ট্রায়াম্ফ অব দ্য উইল — ১৯৩৩ সালে নাৎসি জমানায় লেনি রিফেনস্থাল নির্মিত তথ্যচিত্রটির দুটি বিষয় আজও আলোচনার দাবি রাখে। বিষয়গুলি হল — জন সংযোগের ক্ষেত্রে উপযোগী মাধ্যম হিসেবে সিনেমার প্রতি ফ্যাসিবাদীদের ঝোঁক এবং প্রচার অর্থাৎ প্রোপাগান্ডার জন্য নির্মিত হলেও সেই সিনেমার স্বতন্ত্র ভাষ্য তৈরির ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্থাৎ শৈল্পিক গুনমানের জায়গা থেকে উতরে যাওয়া। যুগ যুগ ধরে এই আধারেই অন্যান্য বিভিন্ন দেশের বহু ছবি আমাদের সামনে এসেছে, রাজনৈতিক ভাবে সমস্যাজনক হয়েও ভালো সিনেমা হিসেবে নাম লিখিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। বিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে একুশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকায় নির্মিত এরকম বহু ছবির নামই এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় যারা সাম্যবাদের প্রতি এবং নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে সোভিয়েতের প্রতি গভীর বিদ্বেষ নিপুণ দক্ষতায় সুক্ষভাবে মানুষের মনে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছে। বিবেক অগ্নিহোত্রী নির্মিত কাশ্মীর ফাইলস অবশ্য এই ক্ষেত্রে ডাহা ফেল করেছে। বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের মিছিল-মিটিংয়ের আলোচনায় উঠে আসা মিথ্যাচারকে বড় পর্দায় তুলে ধরা, হোয়াটসঅ্যাপ ফরওয়ার্ডের ইতিহাস বিকৃতিগুলোকে সিনেমার চরিত্রদের মুখে সংলাপ আকারে দিয়ে দেওয়া আর কাশ্মীরী পন্ডিতদের ঘাড়ে বন্দুক রেখে সমস্ত মুসলিম ধর্মের মানুষকে সন্ত্রাসের অবতার বানিয়ে দেওয়া ছাড়া এই সিনেমার নতুন কিছুই দেওয়ার নেই। সোজা ভাষায় বলতে গেলে এটি একটি প্রচারমূলক অর্থাৎ প্রোপাগান্ডা ছবি যেটি শৈল্পিক এবং মানবিক কোনো ধরনের চিন্তাভাবনাকেই প্রশ্রয় দেয় না। অবশ্য সংঘ ব্রিগেডের দিক থেকে এটা প্রথম প্রচেষ্টা নয় — গত ৮ বছরে অর্থাৎ বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতবর্ষে নির্মিত বেশ অনেকগুলি ছবিই ধর্মান্ধতার মতাদর্শকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। কাশ্মীর ফাইলসের সাথে বাকি ছবিগুলির পার্থক্য একটাই — এই ছবিটি বক্স অফিসে হিট করেছে, বহু মানুষ দেখেছেন, প্রযোজকের ঘরেও বেশ অনেক টাকাই ঢুকেছে। অবশ্য বাণিজ্যিকভাবে সফল হওয়ার জন্য কাঠখড়ও কম পোড়াতে হয়নি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে এই ছবির প্রচারে নেমে আসতে হয়েছে, অধিকাংশ বিজেপি শাসিত রাজ্যে ট্যাক্স মকুব করে দেওয়া হয়েছে। এই সবের মধ্যিখানে চাপা পড়ে গেছে কাশ্মীরের প্রকৃত ইতিহাস। নব্বইয়ের দশকের সন্ত্রাসের বাতাবরণে যারা দিনের পর দিন আতঙ্কে সময় কাটিয়েছেন তাদের কোনো ধর্ম নেই। তারা হিন্দু, মুসলিম, শিখ, এমনকি যারা কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাস রাখেন না — তারা প্রত্যেকেই মৌলবাদের, রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের শিকার। উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতবর্ষের তরফে যে কোনো সঠিক সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়নি উপরন্তু বিজেপি