হিমাচল প্রদেশ ও গুজরাট বিধানসভা এবং দিল্লী পুরসভা নির্বাচনের ফলাফলের জন্য আমরা যখন অপেক্ষা করে আছি তখন এই নির্বাচনগুলোতে বিজেপির চালানো প্রচারের গভীরে দৃষ্টিপাত করলে তা শিক্ষামূলক হবে।
হিমাচল প্রদেশে যথেষ্ট মাত্রায় অভ্যন্তরীণ বিবাদের মুখোমুখি হয়ে মোদী খোলাখুলিভাবে নির্বাচকমণ্ডলীকে বললেন –প্রার্থী কে তা দেখার দরকার নেই, তাঁরা যেন তাঁকেই ভোট দেন। দিল্লী পুরসভার নির্বাচন মোদী সরকারের ক্ষমতার এক নির্লজ্জ চাল হয়েই দেখা দিল। কেন্দ্রীয় পদক্ষেপে আগের তিনটি কর্পোরেশনকে মিলিয়ে একটা করার মধ্যে দিয়ে পুর নিগমের পুনর্গঠন, ওয়ার্ডগুলোর সুপরিকল্পিত পুনর্বিন্যাস এবং সহসাই নির্বাচনী নির্ঘন্ট ঘোষণা করে গুজরাট নির্বাচনের সময়েই তার অনুষ্ঠান – এই গোটা নির্বাচনী প্রক্রিয়াটাই বিজেপির দুরভিসন্ধিমূলক কৌশলের এক নিদর্শন। আর গুজরাটে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে মিল দেখা গেল ২০০২-এর গণহত্যা-পরবর্তী পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের সঙ্গে যখন নরেন্দ্র মোদী গোধরা-পরবর্তী গুজরাট গণহত্যাকে ‘গুজরাট গৌরবে’ পরিণত করেছিলেন।
২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার দু-দশক পর আমরা অমিত শাহকে – যিনি বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী – তাঁর নির্বাচনী বক্তৃতায় ঐ গণহত্যাকে সমর্থন করতে দেখলাম। তিনি বললেন, দাঙ্গাকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যার ফলে গুজরাটে ‘স্থায়ী শান্তির’ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাঁর এই বক্তৃতা এল লাগাতার কয়েকটি বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্ত, প্রশাসনিক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সংকেতের পথ ধরে যেগুলো ইতিমধ্যেই ন্যায়বিচারের স্বার্থের যথেষ্ট হানি ঘটিয়েছিল। জাকিয়া জাফরির আবেদন খারিজ হয়ে গিয়েছিল; সত্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং ন্যায়বিচার চাওয়ার প্রয়াসের জন্য তিস্তা শিতলবাদ ও আর বি শ্রীকুমারকে জেলে পোরা হয়েছিল; বিলকিস বানো মামলায় ধর্ষণ ও হত্যায় দোষী সাব্যস্তদের ভারতের স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীতে মুক্তি দেওয়া ও সংবর্ধিত করা হয়েছিল; গণহত্যায় এক দোষী সাব্যস্তর পরিবারের এক সদস্যকে নারোদা বিধানসভার বিজেপি প্রার্থী করা হয়েছিল, আর সুপ্রিম কোর্ট ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার সঙ্গে যোগ থাকা মামলাগুলোকে সমাপ্ত করে দিয়েছে, ২০০২-এর যে গুজরাট গণহত্যার নটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় তদন্ত করা ও মামলা চালানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট নিজেই একটা বিশেষ তদন্তকারী দল নিয়োগ করেছিল।
গণহত্যার মধ্যে দিয়ে গুজরাটে ‘স্থায়ী শান্তি’ প্রতিষ্ঠার অমিত শাহর দাবিকে শুধু ‘অতীতের একটা কীর্তির মহিমাকীর্তন’ রূপে দেখলেই হবে না, বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতের সঙ্গে মিলিয়েও তাকে দেখতে হবে। সংঘ বাহিনী যেমন সারা ভারতেই ১৯৯২ সালের অযোধ্যার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায়, ঠিক তেমনই এই ব্যাপারেও আমাদের সুস্পষ্ট থাকতে হবে যে, ‘স্থায়ী শান্তির’ গুজরাট সূত্রকেও তুলে ধরা হচ্ছে ‘সারা দেশের সুফলের’ জন্য! নরসিংহানন্দ-এর মতো ব্যক্তিরা রাখঢাক না করেই গণহত্যার ডাক দেন, আর বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ ও মোদীর মন্ত্রীরা সেটা করে থাকেন তাঁদের নিজস্ব ধারায়।
