পাঠকের কলম
পাঠকের কলম : লেখার জন্য লেখা নয়, পাঠকের জন্য বস্তুনিষ্ঠ লেখা চাই
not writing for the sake of writing

দেশব্রতীতে (খন্ড ২৯, সংখ্যা ৪৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২২) প্রকাশিত ‘লাচিত বরফুকন ও সংঘ পরিবারের ইতিহাস নির্মাণ প্রকল্প’ শিরোনামে লেখায় সৌভিক ঘোষাল “সরাইঘাট যুদ্ধই লাচিতের জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কীর্তি” বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি লেখার শুরুতে এও বলেছেন যে, “চার শতাব্দী আগের এই সমরনায়ককে নিয়ে ইদানিং বিশেষ করে সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভা আয়োজিত হচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে লাচিত কে ছিলেন, কী তাঁর কীর্তি, সেই নিয়ে এই লেখায় যেমন আমরা কথা বলতে চাইব, তেমনি বুঝতে চাইব বিজেপি ঠিক কোন দৃষ্টিকোণ থেকে লাচিত বরফুকনকে নিয়ে সংস্কৃতির রঙ্গমঞ্চে নেমে পড়েছে।” লেখকের উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাচিতকে নিয়ে নতুন করে ইতিহাস লেখার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁকে হিন্দু বীর প্রমাণেরও প্রয়াস চলছে। কিন্তু খন্ড ইতিহাস রচনা করে কী আসল ইতিহাসকে ধামাচাপা দেওয়া যায়? সংঘ বাহিনী বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি ঠিক তাই করতে চায়। সবক্ষেত্রেই নতুন করে ইতিহাস নির্মাণের নামে খন্ড ইতিহাস তুলে ধরছে নয়তো ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাচ্ছে। এটি না বুঝতে পারলে লেখকের মহান উদ্দেশ্য বানচাল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় একশ শতাংশ।

তাই, সংঘীদের অস্ত্রেই সংঘীদের উন্মোচন না করলে লেখাটির গুরুত্ব যেমন থাকে না, একই সঙ্গে তাদের বক্তব্যকেও খন্ডন করার প্রকল্প ব্যর্থ হয়ে যায়। সৌভিক তাঁর লেখায় সরাইঘাট যুদ্ধের অপর সেনাপতি, ইসমাইল সিদ্দিকি ওরফে বাঘ হাজারিকার কথা একবারও উল্লেখ করেননি। সংঘবাহিনীর তরফে সিদ্দিকির বীরত্বের কথা উল্লেখ করা হবেনা, বা, সিদ্দিকি মুশলিম বীর বলে উল্লেখ করলে লাচিতকে হিন্দু বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করানো যাবে না। এটা তো সংঘের পরিকল্পিত মিথ্যাচার। অর্থাৎ, অন্য কেউ নয়, লাচিতই সরাইঘাট যুদ্ধের আসল নেতা, এটা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তাই তাদের ইসমাইলের ভূমিকাকে নস্যাৎ করার সমান্তরাল প্রচেষ্টা চলছে বলে ইতিহাসবিদরা মনে করছেন। ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলছেন মোগলদের হাতে পরাজিত স্বর্গদেও জয়ধ্বজ সিংহ ঘিলাঝারিঘাটের সন্ধির শর্ত অনুসারে কন্যা রমণী গাভরুকে অওরঙ্গজেবের ছেলে আজমের সঙ্গে বিয়ে দিতে বাধ্য হন। তাঁর নতুন নাম হয় রহমত বানু বেগম। ওই রমণীই মোগল দরবারে কিশোর ইসমাইলের বীরত্ব দেখে তাকে অসমে পাঠান। সে খালি হাতে বাঘ মারায় রাজা জয়ধ্বজের ছেলে চক্রধ্বজ সিংহকে বাঘ উপাধি দেন এবং এক হাজার সেনার নেতা অর্থাৎ ‘হাজারিকা’ করে দেন। সরাইঘাট যুদ্ধে অহোম বাহিনী মোগলদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না। সেই সময়ে বাঘ হাজারি কৌশলে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে মোগল গোলন্দাজেরা ফজরের নমাজ পড়ার সময়ে কামান ছেড়ে নমাজ পড়তে গেলে কামানের ভিতরে জল ঢেলে সেগুলি অকেজো করে দেয়। পরে মোগল বাহিনী কামান থেকে গোলা ছুঁড়তে গেলে ব্যর্থ হয়। অহোম বাহিনী এরফলে উত্তরপার দখল করে। অহোম বাহিনীতে বাঘ হাজারি ছাড়াও লাইধন খাঁ, পেটুয়ার মতো অনেক মুশলিমই যুদ্ধ করেছিলেন।

হিন্দু জাগরণ মঞ্চ যদিও দাবি করেছে বাঘ কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু বাঘ হাজারিকার বীরত্বের কাহিনী সূর্যকুমার ভুঁইঞা, এমএস হাজারিকা, তুলন গোঁহাইদের বইয়ে উল্লেখ আছে। এছাড়াও, ভুবন চন্দ্র সন্দিকৈয়ের বইতেও উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক মুশলিমদের নাম। ইতিহাসবিদরা এও দাবি করেছেন, লাচিত হিন্দু বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে নয়, আসলে নেমেছিলেন দিল্লীর আধিপত্য বিস্তারের বিরুদ্ধে। অসমের বেশ কিছু ইতিহাসবিদও দাবি করেছেন, সরাইঘাট যুদ্ধে লাচিতের কথা আসলে বাঘ হাজারিকার নাম আসবেই।

সুতরাং, লেখার জন্য লেখা না করে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস উল্লেখ করে লেখা না হলে পণ্ডশ্রম হয়ে যায়। লেখাটি যে উদ্দেশ্যে লেখা, তাও পাঠকের কাছে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে এবং উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হয়ে যায়।

- সনাতন মুর্মু, কলকাতা

খণ্ড-29
সংখ্যা-48