আসার পর কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে স্বেচ্ছাচার বৃদ্ধি পেয়েছে এই নির্মম সত্যিটা চেপে যাওয়ার জন্যই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কাশ্মীর ফাইলসকে। নইলে যে ৩৭০ ধারা তুলে দিলে কাশ্মীরের সকল সমস্যা ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা ছিল অন্তত অমিত শাহর দাবি অনুযায়ী, সেই ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার পর প্রায় বছর খানেক ধরে কাশ্মীরে ইন্টারনেট বন্ধ করে রাখতে হত না। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ, বিজেপির এককালীন জোটসঙ্গী মেহবুবা মুফতিকে দীর্ঘকাল যাবত ঘরবন্দী করে রাখতে হত না। কাশ্মীর ফাইলস ছবিটি একটি নির্দিষ্ট সময়ে যথাযথ উদ্দ্যেশ্য সাধনের জন্য নির্মিত হয়েছে এবং মুক্তি পেয়েছে — আপনি এই কথাটা বিশ্বাস করতে পারেন অথচ সোজাসুজি, সবার সামনে বলতে পারবেন না। বললে আপনাকে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করা হবে, খুনের হুমকি দেওয়া হবে, এমনকি আপনার নামে মিথ্যে মামলাও হতে পারে। ছবির পরিচালক অভিমান করে চ্যালেঞ্জও ছুঁড়ে দিতে পারেন — এই ছবিতে মিথ্যে কথা বলা হয়েছে প্রমাণ করতে পারলে তিনি ছবি বানানো ছেড়ে দেবেন। বিবেক অগ্নিহোত্রী আর কোনো দিন সিনেমা তৈরি করবেন না এই কথাটা আপামর সিনেমা-প্রেমীদের কাছে সুখবর হলেও এতে লাভের লাভ কিছুই হবে না কারণ দেশে, অন্তত এখনও পর্যন্ত, বিজেপি ঘনিষ্ঠ পরিচালকের অভাব নেই।
পরিচালকের কথা থেকেই এত কথার সূত্রপাত। নাদাভ লাপিড — ইজরায়েলের চিত্র পরিচালক। সম্প্রতি ভারতবর্ষে এসেছিলেন ৫৩তম আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবের বিচারক হিসেবে। মঞ্চে তিনি যখন উঠলেন তখন সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন বিজেপি সরকারের মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, ইজরায়েলের দূতাবাসের প্রধান সহ আরও অনেকে। কোনোরকম রাখঢাক না রেখেই লাপিড সরাসরি আক্রমণ করলেন ছবিটিকে। বুঝিয়ে দিলেন এই ছবির পরতে পরতে হয়েছে ঘৃণার চাষ। প্রশ্ন তুললেন একটি আন্তর্জাতিক চলচিত্র হিসেবে এই ধরনের নিম্নমানের ছবির মনোনয়ন পাওয়াকে নিয়েও। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার জোর করে ছবিটিকে ফেস্টিভালে জায়গা করে দিয়েছে। এই ছবি নিয়ে মাতামাতি হওয়া শুধুমাত্র বিদ্বেষের রাজনীতিকেই প্রশ্রয় দেয়, শিল্প এবং সমাজের প্রতি এই ছবির বিশেষ দায়িত্ব নেই। লাপিড জানতেন এই কথাগুলো বললে তিনি অনেকেরই চক্ষুশূল হবেন। তবে আপোষের পথে তিনি যে হাঁটবেন না একথা বলাই বাহুল্য। অতীতে বিভিন্ন সময় নিজের দেশের সরকারকে নানান প্রশ্নে আক্রমণ করেছেন লাপিড। ইজরায়েল কর্তৃক প্যালেস্টাইন দখল প্রসঙ্গে, পারমাণবিক ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে বহুবার ইজরায়েল প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন তিনি। মঞ্চে উঠে তিনি গোয়ার সমুদ্র সৈকত, খাবার নিয়ে দু-চার কথা বলে, উদ্যোক্তাদের গুণগান করে নেমে যাবেন এই আশা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষের লোকজন করে থাকলে বলতে হয় তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছিলেন। লাপিড নতুন কোনো কথা বলেননি, সেটাই বলেছেন যেটা এই দেশের সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ প্রগতিশীল মানুষরা কাশ্মীর ফাইলসকে নিয়ে ভেবেছেন। তাই হাজার আক্রমণ সহ্য করার পরেও লাপিডের এই বিষয়ে কোনো অনুশোচনা নেই। থাকার কথাও নয় কারণ সত্যিটা যতই তিক্ত হোক কাউকে না কাউকে বলতেই হত, বলতে হয়।
