এবছর বিশ্বজুড়ে অসময়ে তীব্র বৃষ্টি, দীর্ঘস্থায়ী বন্যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনকেই কারণ হিসেবে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। এ আলোচনাই এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে মূল আলোচ্যসূচি হয়ে উঠেছিল। গরিব ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর চাপে শেষপর্যন্ত মিশরের শার্ম আল শেখে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত গরিব দেশকে সহায়তা দিয়ে হয় ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ চুক্তি।
তীব্র বৃষ্টি এবং হিমবাহ গলে সৃষ্ট জল পাকিস্তানে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা নিয়ে আসে। জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ বন্যা পাকিস্তানের বিস্তৃর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে; মারা পড়ে ১৭৩৯ জন, ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়ে যায় ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত পাকিস্তান সরকারকে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দ্বারস্থ হতে হয় আন্তর্জাতিক মহলের।
কেবল আফ্রিকাতেই বন্যা এবছর দুই হাজারের মতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে নাইজেরিয়ায়, ছয় শতাধিক। বন্যার কারণে দেশটিতে কলেরার প্রাদুর্ভাবও দেখা দেয়, তাতে মৃত্যু হয় আরও ৬৪ জনের।
জুলাইয়ে ভারতের অমরনাথে মেঘ ভেঙে বৃষ্টিতে সৃষ্ট হঠাৎ বৃষ্টিতে অন্তত ১৬ জন নিহত হন। মে মাসে শুরু হওয়া উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যায় ৩০০’র বেশি মানুষ মারা যান। ক্ষতিগ্রস্ত হন দুই দেশের প্রায় কোটিখানেক মানুষ। মে-জুনে ব্রাসিলের উত্তর-পূর্বে বন্যা-ভূমিধসে শতাধিক নিহত হয়। জুনে আসামের শিলচরে মনুষ্যসৃষ্ট বন্যাও কেড়ে নেয় ২০০’র বেশি মানুষের প্রাণ।
মে, জুলাই, আগস্টে আফগানিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় মারা যান ৬৭০ জন। ব্রাজিলে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রিউ দি জানেইরুর পিত্রোপোলিসে তীব্র বৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যা, ভূমিধস কেড়ে নেয় ৩৬৫ জনের প্রাণ। মে’তে ব্রাজিলের রিসিফের বন্যায় মারা যান আরও ১০৬ জন। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির মূল্য। দাঁড়ায় ৫০০ কোটি অস্ট্রেলিয়ান ডলার। জুলাইয়ের শেষদিকে ইরানে ৩১টি প্রদেশে ছড়িয়ে পড়া বন্যা কেড়ে নেয় আরও ৯৫ জনের প্রাণ।
জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় মৃত্যু ৪ হাজারে কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তীব্র বৃষ্টিকেই মূলত এই বন্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে জুলাই-আগস্টের বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে ৪৪ জন। এবছর বন্যা হয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো মরুপ্রধান দেশেও।
চলতি বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ অংশে ভয়াবহ তাপদাহের দেখা মেলে, সেসময় ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা মধ্যপ্রাচ্যের তাপমাত্রাকে অতিক্রম করে পরিণত হয় বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চলে।
উত্তর আমেরিকায় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাপদাহ শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। এবছর চীনেও জুন-আগস্টে ভয়াবহ তাপদাহ দেখা যায়। জুন থেকে আগস্টে একাধিক তাপদাহে ইউরোপ দেখে বিপুল সংখ্যক মৃত্যু। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্তুগালে ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়।
