সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের একাদশ পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে বিহারের পাটনাতে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ একটি গণজমায়েতের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হবে ও তারপর ১৬ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ চলবে প্রতিনিধি সম্মেলন। পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি ও কংগ্রেসের সামনে বিদ্যমান রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রশ্নগুলিকে নিয়ে ২৬ ডিসেম্বর ২০২২ এক আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার বিএমপিইউ হলে। এই আলোচনাসভার মুখ্য আলোচক ছিলেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। প্রায় দেড় ঘণ্টার ভাষণে সাধারণ সম্পাদক সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে আলোচনা করেন এইবারের পার্টি কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় বিষয় — ফ্যাসিবাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ও তার মোকাবিলার দিকটি নিয়ে। জাতীয় পরিস্থিতি সংক্রান্ত চর্চা ছাড়াও আলোচনায় আসে আন্তর্জাতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ, ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান, লাতিন আমেরিকায় গোলাপী জোয়ারের দ্বিতীয় তরঙ্গ, চিনের সাম্প্রতিক পার্টি কংগ্রেস ইত্যাদি। সাংগঠনিক বিষয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকও আলোচনায় উঠে আসে।
আলোচনার বিভিন্ন দিকগুলিকে আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করছি।
ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিকে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন হিসেবে সিপিআই(এমএল) চিহ্নিত করেছে। ভারত রাষ্ট্রের পুরোপুরি ফ্যাসিবাদীকরণ হয়ে গেছে এটা বলা না গেলেও প্রবণতাটা সেদিকেই। এটা ক্রমেই বেশি বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। অনেকে ফ্যাসিবাদকে যান্ত্রিকভাবে দেখেন। হিটলারের সময় ষাট লক্ষ ইহুদি নিধনের মতো কিছু এখানে হচ্ছে কিনা, বিপর্যয় সেই স্তরে হলে তবে তাকে ফ্যাসিবাদ বলা যাবে — এভাবে দেখাটা যান্ত্রিকভাবে দেখা।
ফ্যাসিবাদের পরিপ্রেক্ষিতটা ভালোভাবে বোঝা দরকার। বুঝতে পারলে তবেই তার প্রতিরোধের রাস্তাটা বের করা সম্ভব হবে।
এটা মনে রাখতে হবে ফ্যাসিবাদ একটি আধুনিক প্রবণতা। উনিশশো কুড়ির দশকে ইতালিতে তার প্রথম উত্থান ও বিকাশ। ফ্যাসিবাদকে অতিরাষ্ট্রবাদ বলা যায়। রাষ্ট্র এখানে এমনভাবে জাঁকিয়ে বসে যে সে সমাজ ব্যক্তি সবকিছুকে তীব্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে।
পুঁজিবাদের প্রথম দিকে রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে, সামন্তী অভিজাততন্ত্রর বিরুদ্ধে যে প্রগতিশীল চরিত্র ছিল ক্রমশ সেটা সে হারায়। সে বোঝে তার মুনাফার জায়গা সমাজতান্ত্রিক উত্থানের যুগে কমছে। ১৯১৭তে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও ১৯২২-এ ইতালিতে ফ্যাসিবাদের উত্থান কাছাকাছি সময়ের ঘটনা। সমাজতন্ত্রের ভয় থেকে পুঁজিবাদীরা অনেকেই ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদকে মদত দিতে থাকেন।
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক ১৯১৯-এ তৈরি হওয়ার পর থেকেই বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে নিবিড়ভাবে চর্চা করত। ইতালির ফ্যাসিবাদ নিয়েও সেখানে চর্চা হয় ও ফ্যাসিবাদকে দেখার প্রশ্নে সেখানে নানা মত ছিল। ইতালিতে গ্রামশি ফ্যাসিবাদের বিপদকে খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। তবে প্রথমে গ্রামশিরও মনে হয়েছিল ফ্যাসিবাদ কৃষিভিত্তিক বুর্জোয়াদের ব্যাপার। শিল্পভিত্তিক বুর্জোয়ারা এটা মানবে না এরকম একটা ধারণা গ্রামশি করেছিলেন। কিন্তু সেটা ইতালিতে হয়নি। পরে জার্মানিতেও তা হয়নি। গোটা শাসক শ্রেণি, কৃষিভিত্তিক বুর্জোয়া ও শিল্পক্ষেত্রের বুর্জোয়া সবাই ফ্যাসিবাদ, নাজিবাদের পক্ষে দাঁড়ায়।
ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রকে কাজে লাগিয়ে হামলা করে কিন্তু ফ্যাসিবাদকে বিশ্লেষণ করার সময় মাথায় রাখতে হবে যে শুধু আক্রমণ আগ্রাসনের মধ্যে দিয়ে ফ্যাসিবাদ এগোয়নি। নানা সামাজিক উন্মাদনাকে সে তার পক্ষে কাজে লাগায়। শুধু রাষ্ট্র দিয়ে ফ্যাসিবাদকে বোঝা যাবে না। সমাজ সংস্কৃতি দিয়েও তাকে বুঝতে হবে।
ফ্যাসিবাদের প্রথম তরঙ্গের সময়েই ভারতে আরএসএস’এর প্রতিষ্ঠা। ১৯২২-এ ইতালিতে মুসোলিনি ক্ষমতায় আসেন আর ভারতে আরএসএস’এর প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৫ সালে। আরএসএস’এর কাছে ভারত মানে হিন্দুর ভারত। হিন্দু সুপ্রিমেসি, সেনাবাহিনীর হিন্দুকরণ, হিন্দুদের সামরিকীকরণ — এগুলো আরএসএস শুরু থেকেই করতে চেয়েছিল। এই প্রথম তরঙ্গের কথা বাদ দিয়ে যেমন আজকের আরএসএস বা আজকের ফ্যাসিবাদকে বোঝা যাবে না, তেমনি শুধু সেকালের ইতালি বা জার্মানির অভিজ্ঞতা দিয়েও আজকের ভারতের ফ্যাসিবাদকে পুরোটা বোঝা যাবে না। এটা বুঝতে হলে গত তিরিশ বছরে বিশ্ব ও ভারতীয় রাজনীতির যাত্রাপথটা বুঝতে হবে।
সোভিয়েতের পতন, দক্ষিণপন্থার অভ্যুত্থান, বামপন্থার পেছনে হটা — এগুলো ফ্যাসিবাদের এই পর্বের বিকাশে বড় ভূমিকা রয়েছে নিয়েছে। এরসঙ্গেই রয়েছে নিও লিবারাল পুঁজিবাদ, যা খানিকটা চিন ছাড়া সর্বত্র প্রায় একই রকম দাপটে সামনে রয়েছে। এরসঙ্গে ভারতে রয়েছে বাবরি ভাঙা, গুজরাট দাঙ্গা সহ আগ্রাসী হিন্দুত্বর রাজনীতি। এই সবকিছুর সংমিশ্রণে মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছে ও তার শক্তি সংহত ও বৃদ্ধি করছে।
ভারতে নিও লিবারাল জমানা শুরুর পর বিভিন্ন পাবলিক সেক্টরের ওপর প্রথম হামলা নেমেছে। সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণি — রেল, ব্যাংক, বীমা কর্মীরা এই হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করেছেন।। ক্রমশ দেখা গেল আক্রমণ নেমেছে কৃষকের ওপরও। আমাদের দেশে এখনো শ্রমিকের ওপর আক্রমণের চেয়ে কৃষকের ওপর আক্রমণ বেশি প্রভাব ফেলে। কৃষক আত্মহত্যা ও গুজরাট গণহত্যা ২০০৪-এ সরকার পরিবর্তনের পেছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল।
২০০৪-এ ইউপিএ প্রতিষ্ঠিত হবার পর বেশ কিছু সংস্কার আনা হয়। অধিকারের পক্ষে কিছু কিছু আইন হল। কমন ম্যানের কথা হল। তবে অনেক রাজনৈতিক প্রশ্নে, গুজরাট দাঙ্গা ও আগ্রাসী হিন্দুত্বকে মোকাবিলার প্রশ্নে তেমন কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। যেটুকু অর্থনৈতিক সংস্কার ইউপিএ করেছিল তা কর্পোরেট শক্তির পছন্দ হয়নি। ২০১৪-তে ভাইব্রান্ট গুজরাট স্লোগান সামনে রেখে মোদীকে কর্পোরেটরা ক্ষমতায় নিয়ে আসে।
অনেকে আজকের ফ্যাসিবাদ ও জরুরি অবস্থার সময়কার অবস্থার মধ্যে তুলনা করেন। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে দমনের দিক থেকে কিছু মিল থাকলেও কিছু মৌলিক ভিন্নতা আছে। স্বৈরতন্ত্র নিজেদের শাসনকে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সমাজকে ওলোট পালট সে করে না। ফ্যাসিবাদ কিন্তু শাসনকে চাপানোর পাশাপাশি সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি, মতাদর্শ সবকিছুকে পালটে নিজের মতো করে নিতে চায়। কমিউনিস্টরা যেমন পার্লামেন্টারি ও এক্সট্রা পার্লামেন্টারি স্ট্রাগেলের কথা বলে, ফ্যসিস্টরাও উল্টোদিক থেকে তাই করে। আইন কিছু করা হয়। আইনকে সামনে রেখে তাদের শক্তিবৃদ্ধিতে সহায়ক এমন সামাজিক আন্দোলন তারা গড়ে তোলে। প্রতিবিপ্লব ও বিপ্লব অনেক সময় রূপের দিক থেকে একভাবে কাজ করে। তবে তাদের অন্তর্বস্তু সম্পূর্ণ বিপরীত।
