি দেওয়া হত। লাচিত প্রথমে ‘ঘোড়া বরুয়া’ উপাধি পেয়েছিলেন কারণ তিনি প্রথম অবস্থায় দুর্দান্ত ঘোড়া বশে নিপুণ ছিলেন। তারপর তিনি দুলীয়া বরবরুয়া, শিমুলগুরীয়া ফুকন, দোলাকাষরীয়া ফুকন ইত্যাদি উপাধি পান, যেগুলি বিভিন্ন সমর কুশলতার কারণে দেওয়া হত। অবশেষে তিনি অহোমের রাজা চক্রধ্বজ সিংহ কর্তৃক ‘বরফুকন’ উপাধি পেয়েছিলেন। অহোম রাজা সুসেনফার সরাইঘাট যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে লাচিত বরফুকনকে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি লাচিতকে উপহারস্বরূপ স্বর্ণ তরোয়াল (অহোম ভাষায় হেং দাং) ও পারম্পরিক বস্ত্র প্রদান করেছিলেন।

সরাইঘাট যুদ্ধই লাচিতের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি। সমরনায়ক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের প্রতি লাচিতের নিষ্ঠার প্রমাণ হিসেবে একটি কাহিনী বিখ্যাত হয়ে আছে। সেই কাহিনী অনুসারে সরাইঘাট যুদ্ধের সময় লাচিত মোগলদের বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অহোম সেনাদের একটি উঁচু দেওয়াল নির্মাণ করার আদেশ দিয়েছিলেন। লাচিতের মামা এই দেওয়াল নির্মাণের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু তিনি অলস মনোভাবের জন্য সঠিক সময়ে দেওয়াল নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করতে পারেননি। নির্মাণের কাজ অসম্পূর্ণ দেখে লাচিত মামার শিরশ্ছেদ করেন। মামার শিরশ্ছেদ করার সময় লাচিতের উক্তি ছিল ‘দেশতকৈ মোমাই ডাঙর না হয়’, অর্থাৎ জন্মভূমির প্রতি কর্তব্যর থেকে মামার স্থান জীবনে বড় নয়।

সরাইঘাট যুদ্ধ হয়েছিল মোগল বাহিনী ও অহোম বাহিনীর মধ্যে। অহোম সেনাপতি ছিলেন লাচিত বরফুকন আর মোগল সেনাপতি ছিলেন রাম সিংহ। অহোম সেনার তুলনায় মোগল সেনারা বেশি শক্তিশালী ছিল কিন্তু গোরিলা যুদ্ধ কৌশলের ফলে মোগলেরা এই যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। মোগলেরা ৩০,০০০ সৈন্য, ১৫০০০ ধনুর্বিদ, ১৮,০০০ ঘোড়া, ১০০০ অধিক কামান ও বিশাল নৌকা নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। এই বিরাট মোগল সেনার তুলনায় নিজেদের অনেক দুর্বল দেখে অহোম সেনারা জয়লাভের আশা বাদ দিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করেছিল। নিজ সেনাকে পিছোতে দেখে সেনাপতি লাচিত বরফুকন বলেছিলেন, “তোমরা যদি পিছিয়ে যেতে চাও, যাও। কিন্তু স্বর্গদেও আমাকে আদেশ করেছেন, আমি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত লড়ব। তোমরা স্বর্গদেওকে বলবে আমি জীবনের অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত যুদ্ধ করেছি। লাচিতের এই কথা অহোম সেনার মধ্যে উত্তেজনা জাগায় ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে তারা মোগল সেনাকে পরাস্ত করে।

লাচিত আসামের বীর নায়ক। কিন্তু সংঘ পরিবার লাচিতের চারশো বছর পূর্তিতে তাঁকে নিয়ে আসামে ও জাতীয় স্তরে নানান অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে এক বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁদের কাছে লাচিত এমন এক ভারতীয় সেনানায়ক, যিনি মোগল তথা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়ে তাঁদের পরাস্ত করেছিলেন। শিবাজীর মতোই সপ্তদশ শতকের এই সমরনায়ককেও তাঁরা নিজেদের মতাদর্শে ঝাড়াই বাছাই করে নিজেদের সুবিধেমতো পেশ করতে চায়। শিবাজীর অন্যতর পরিচয় তুলে ধরে সংঘর ইতিহাসভিত্তিক রাজনীতির পর্দা যিনি ছিন্নভিন্ন করেছিলেন সেই গোবিন্দ পানসারেকে খুন হতে হয়েছে কয়েক বছর আগে। কিন্তু তাতে পানসারের লেখা বই ‘কে ছিলেন শিবাজী’ বইটির প্রচার প্রসারকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। তেমনি লাচিত বরফুকনকে যতই সংঘ পরিবার মুসলমানের বিরুদ্ধে হিন্দুর যুদ্ধের একমাত্রিক ন্যারেটিভে আটকে রাখতে চাক, এই তথ্য কি চেপে দেওয়া সম্ভব যে মোগল সেনাপতির বিরুদ্ধে লাচিতের নেতৃত্বে অহোমের বাহিনী লড়েছিল সেই মোগল সেনাপতির নাম ছিল রাম সিংহ, যিনি ছিলেন আদতে এক হিন্দু যোদ্ধাই? এই তথ্যও কি চোখ এড়িয়ে যাওয়ার যে লাচিত ছিলেন একজন তাই-অহোম পাদ্রীর পুত্র এবং জন্মসূত্রেই একজন খ্রিস্টান?