অমিত শাহ ‘দাঙ্গাকারীরা’ বলতে দাঙ্গার শিকার মানুষজনদের বুঝিয়েছেন আর ‘দাঙ্গাকারীদের উচিত শিক্ষা দেওয়া’টা ঠাণ্ডা মাথায় গণহত্যা ও ধর্ষণ সংঘটনের কথাই জানায়, এবং ‘স্থায়ী শান্তি’ হল সংঘের সেই সংকেতময় শব্দ যা আতঙ্ক সৃষ্ট নীরবতা এবং শ্মশানের গা-ছমছম করা শান্তির কথা বলে। আর এখন এটা একেবারেই পরিষ্কার যে নীরবতার এই বিধান দেওয়া হচ্ছে প্রতিটি বিরোধী মতের উদ্দেশ্যে, সত্য ও ন্যায়বিচার চাওয়া প্রতিটি ব্যক্তিকে ভীতিপ্রদর্শন করা ও নির্যাতনের শিকার করে তোলার জন্য।
অমিত শাহর ‘স্থায়ী শান্তি’ সূত্রর চেয়ে কোনো অংশেই কম জানান দেয় না চিত্রাভিনেতা ও পূর্বতন বিজেপি সাংসদ পরেশ রাওয়ালের গুজরাটের নির্বাচনী প্রচারে ‘মাছ রান্না করা’ নিয়ে সাংকেতিক রাজনৈতিক বার্তা। এক নির্বাচনী বক্তৃতায় রাওয়াল বললেন, গুজরাটিরা জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি এবং কর্মহীনতা সহ্য করতে পারে, কিন্তু তারা কখনই বাঙালিদের জন্য মাছ রান্না করবে না। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠার পর রাওয়াল ‘বুঝিয়ে বললেন’ যে বাঙালি বলতে তিনি সলে রোহিঙ্গা ও বাঙলাদেশীদেরই বুঝিয়েছিলেন!
এটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ উস্কিয়ে তুলে মূল্যস্ফীতি ও বেকারির বিরুদ্ধে জনগণের ক্রোধের মোকাবিলায় সংঘ-বিজেপির প্রয়োগ করা আখ্যানের একটা মার্কামারা দৃষ্টান্তকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে, আর জনগণের মধ্যে বিরাজমান সমস্ত ধরনের প্রভেদের ওপর ভিত্তি করেই ঐ প্ররোচনা সৃষ্টি করা হয়, তা সে ধর্ম, খাদ্যাভ্যাস, ভাষা বা সংস্কৃতি যে প্রভেদই হোক না কেন। আজকের গুজরাটে মোরবী সেতু ভেঙে পড়াটা যখন বিজেপির দুর্নীতিপরায়ণ ও নির্মম উদাসীন মডেলের প্রশাসনেরই এক গ্লানিময় প্রতীক হয়ে উঠেছে, শাহ ও রাওয়ালরা তখন প্রশ্নহীনভাবেই জানিয়ে দিচ্ছেন যে বিজেপি জনগণকে শুধু ঘৃণা, হিংসা ও প্রচারের চটকই উপহার দিতে পারে।
এছাড়া, মোদীর ব্যক্তি পূজাকে কেন্দ্র করে চলছে প্রচারের নিরবচ্ছিন্ন ঝড়। হিমাচল এবং গুজরাট দুই রাজ্যেই বিজেপির প্রচারের বিষয়বস্তু হয়েছে মোদীর নামে ভোট চাওয়া। এমনকি মোরবী সেতুর ভেঙে পড়াটাকেও বিজেপি সরকার মোদীর ঢক্কানিনাদিত মোরবী পরিদর্শনকে প্রচারের একটা বিষয় করে তোলে। নিজের ভোটদানকেও মোদী একটা রোড-শোর মাধ্যমে প্রচারের বিষয় করে তোলেন এবং তার মধ্যে দিয়ে আদর্শ নির্বাচনী বিধিকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়। আর বিজেপি যাতে নির্বাচনী বিধির প্রতিটি নাশকতা ও সেগুলিকে অগ্ৰাহ্য করা থেকে পার পেয়ে যায় তার জন্য ক্ষমতাসীন সরকার বাছাবাছা বশংবদ আমলাদের সন্দেহজনক পথে নির্বাচন কমিশনার রূপে নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশনকেই নীরব দর্শকে পর্যবসিত করতে চায়।
এই নির্বাচনগুলোকে তাই নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে নিজেদের সুবিধায় কাজে লাগানো ও সেগুলোকে সম্পূর্ণ প্রহসনে পরিণত করার মোদী সরকারের ক্রমবর্ধমান মরিয়া প্রয়াসের সুস্পষ্ট বিপদসংকেত হিসাবেই দেখতে হবে। নিপীড়ন ও লুন্ঠনের এই রাজত্বের অবসান ঘটাতে নির্বাচনগুলোকে আমাদের পরিণত করতে হবে জনগণের শক্তিশালী আন্দোলনে, যেমনটা এখন ঘটছে লাতিন আমেরিকায়।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ৬ ডিসেম্বর ২০২২)