প্রতিবেদন
অনলাইন (সাইবার) প্রতারণার অপরাধীরা কি শাসক দলের তহবিলে অর্থের অন্যতম যোগানদার?
contributors to the funds of the ruling party

মেসেজ এল, আপনার গতমাসের বিদ্যুতের বিল অনাদায়ী থাকার কারণে আজ সন্ধের মধ্যে তা না দিলে বিদ্যুত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এরথেকে পার পেতে চাইলে ৬২৯০৩২৬০৭৭ নাম্বারে ফোন করুন। ফোন করলাম, ফোন ব্যস্ত। একটু বাদে ফোন এল ৬২৯১৫৮৭২৩ নাম্বার থেকে। বলল ইলেকট্রিসিটি অফিস থেকে বলছি, আপনি তো একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললাম, এই নাম্বারে করিনি তো। জানাল, ওই একই অফিস। আপনার বিদ্যুতের বিল দেননি বলে মেসেজ গিয়েছিল তো। জানতে চাইল, কীভাবে বিদ্যুত বিল দেই। বললাম, অনলাইনে। বলা হল, আপনি আপনার কজিউমার নাম্বার বলুন। জানালাম, সেটা তো এরকম মনে থাকে না। প্রায় হুকুমের সুরে বলল, আপনি অনলাইনে বিল দেন আর কাস্টমার আইডি মনে থাকে না? আমি বললাম, আপনার কনজিউমার নাম্বার বা কাস্টমার আইডি মনে আছে? বলল, ইলেকট্রিক বিলে লেখা আছে দেখে বলুন। আমি প্রশ্ন করলাম, আমাকে মেসেজ করেছেন আমি বিল দেইনি বলে, আর আপনি কনজিউমার নাম্বার বা কাস্টমার আইডি জানেন না? ব্যাস, গালাগালি দিয়ে ফোন রেখে দিল। যদি কাস্টমার আইডি জানাতাম, তাহলে কথা চলত, অনাদায়ী বিদ্যুত বিলের একটা পরিমাণ বলা হত। তাড়াতাড়ি কিছু টাকা দিয়ে বিদ্যুত যোগাযোগের বিচ্ছিন্নকরণ আপাতত রুখে দেওয়ার জন্য একটি লিংকে ক্লিক করতে বলা হত। ক্লিক করলে ফোনের নিয়ন্ত্রণ চলে যেত মেসেজ পাঠানো মানুষগুলির কাছে। সেই নিয়ন্ত্রণ ব্যবহার করে ব্যাঙ্ক একাউন্ট বা ক্রেডিট কার্ড একাউন্ট থেকে টাকা অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হত। এরকম খবর প্রতিনিয়তই দেখছেন খবরের কাগজে। কেবল এভাবেই নয়, বিভিন্নভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ডিজিটাল মাধ্যমে প্রতারণা করা হচ্ছে।

দেশজুড়ে স্বল্পবিত্ত মানুষজনকেও ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেনে উৎসাহিত করা চলছে। পাঠকেরা অনেকেই জিপে, ফোনপে, পেটিএম, হোয়াটসএ্যাপপে ব্যবহার করেন — এগুলি ইউপিআই ভিত্তিক লেনদেন। দেশের বহু ছোটবড় দোকানে ইউপিআই পেমেন্টের জন্য কোড লাগানো থাকে যা স্ক্যান করে টাকা দেওয়া যায়, বহু লোকে দেন। সেই বন্দোবস্তে যে প্রতারণা হয় তা রিজার্ভ ব্যাঙ্কও স্বীকার করছে। বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে যাতে সাধারণ মানুষ প্রতারণা স্বীকার না হন। কিন্তু প্রতারিত মানুষজন তাদের অর্থফেরত পাচ্ছেন খুব কম ক্ষেত্রেই। গত দু’টি ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ও জুলাই-সেপ্টেম্বর, ২০২২) কেবল ইউপিআই মাধ্যমে লেনদেনে একলক্ষ চল্লিশ হাজার প্রতারণা হয়েছে। মে, ২০২২-এ ইউপিআই মাধ্যমের লেনদেনে ২০০ কোটি টাকার প্রতারণা হয়েছে। সরকারি সাইবার অপরাধ দফতরের তথ্য অনুসারে কেবল ওই মাসেই ৬১,১০০টি ডিজিটাল লেনদেন সংক্রান্ত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, যারমধ্যে অর্ধেক ইউপিআই লেনদেনের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এগুলির শিকার যারা হয়েছেন, তাঁদের কজন টাকা ফেরত পেয়েছেন? যার টাকা যাচ্ছে তিনি একজন বিচ্ছিন্ন প্রতারিত মানুষ হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। সরকার, ব্যাঙ্ক, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, পেমেন্ট এ্যাপের প্রতিষ্ঠান, পুলিশ কারুর কোনো আইনি দায় নেই প্রতারিত সাধারণ মানুষ বা আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়ার।