তাপদাহের কারণে ভারত ১৯০১ সালের পর এবছরই সবচেয়ে উষ্ণ মার্চ মাস পেয়েছে। কাছাকাছি সময়ে পাকিস্তানের নওয়াবশাহ শহরের তাপমাত্রা ছোঁয় ৪৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি। পাকিস্তানের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী শেরি রেহমান সেসময় বছরটিকে ‘বসন্তবিহীন’ বছর বলে অভিহিত করেন। তাপদাহ মে’র প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কেবল সরকারি হিসাবেই দেশ দু’টির ৯০ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
জুনের শেষদিক থেকে জাপানে তাপদাহ শুরু হয়। শেষ হয় আগস্টে। তাপদাহের কারণে দেশটিতে ১৫ হাজারের বেশি লোককে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ইউরোপ চলতি বছর ৫০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বাজে খরা দেখেছে; খরা ভুগিয়েছে উত্তর আমেরিকার দেশগুলোকেও।
আফগানিস্তানে এবছর ৩টি ভূমিকম্প হয়েছে। এরমধ্যে জুনে খোস্তে ভূমিকম্পে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণ যায়। বাকি দুই কম্পন কেড়ে নিয়েছে আরও প্রায় অর্ধশত প্রাণ। নভেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমা জাভায় ৫.৬ মাত্রার ভূমিকম্পে মৃত্যু হয় ৩৩৪ জনের। চীনের সিচুয়ানে ভূমিকম্পে মারা গেছে ১০০’র কাছাকাছি মানুষ।
এবছর পাপুয়া নিউগিনি, মেক্সিকো, জাপান, টোঙ্গা, পেরু, ফিলিপিন্স, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, ভানুয়াতু, নিউ কালাদোনিয়া ও ফিজিতে ৭ বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প দেখা গেলেও এগুলোতে খুব বেশি প্রাণহানি হয়নি।
কলম্বিয়ায় ডিসেম্বরে ভূমিধসে প্রাণ যায় ৩৩ জনের। জানুয়ারিতে ব্রাজিলে পাহাড় থেকে ধসে পড়া পাথর লেকে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকবাহী নৌকায় পড়লে নিহত হয় ১০ জন।
প্রায় ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের কারণে জানুয়ারির শেষদিন ও ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন ইকুয়েডরে একাধিক ভূমিধসে প্রাণ যায় প্রায় ৩০ জনের। জুনে ভারতের মণিপুরে ভূমিধসে মৃত্যু হয় ৫৮ জনের।
ঘূর্ণিঝড় আনা জানুয়ারিতে মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালাউয়ি, জিম্বাবুয়ে ও জাম্বিয়ার ১৪২ জনের প্রাণ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় বাতসিরাই কেড়ে নিয়েছে মাদাগাস্কারের শতাধিক বাসিন্দাকে। মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক ও মালাউয়িতে ঘূর্ণিঝড় গোম্বের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৭২ জনের। এপ্রিলে ফিলিপিন্সে আঘাত হানা মেগি নেয় দুই শতাধিক মানুষের প্রাণ।
ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় তাণ্ডব চালানোয় নোরু’তে ৪০ জনের প্রাণ গেছে। একই মাসে দক্ষিণ আমেরিকা, যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ইয়ানে মৃত্যু হয়েছে দেড় শতাধিক মানুষের।
পরের মাসে মধ্য ও উত্তর আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় দ্বীপের বেশ কয়েকটি দ্বীপদেশকে ভোগানো ঘূর্ণিঝড় জুলিয়ায় প্রাণ যায় ৯১ জনের। অক্টোবরে ফিলিপিন্সে নালগায়ে ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ গেছে ১৬৪ জনের।
এবছর যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপের পাশাপাশি আফ্রিকার মরক্কো, এশিয়ার কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া, পাকিস্তান ও রাশিয়ার সাইবেরিয়ার লাখ লাখ একর জমি পুড়ে গিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশে দেশে বজ্রপাতের পরিমাণও বাড়ছে। এবছর কেবল ভারতেই বজ্রপাতে ৯০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
২০২২’র এই সমস্ত বিপর্যয় বুঝিয়ে দিচ্ছে যে পরিবেশের সঙ্কট সভ্যতার সঙ্কট ডেকে আনছে৷ এই সঙ্কটের পেছনে আছে মুনাফালোভী পরিবেশ অসচেতন নয়া উদারনৈতিক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা। বিশ্বজুড়ে যে পরিবেশ আন্দোলন দেখা যাচ্ছে তা এক বিকল্প নীতির অনুসন্ধান জরুরি মনে করছে। আমাদের পরিবেশ আন্দোলনের বিষয়গুলিকে আত্মস্থ করা, তাতে সামিল হওয়া ও তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে আরো আন্তরিক ও উদ্যমী হতে হবে।
- সৌভিক ঘোষাল