সর্বোপরি লাচিত ও অহোম রাজার যুদ্ধ প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন কিনা উঠতে পারে যে লাচিত ও অহমের সেনা তথা মানুষের মোগল বিরোধী এই যুদ্ধ দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সায়ত্তশাসনের তরফে এক জোরালো সংগ্রাম ছিল? বস্তুতপক্ষে লাচিত বরফুকনের ইতিহাস ও বীরত্ব আজকের দিনে বিজেপির তরফে চালানো অতিকেন্দ্রিক শাসন ও একঢালা হিন্দু হিন্দি হিন্দুস্থান প্রকল্পেরই মূর্ত প্রতিবাদ। কেন্দ্রীয় দমনের বিরুদ্ধে আজকের সংবিধানসম্মত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে লড়াই, সেই লড়াইয়ের একজন প্রেরণাদাতা হিসেবে লাচিতের ইতিহাসকে পড়া সম্ভব।

বিজেপি ও সংঘ পরিবার তাদের মতো করে ইতিহাসকে গড়েপিঠে নিতে চায়। তাদের ভূমিপুত্র ও বহিরাগতর প্রকল্পে খাপ খাওয়ানোর জন্য কখনো তাঁরা মান্য ইতিহাসকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, সেই ইতিহাসের বিশ্ববিখ্যাত অধ্যাপক ও গ্রন্থাবলীকে আক্রমণ করে, অন্যদিকে নিজেদের ভাষ্যসম্মত মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে। তারা তাই ইন্দো ইউরোপীয়দের এদেশে আগমনের ভাষাতাত্ত্বিক ও অন্যান্য প্রমাণগুলি মানে না, বলতে থাকে আর্যরা এদেশেরই আদিম অধিবাসী এবং এখান থেকেই তাঁরা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েছিলেন। বৈদিক সভ্যতাকে তারা মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে চায় প্রাক বৈদিক হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে। সিন্ধু সভ্যতাকে বেদ উল্লিখিত সরস্বতী নদীর সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে তাকে ডাকে সিন্ধু সরস্বতী সভ্যতা বলে। আর্যদের ভূমিপুত্র হিসেবে ঘোষণা করে তারা বাইরে থেকে আসা অন্যান্যদের বিশেষ করে তুর্কি, আফগান, ইরানীয় ও আরবীয় মুসলিমদের আগ্রাসনকারী হিসেবে দেগে দিতে চায়। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির সঙ্গে এক কাতারে বসাতে চায় সুলতানি ও মোগল শাসকদের। ঔপনিবেশিক শক্তির শোষণ লুন্ঠন ও সম্পদ পাচারের সঙ্গে সুলতানি বা মোগল শাসকদের এদেশের মানুষ হয়ে থেকে যাওয়ার ও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এদেশের সংস্কৃতিতে নানা উপাদান যুক্ত করে তাকে সমৃদ্ধ করার বিরাট পার্থক্যকে তারা মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে নস্যাৎ করতে চায়।

মুসলিম মাত্রকেই তারা সন্দেহের চোখে দেখার কথা বলে আর প্রচার করে এই দেশ তাদের জন্মভূমি হলেও পুণ্যভূমি নয়, সেটা তাদের কাছে আরব দেশ। এই কারণে মুসলিমদের ভারতের সাচ্চা নাগরিক বলে সংঘ মানতে চায় না। এই জায়গা থেকেই ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধা ও শহীদ টিপু সুলতানকে তারা নায়ক হিসেবে দেখার বদলে এক খলনায়ক হিসেবে বিশ্লেষণ করে। ইতিহাসের বস্তুবাদী ও নিরপেক্ষ বিচার তাদের উদ্দেশ্য তো নয়ই, বরং ইতিহাসকে বিকৃত করে ও একপেশেভাবে প্রকাশ করে তাকে নিজেদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত উদ্দেশ্যে কাজে লাগানোই তাদের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য থেকেই তারা লাচিত বরফুকনকে আজ ব্যবহার করে নিতে চাইছে। সংঘ ও বিজেপির সংস্কৃতির রাজনীতি নিয়ে আমাদের বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে।

– সৌভিক

খণ্ড-29
সংখ্যা-47