বর্তমানে ইজরায়েলের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে বিপাকে পড়েছেন দুই দেশের প্রধানরাই। লাপিডের বক্তব্যের পর তড়িঘড়ি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য নেমে ইজরায়েল দূতাবাসের প্রধান লাপিডকে তিরস্কার করেছেন। বলেছেন লাপিড দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে হওয়া ইহুদী নিধনের ঘটনায় ফ্যাসিবাদীদের পক্ষে। তিনি কি জানেন যেই ফ্যাসিবাদী শক্তি নিয়ে কথা হচ্ছে সেই হিটলার-মুসোলিনির রাজনীতিতেই উদ্বুদ্ধ হয়ে তৈরি হয়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ – যারাই এখন অলিখিতভাবে ভারতবর্ষকে চালাচ্ছেন, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সমস্ত উচ্চ স্তরের নেতারা এই সংঘেরই সদস্য। জানলে নিশ্চয়ই এই ধরনের রাজনৈতিকভাবে ভোঁতা উপমা ব্যবহার করে লাপিডকে আক্রমণ করতেননা। মাঠে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের দালাল বাহিনীও। লাপিডকে ভারত বিরোধী আখ্যা দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছে কুৎসিত ভাষায়। অনেকটা কৃষক আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের পক্ষ নেওয়া বিখ্যাত গায়িকা রিহানাকে আক্রমণ করার মতো। তবে লাপিডের পক্ষে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয় — ঘটনার দিন থেকে আজ পর্যন্ত বহু মানুষ তাকে ইমেইল করে, মেসেজ করে সাধুবাদ জানিয়েছেন। স্বরা ভাস্কর, প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদী সহ অনেকেই তার পক্ষ নিয়েছেন। পাশে দাঁড়িয়েছেন ফেস্টিভালের অন্যান্য বিচারকরাও — তারা জানিয়েছেন লাপিডের বক্তব্যে কোনো ধরনের মিথ্যাচার নেই, কাশ্মীর ফাইলস আদতেই একটি রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে নির্মিত ছবি। একটা খারাপ ছবি নিয়ে এতগুলো কথা বলার কারণ একটাই — দিনের শেষে যত মানুষই ছবিটা দেখুক বা বাণিজ্যিকভাবে ছবিটা যতটা সফলই হোক না কেন আদতে জনপ্রিয় জিনিস যদি সমাজের স্বার্থে বিপদজনক হয় তবে সেটা নিয়ে সর্বসমক্ষে বলা দরকার, সমালোচনা করা দরকার। তার জন্য কাশ্মীরী পন্ডিতদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় না, তাদের প্রতি হওয়া অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে হয় না। এখনও যারা সবটা জেনে-বুঝেও নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করছেন তাদের জন্য লাপিডের বক্তব্য অনেকটা শিক্ষণীয় — শিক্ষা এটাই নিতে হবে যে বিজেপি মানেই দাঙ্গাবাজ, বিবেক অগ্নিহোত্রী মানেই দালাল আর কাশ্মীর ফাইলস হল গিয়ে একটি নিম্নমানের ছবি — এই কথাটা জোর গলায় বলতে হয়। হাজারটা মিথ্যে, নীরবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও সত্যিটা বলা যায় এখনও।...
– সৌমেন্দু মিত্র