বেশ কিছুদিন ধরেই এদেশে ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন চালু হয়েছে। বর্তমান মোদী সরকার সারা দেশকে ডিজিটাল বন্দোবস্তে জোড়ার জন্য উদগ্রীব। সেটা জুড়তে পারার কৃতিত্বের দাবিদার হয়ে উঠতে বহু ধরনের প্রচার চালানো হচ্ছে। যদিও দেশে স্মার্টফোনের চল হয়েছে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের হাত ধরে এবং ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন তৈরি হয়েছিল মনমোহন সিংহের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে এপ্রিল ২০০৯-এ। রঘুরাম রাজন গভার্নার থাকাকালীন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উদ্যোগে ন্যাশনাল পেমেন্ট কর্পোরেশন ইউপিআই বা ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস নামক প্রযুক্তি তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা করে, যা শেষ পর্যন্ত চালু হয় ২০১৬ সালে মোদী সরকারের আমলে। ইউপিআই ভারতে তৈরি প্রযুক্তি যার রূপ হল, ভিম-ইউপিআই, গুগলপে, ইয়োনোপে, ফোনপে জাতীয় বিভন্ন এ্যাপ, যার মাধ্যমে ওই এ্যাপের ব্যবহারকারী অনুরূপ এ্যাপের ব্যবহারকারীর কাছে টাকা পাঠাতে পারে।

২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে মোদী সরকার ১০০০ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট মাত্র ৪ ঘণ্টার নোটিশে বাতিল করে কালো টাকা দূর করার মিথ্যা আশ্বাস দেয়। কালো টাকা যথা পূর্বং থাকলেও গরিব শ্রমজীবী মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অপূরণীয় ক্ষতি করতে সক্ষম হয় নোট বাতিলের কর্মসূচি। মনে হয়, নোট বাতিলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল ক্ষুদ্র অসংগঠিত ব্যবসায়গুলিকে দুর্বল ও ধ্বংস করা, যেকাজে নোট বাতিল বহুলাংশে সফল হয়েছে ও কর্পোরেট দুনিয়া বিশেষত কতিপয় সাঙ্গাত পুঁজিপতিকে অতীব শক্তিশালী করে তুলেছে। কর্পোরেটদের হাতে দেশের অর্থনীতিকে তুলে দেওয়ার অন্যতম কারসাজি হল জনসাধারণকে ডিজিটাল লেনদেনে আকৃষ্ট করে তোলা। সেই কাজও অনেকটা করতে সক্ষম হয়েছে মোদী সরকার। মনে রাখা দরকার, ৮ নভেম্বর ২০১৬ সালে নোট বাতিলের পরের দিন, ৯ তারিখে খবরের কাগজের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন ছিল পেটিএম’এর, মোদীজির ছবি সমেত। কোনো দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ব্যক্তিমালিকানাধীন কোনো ব্যবসায়ে বিজ্ঞাপন করেছেন বলে জানা নেই, অন্তত ভারতের কোনো প্রধানমন্ত্রী এমনটা করেননি।

পেটিএমের বিজ্ঞাপন দিয়ে যার শুরু, ডিজিটাল লেনদেনের প্রসার ও প্রচার, তা ক্রমাগত বাড়িয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে ধারাবাহিক প্রচার করে চলেছে মোদী সরকার। ভারতকে ডিজিটাল ইন্ডিয়া বানাতে হবে। একদিকে ভারতীয় সংস্কৃতির আবাহনের নামে, প্রাগৈতিহাসিক কুসংস্কারে দেশকে আচ্ছন্ন করা অপরদিকে আর্থিক লেনদেন করার জন্য ডিজিটাল ব্যবস্থায় উৎসাহ প্রদান। ফলে সাধারণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষজন অবলীলাক্রমে ডিজিটাল প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে। মনে রাখা দরকার, ধর্মীয় কুসংস্কারে বিশ্বাসীরা হোয়াটসএ্যাপ, এসএমএসে আসা সংবাদকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে থাকে কারণ অন্ধ বিশ্বাসেই তাদের আনন্দ।

