সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন দেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রশ্নে বড়ো ভূমিকা নিয়েছে। আগামীদিনে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী হামলা প্রতিরোধে সেটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে মহারাষ্ট্রের পুনেতে সম্পন্ন হ'ল কিষাণ মহাসভার জাতীয় কার্যকরী সমিতির বৈঠক। গত অক্টোবরের শেষে বিক্রমগঞ্জে কিষাণ মহাসভার (এআইকেএম) ৭ম জাতীয় সম্মেলনের পর ১৯-২০ ডিসেম্বর পুনে শহরে অনুষ্ঠিত হল সংগঠনের নবগঠিত জাতীয় কার্যকরী সমিতির প্রথম বৈঠক। বৈঠকে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও কৃষক আন্দোলনের সাম্প্রতিক গতি প্রকৃতির ওপর বিস্তৃত আলোচনা হয়। স্থির হয়, সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার শরীক সংগঠন রূপে এআইকেএম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সাথে সাথে মোর্চার অন্তর্গত এবং মোর্চার বাইরে থাকা বিভিন্ন সংগ্রামী কৃষক সংগঠনের সঙ্গে এআইকেএম নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা ও বজায় রাখার প্রয়াসকে বাড়িয়ে তুলবে। পাশাপাশি নিজেদের উদ্যোগে কৃষক আন্দোলনের বিকাশ বৃদ্ধির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেবে। বৈঠকে জিএম বীজ চাষের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যে অনুমতি দিয়েছে তার তীব্র বিরোধিতা জানানোর পাশাপাশি মোদি সরকারের বিদ্যুৎ বিল ২০২২ প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এছাড়াও বৈঠক থেকে বনভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী গরিব বিশেষত আদিবাসীদের বনাধিকার কেড়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার অরণ্য আইন ২০০৬-কে যেভাবে বদলে দিতে চাইছে তাকে তীক্ষ্ণ ভাষায় নিন্দা করা হয়। বনভূমিতে আদিবাসীদের পরম্পরাগত অধিকার বজায় রাখার সাথে সাথে তাদের বনের জমি দখলে রাখার সুযোগ ও জমি বণ্টনের দাবি জানানো হয়। বৈঠকে পঞ্জাবের ফিরোজপুরের জীরাতে অবস্থিত মদ কারখানার সামনে ধারাবাহিক আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জের তীব্র নিন্দা জানানোর পাশাপাশি পাঞ্জাবে এক পানীয় জল প্রস্তুতকারক কারখানায় জলের মধ্যে বিষাক্ত পদার্থ মেশানোর ঘটনার প্রকৃত তদন্ত ও দোষী কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানানো হয়। দিল্লীর ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী পাঞ্জাবী গায়ক কুঁয়র গ্রেবাল ও রণজিত বাবার বাড়িতে আয়কর হানার বিরুদ্ধেও বৈঠক থেকে নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়। বৈঠক থেকে কেন্দ্র ও রাজ্যে এমএসপি গ্যারান্টি আইন প্রণয়ন, কৃষক এবং কৃষিমজুর-গ্রামীণ গরিবদের ঋণ মকুব, গ্রামের গরিব পরিবারগুলির মধ্যে সিলিং বহির্ভূত জমি বণ্টনের দাবি জানানোর সাথে সাথে পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান ইত্যাদি রাজ্যে জলসঙ্কটের স্থায়ী সমাধান ও উত্তরপ্রদেশের আখচাষিদের বকেয়া পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার দাবিতেও আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এআইকেএমের জাতীয় কার্যকরী সমিতির এই সভায় ১৪টি রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভা থেকে সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি হিসেবে রুলদু সিং এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাজারাম সিং-এর নাম পুনর্ঘোষণার পাশাপাশি ৯ জন সহ সভাপতি ও ১৩ জন সম্পাদকের নাম ঘোষনা করা হয়। এই সভা পুনা মহানগর পালিকা কামগর ইউনিয়নের অফিস শ্রমিক ভবনে অনুষ্ঠিত হয়। এআইকেএমের অনুমোদিত দুই সংগঠন মহারাষ্ট্র রাজ্য শ্রমিক শেতকারি (কৃষক) সংগঠন ও সত্যশোধক শেতকারি সভা যৌথভাবে এই বৈঠকের দায়িত্ব ও আয়োজন সম্পন্ন করে।
বৈঠকের পর সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজারাম সিং বলেন, কৃষক আন্দোলনের প্রধান দাবি এমএসপি বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কেবল কৃষকের স্বার্থেই নয়, দেশের খাদ্য সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সারা পৃথিবীর মধ্যে ক্ষুধার্ত দেশের তালিকায় ভারতের স্থান ১২৭। কৃষকের হাতে খাদ্য ব্যবস্থা থাকলে দেশের গরিবরা ভূখা মরবে না। কিন্তু তা সম্পূর্ণভাবে কর্পোরেটদের হাতে চলে গেলে দেশে অনাহার অর্ধাহার চরম আকার নেবে। কারণ কর্পোরেটদের কাছে মুনাফাই প্রথম ও শেষ কথা। মোদী সরকার ওদের হাতে সমস্ত কিছু তুলে দিতে চাইছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছেন চাল, গম জোয়ার বাজরা প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য থেকে ইথানল তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে। যা পরিবহনে জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হবে। সরকার তথ্য হাজির করছে যে, ডিজেল পেট্রোলে নাকি বছরে ২ লক্ষ কোটি টাকা ব্যায় হয়। আর ইথানল থেকে আসে ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা আগামীতে বাড়িয়ে তুলে জ্বালানির বিকল্প তৈরি করা হবে। এর ফলে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হলেও সরকার এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ সরকারের কৃষক বিরোধী ও জনবিরোধী দিশা পরিস্কার। এর বিপরীতে খাদ্য নিরাপত্তা তথা গণবন্টন ব্যবস্থাকে আরও প্রসারিত করার গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার কৃষি-উপকরণের দাম বিপূল পরিমানে বাড়িয়ে চলেছে, অথচ কর্পোরেটদের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ভর্তুকি দিয়ে কৃষি উপকরণ সরবরাহ, কালোবাজারি মজুতদারীর বিরুদ্ধে আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলতে হবে।