সম্পাদকীয়
আর্থিক উন্নয়নের আষাঢ়ে গপ্পো
financial development

রাজ্যের আর্থিক উন্নয়নের আষাঢ়ে গপ্পো শোনালেন রাজ্য মন্ত্রীসভার শিল্পমন্ত্রী শশী পাঁজা। দিল্লীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধি ও চমকপ্রদ বৃদ্ধির রঙিন ছবির এক বিজ্ঞাপন সেখানে তিনি সযত্নে ফেরি করেছেন। তিনি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন ২০২২-২৩-এ রাজ্যের জিডিপি ২২১.৩৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে যা ২০১০-১১’র সাপেক্ষে প্রায় ৩.৭ গুণ বৃদ্ধি! মন্ত্রী জানিয়েছেন, এটা জাতীয় জিডিপি’তে ৫.৮ শতাংশ অবদান রাখবে, আর রাজ্যের জিডিপি ২০১৫-১৬ থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে সিএজিআর’এর (কম্পাউন্ড অ্যানুয়াল গ্রোথ রেট) ১১.৫৪ শতাংশ হারে। সিএজিআর হল একটা সূচক যা দেখায় একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকৃত পুঁজি প্রতিবছরে কতটা বৃদ্ধি পেল।

গল্পের এখানেই শেষ নয়। তিনি জানিয়েছেন, এফডিআই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের প্রথম দশটা রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবাংলাও রয়েছে, যেখানে অক্টোবর ২০১৯ থেকে ২০২২’র মার্চ পর্যন্ত এফডিআই বিনিয়োগের পরিমাণ ১,০৩৪ মিলিয়ন ডলার। অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর, দক্ষ ও প্রতিভাবান মানবসম্পদে সমৃদ্ধ এই রাজ্যটিতে গত দশ বছর ধরে একটিও ধর্মঘট না হওয়ায় ধর্মঘটে শ্রমদিবস পন্ড হওয়ার সংখ্যা শূন্য হয়েছে। এশিয়ার বৃহত্তম কয়লা খনি দেওচা-পাঁচামী তৈরি করছে অবিশ্বাস্য রকমের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের সুযোগ। আর ২৫,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ভিত্তিতে তাজপুরের গভীর বন্দর তৈরি করবে সরাসরি ২৫,০০০ ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে ১ লক্ষ কাজের সম্ভাবনা!

পরিসংখ্যানের এই সমস্ত শুষ্ক তথ্যের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে প্রকৃত সামাজিক উন্নয়নের সূচকগুলো।

জিডিপি’র অঙ্ক যে প্রকৃত আর্থিক বৃদ্ধির সূচক নয়, তা একবাক্যে এখন সমস্ত অর্থনীতিবিদরাই স্বীকার করেন। ভারতে জিডিপি’র চোখ ধাঁধানো বৃদ্ধির বছরগুলোতেই হুহু করে বেড়েছে বেকারি, দারিদ্র, চরম আর্থিক বৈষম্য। গুজরাট হল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সম্প্রতি প্রকাশিত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিসটিক্স অফ ইন্ডিয়ান স্টেটস’ কুড়িটি রাজ্যের তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ১১ বছরে এরাজ্যে দারিদ্র বেড়েছে। কাজের খোঁজে রাজ্য ছেড়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা যে কি বিপুল পরিমাণ, তা লকডাউনের সময়ে চোখে আঙুল তুলে দেখাল। সাম্প্রতিক তথ্য এটাও দেখাচ্ছে যে বর্ধমান-হুগলির মতো উন্নত কৃষি-অঞ্চল থেকেও দলে দলে মজুর অন্য রাজ্যে কাজ ও উন্নত মজুরির সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে। মাননীয় মন্ত্রীর দাবি মেনে নিলেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এই আর্থিক বৃদ্ধি কেন কর্মসংস্থানের সুযোগ এনে দিল না, কেন অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পুরুষ ক্ষেতমজুরদের দৈনিক মজুরিতে এরাজ্য আছে ১৩ নম্বরে। কোভিডের সময়ে এরাজ্যে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের ৯৩ শতাংশই কাজ খুইয়ে ফিরে আসেন, প্রতীচী ট্রাস্টের এক সমীক্ষা থেকে তা বেরিয়ে আসে। ধর্মঘটে শ্রমদিবস খোয়ানো শূন্য হলেও নতুন নতুন কল কারখানা গড়ে উঠল না, রাজ্য সরকার কাগজে কলমে নয়া শ্রমকোড রূপায়ন না করেও সর্বত্র শ্রমের ইনফর্মালকরণ করেছে। ডিএ’র মতো আইনসিদ্ধ অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকদের বেআইনী নিয়োগ এ’রাজ্যের পুতি গন্ধময় রাজনৈতিক পরিমন্ডলকে প্রতিবিম্বিত করে।

গত কয়েক দশক ধরে গুজরাটের নীট রাজ্য জিডিপি ৯ শতাংশের আশে পাশে ঘোরাঘুরি করেছে। রাজ্যের আয় ও আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গুজরাট দেশের অন্যান্য রাজ্যগুলোর সাপেক্ষে প্রথম সারির মধ্যেই পড়ে। কর্মসংস্থানের দিক থেকেও ওই রাজ্য অনেক এগিয়ে থাকলেও মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে গুজরাট অনেক নীচে। নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি গুজরাটে এরাজ্য থেকেও নীচে। নতুন নতুন যে বিনিয়োগের কথা শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, সেখানে ওই সমস্ত উদ্যোগগুলো যে গড়ে উঠবে বিপুল সংখ্যায় শ্রমের ইনফর্মালকরণ ঘটিয়ে, তা তাঁর প্রদত্ত বিবৃতি থেকেই স্পষ্ট।

উন্নয়নী এই গল্পের নটে গাছটা কি মুড়োবে গুজরাট মডেলের পদাঙ্ক অনুসরণ করে? অনাগত দিনগুলোই দেবে তার উত্তর।

খণ্ড-29
সংখ্যা-46