ফ্যাসিবাদ ক্লান্ত হয়ে নিজে থেকে চলে যাবে এমন নয়। আমরা এর বিরুদ্ধে যতটা লড়তে পারব সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটা বোঝা দরকার ফ্যাসিবাদকে বিপ্লবী বামেদের পক্ষে এককভাবে হারানো সম্ভব নয়। অনেকেই বিজেপি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই সমস্ত প্রতিবাদ আংশিক প্রতিবাদ। কেউ আরএসএস’এর কথা বলে না। কেউ আদানি আম্বানির কথা বলতে রাজি নয়। এমনকি বামেদেরও এই নিয়ে মতৈক্য নেই। এই মুহূর্তের কেন্দ্রীয় প্রশ্ন ফ্যাসিবাদ বিরোধিতা। এই নিয়ে মতের ও বোঝাপড়ার অমিল বলেই বাম ঐক্যের জায়গাটা দুর্বল হয়ে আছে।
নির্বাচন দিয়ে ফ্যাসিবাদকে হারানো যাবে কী যাবে না — এটা বড় প্রশ্ন নয়। এখানে ফ্যাসিবাদ নির্বাচনে জিতে জিতেই ক্ষমতায় থাকতে চাইছে এটা দেখা যাচ্ছে। ফ্যাসিবাদকে হারাতে নির্বাচন, নির্বাচনের বাইরের লড়াই — যা যা করার আছে তা করতে হবে। আইনি দিক যতটা আছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এরই সঙ্গে আমাদের বড় আন্দোলনগুলোর মধ্যে থাকতে হবে এবং বিভিন্ন আন্দোলনগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে হবে।
আম্বেদকর বলেছিলেন ভারত হিন্দুরাজ হলে তার চেয়ে বড় বিপর্যয় আর হতে পারে না। এটা ব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা লাঞ্ছিত দলিতদের অভিজ্ঞতার জায়গা থেকে আম্বেদকর বলেছিলেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে মানুষকে বাঁচানোর কাজ করি। তারপর আক্রান্তকে রিলিফ দিতে চাই। তারপর পুনর্গঠনের প্রশ্নটা আসে। ভূমিকম্প বা ঝড় প্রতিরোধী নির্মাণের প্রযুক্তির কথা আসে। ফ্যাসিবাদের প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও পদ্ধতি ও পর্যায়গুলো এরকম। ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করা ও ফ্যাসিবাদের পুনরাবর্তনকে আটকানোর জন্য আরো উন্নত গণতন্ত্র তৈরির কথাটা আসে। শেষপর্যন্ত কথাটা জনগণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের প্রসঙ্গেও যায়।
আমদের ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইকে সার্বিক, সর্বাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী করতে হবে। এই প্রসঙ্গে অন্য বুর্জোয়া পার্টিগুলো তো বটেই, এমনকী বামপন্থী অন্যান্য দলের থেকেও আমাদের কিছু কিছু পার্থক্য থাকবে।
সাধারণ সম্পাদক জানান ভারতের ফ্যাসিবাদের নয় বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে তার মোকাবিলার রাস্তা নিয়ে কিছু কথা থাকবে দলিলে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলোচনা প্রসঙ্গে সাধারণ সম্পাদক বলেন যে চিনে কতগুলো বিষয় বাড়ছে। দীর্ঘদিন তারা মূলত অর্থনীতি নিয়েই ভাবছিল। বিদেশ নিয়ে সে চুপ থেকে বাণিজ্যের প্রশ্নে সক্রিয় থাকত। এখান থেকে সরে চিনের বিদেশনীতির সক্রিয়তা এখন বাড়ছে। আমেরিকা ও ন্যাটো অক্ষের বিরুদ্ধে সে রাশিয়ার কাছাকাছি থাকার বার্তা দিচ্ছে। ভারতের কিছু কিছু জায়গাও সে দখল করছে বলে অভিযোগ। তার সম্প্রসারণবাদ দেখা যাচ্ছে।
চিনে সোশালিজম উইথ চাইনিজ ক্যারেক্টারিসটিক্স’কে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন দিয়ে বোঝার চেষ্টা রয়েছে। পার্টিতেও একসুরে সব বাঁধা, সাধারণ সম্পাদকের অন্তহীন ক্ষমতা এগুলো দেখা যাচ্ছে। চিনকে ক্যাপিটালিজম উইথ চাইনিজ রেক্টারিসটিক্স বলা যায়।
লাতিন আমেরিকায় বামেদের বিজয় আমাদের কাছে নানা দিক থেকে উৎসাহব্যঞ্জক। সেগুলোর কথা বিস্তারিতভাবে দলিলে থাকবে।