কম্পুটার, বা স্মার্টফোন, মোবাইল ফোনে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বা তথ্য কীভাবে থেকে যায়, যার অস্তিত্ব ফোন বা কম্পুটারের ব্যবহারকারী জানেন না, সে বিষয়ে কোন ধারণাই আমাদের নেই। একটি স্মার্টফোন আমার হাতে থাকেলেও তার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে প্রতারক দখল করতেন পারে জানিই না আমরা। ব্যাঙ্ক বা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক উপভোক্তাকে সাবধান করলেও যে তিনি সাবধান হতে শেখেন না সেবিষয়ে কি সরকার অবহিত নয়? ফলে যত ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে তত প্রতারণাও বাড়ছে।

দেখেশুনে মনে হয়, সরকার, পুলিশের অপদার্থতা ও নিষ্ক্রিয়তার জন্যই এই ধরণের অপরাধের বাড়বাড়ন্ত। এই অপরাধীদের সঙ্গে শাসকদের, পুলিশের বোঝাপড়া আছে কি? কে জানে। নাহলে তো, অনায়াসেই এই অপরাধীদের ধরা পড়ার কথা। প্রথমে শুরু হওয়া প্রতারণার প্রচেষ্টার কথা ধরা যাক। যে ফাোন থেকে এসএমএস এসেছিল তা ভারতীয় নাম্বার, যে ফোন থেকে ফোন এসেছিল সেটি ভারতীয় নাম্বার। তাহলে ওই নাম্বারের অধিকারীদের খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। সকলেই জানেন যে, এদেশে ফোন পেতে গেলে মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারীদের কাছে নিজের সম্পূর্ণ পরিচয় প্রদান করেই তা পেতে হয়। ফলে ওই পরিষেবা প্রদানকারীদের কাছ থেকে পুলিশ অনায়াসে ওই মোবাইল ফোন নাম্বারের অধিকারীদের ধরতে পারে। যদি এমনটা হয় যে ওই নাম্বারের অধিকারীদের পরিচয় পরিষেবা প্রদানকারী দিতে পারছে না, তাহলে সেই পরিষেবা প্রদানকারীকেই ওই প্রতারণার জন্য অবশ্যই দায়ী করা যেতে পারে। সেব্যাপারে সরকার কেন আইনি বন্দোবস্ত করছেনা। যেখানে ছ’মাসে দু’লাখ প্রতারণার ঘটনা ঘটছে, একমাসে চার-পাঁচশ কোটি টাকার প্রতারণা করা হচ্ছে, সেইসব অপরাধ ও অপরাধীকে ধরার ক্ষেত্রে সরকার ও পুলিশ এত নিরুত্তাপ কেন?

দ্বিতীয়ত, সাইবার অপরাধ বা ডিজিটাল লেনদেন জনিত অপরাধের ক্ষেত্রে যে ব্যক্তির কাছে টাকা যাচ্ছে তা ব্যাঙ্কিং লেনদেনের গতিকে অনুসরণ করলেই জানা যায়। যে ব্যাঙ্ক খাতায় (একাউন্টে) টাকা যাচ্ছে তার পরিচিতিও ব্যাঙ্কের কাছে থাকা বাধ্যতামূলক। সারা বছর সাধারণ মানুষের কাছে নো ইয়োর কাস্টমার (কেওয়াইসি) তথ্য ও কাগজপত্তর চেয়ে চলেছে ব্যাঙ্কগুলি। তাহলে ওই সকল প্রতারক হিসেব খাতাগুলির মালিকদের খুঁজে বের করতে পুলিশ সক্ষম হয় না কেন? নাকি ওই সব অপরাধীদের সঙ্গে পুলিশ, শাসকের বোঝাপড়া আছে? ওই প্রতারকরা কি শাসকের নির্বাচন তহবিলের অন্যতম যোগানদার?

- অমিত দাশগুপ্ত

খণ্ড-29
সংখ্যা-48