গোদি মিডিয়ার পর মোদী সরকার কি সম্পাদকীয় গোদি বিচারব্যবস্থা চাইছে?

সাম্প্রতিক অতীতে মোদী সরকারকে সুপ্রিম কোর্টের ওপর সমবেত আক্রমণ হানতে দেখা গেল। উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকর এবং কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেন রিজুজু পালা করে প্রকাশ্যেই বিচারপতি নিয়োগের কলেজিয়াম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ধিক্কার হানলেন, আর উপরাষ্ট্রপতি ২০১৫ সালের জাতীয় বিচারক নিয়োগ কমিশন (এনজেএসি) আইন বাতিল করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা করেন, সুপ্রিম কোর্টের ঐ রায়কে ‘জনগণের রায়’এর অবমাননা বলে অভিহিত করেন। এর প্রত্যুত্তরে সুপ্রিম কোর্ট তার অসন্তোষ ব্যক্ত করে এবং অ্যাটর্নিজেনারেল আর ভেঙ্কটারামানিকে তিরস্কার করে বলে, তিনি যেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ঐ ধরনের মন্তব্য থেকে বিরত হওয়ার নির্দেশ দেন।

আক্রমণ হানার জন্য এই সময়টাকে কেন বেছে নেওয়া হল তা বুঝে ওঠাটা শক্ত নয়। ২০১৪ সালে ক্ষমতা দখলের পর সুপ্রিম কোর্টে এক নিরাপদ স্থায়িত্বকাল উপভোগের পরবর্তী পর্যায়ে মোদী সরকার এখন এই বিষয়ে সচেতন যে বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ভারতের নতুন প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন, যে পদে তিনি দু’বছর থাকবেন আর এই সময়কালে সুপ্রিম কোর্টে অন্তত ১৯ জন বিচারপতি নিয়োগ হবে। অন্য কারণটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে রিজুজুর তেমন রেখেঢেকে না করা এই আক্রমণ থেকে যেটাতে তিনি সুপ্রিম কোর্টকে জামিনের আবেদন বা জনস্বার্থ মামলা না শোনার জন্য হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। প্রসঙ্গত, জনস্বার্থ মামলাগুলো দায়ের হয় সংবিধানের ৩২নং ধারা অনুসারে যেটাকে আম্বেদকর “সংবিধানের আত্মা ও তার হৃদয় রূপে” অভিহিত করেন। এই আক্রমণ এল সুপ্রিম কোর্ট মহম্মদ জুবের, সিদ্দিক কাপ্পান, ভারভারা রাও ও আনন্দ তেলতুম্বডের মতো সাংবাদিক, লেখক ও বিরোধী মত পোষণকারী নাগরিকদের জামিন মঞ্জুর করার পরপরই।

প্রসঙ্গত, বিচারপতিদের নিয়োগের ব্যাপারে প্রাধান্য কার থাকবে তা নিয়ে শাসক ও বিচার বিভাগের মধ্যে দ্বন্দ্বের উৎস হালফিলের ঘটনার মধ্যে নেই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শাসকই ঠিক করত কারা বিচারপতি হবে। কিছু ছোটখাটো তর্কবিতর্ক চলার পর এই দ্বন্দ্ব চরম আকার নিল ১৯৭৩ সালে যখন ইন্দিরা গান্ধী প্রতিষ্ঠিত প্রথার খেলাপ ঘটিয়ে এক বিচারপতির ওপরে থাকা তিন সহকর্মীকে ডিঙিয়ে পদমর্যাদায় চতুর্থ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি বানালেন। এরপর আবার ঘটল বিচারপতি এইচ আর খান্নার দমন যা স্পষ্টতই ছিল এডিএম জব্বলপুর মামলায় তাঁর বিরোধী মত প্রকাশের জন্য শাস্তি প্রদান। এই সমস্ত প্রশাসনিক পদক্ষেপ বিচারপতিদের নিয়োগ এবং তাদের বিচারবিভাগীয় স্বাধীনতার মধ্যে সুস্পষ্ট গাঁটছড়ার প্রতিষ্ঠা ঘটালো।

বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে শাসকের প্রাধান্য চলেছিল ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত যখন সুপ্রিম কোর্টরায় দিয়ে কলেজিয়াম ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। ক্ষমতায় আসার পর মোদী সরকার এনজেএসি প্রবর্তন করে বিচারপতি নিয়োগে প্রাধান্য ফিরে পেতে চেষ্টা করে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টসেই আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করায় তা ব্যর্থ হয়। এখনও পর্যন্ত এক নমনীয় বিচারবিভাগের আনুকূল্য পাওয়ার পর মোদী সরকার এখন সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধে বিরোধিতা বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষভাবে কলেজিয়ামের মনোনয়ন করা বিচারপতিদের নিয়োগকে বিজ্ঞাপিত করতে অস্বীকার করে।

মার্কস একবার লিখেছিলেন যে, “স্বাধীন বিচারপতি আমারও নয় আবার সরকারেরও নয়”। বিচারপতিদের শ্রেণী উৎসে যে তেমন কোনো পরিবর্তনই হয়নি তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো অবকাশ নেই, এ’সত্ত্বেও নানান অধিকার বিষয়ে ব্যাখ্যায় সুস্পষ্ট পরিবর্তন এসেছে, কখনও শাসক জমানার প্রত্যাশিত পথে, কখনও আবার তাদের বিরুদ্ধে। এরপরও এই বিষয় নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না যে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক জমানার কাছে কাঁটা হয়েই দেখা দিতে পারে। এমনকি জরুরি অবস্থার সময়ও যখন সুপ্রিম কোর্টের অধিকাংশ বিচারপতি শাসকের কাছে নতিস্বীকার করেছিল, সে সময়ও বিচারপতি এইচ আর খান্না এবং কয়েকটি হাইকোর্টের কিছু বিচারক সংবিধানের অনুকূলে রায় দিয়েছেন।

বর্তমান সন্ধিক্ষণ অবশ্য বিচারবিভাগের কাছে এমন একটা চ্যালেঞ্জ হাজির করছে যেটা আগে কখনও দেখা যায়নি। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদী সরকার আইনে উৎকট ভাবে হিন্দুত্বর ধারণা আনা সত্ত্বেও বিচারবিভাগ মোদী সরকারকে কোনো গুরুতর প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়নি। অন্যান্য অনেক বিষয়ের মধ্যে বিমুদ্রাকরণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের পুনর্বিন্যাস, সিএএ, ইলেক্টোরাল বন্ডস নিয়ে মামলার ফয়সালা আজও হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞ গৌতম ভাটিয়ার কথায় এটা হল ‘বিচারবিভাগীয় পরিহার’ যখন আদালতগুলো সমস্যাসংকুল ও সময়-সংবেদী প্রশ্নের ফয়সালাকে এড়িয়ে যায় যা কার্যত সরকারের অনুকূলেই সিদ্ধান্ত হয়, কেননা, স্থিতাবস্থা বজায় থাকার মধ্যে দিয়ে সরকারই লাভবান হয়। এটা স্বাধীন বিচার বিভাগ সম্পর্কে জনগণের ধারণাকে বিচলিত করে।

প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেওয়ার পরপরই মোদী সরকার রঞ্জন গগৈকে রাজ্যসভায় মনোনীত করে; মোদী সরকার আবার আইনে সংশোধনী আনে যাতে অরুণ মিশ্রকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারপার্সন করা যায়। সুপ্রিম কোর্ট আবার কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন রায় দেয় যা শাসক জমানার রাজনৈতিক প্রকল্পের পক্ষে অনুকূল হয় যার মধ্যে রয়েছে বাবরি মসজিদ, কালো টাকা সাদা করা নিরোধক আইন এবং অতি সম্প্রতি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত রায়।

কোভিড মামলাগুলোর মধ্যে দিয়েই সম্ভবত এটা সবচেয়ে ভালোভাবে ফুটে ওঠে যখন সুপ্রিম কোর্ট সরকারের যথেচ্ছ দাবিকে মেনে নিয়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা চেয়ে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলাগুলোকে খারিজ করে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি গোপাল গৌডা বলেছেন, “এডিএম জব্বলপুর মামলাকে আর সুপ্রিম কোর্টের সবচেয়ে তমসাচ্ছন্ন মুহূর্ত বলে স্মরণ করা হবে না। ঐ কলঙ্কটা এখন কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের নিবারণযোগ্য সংকটে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া সাড়ার কবলে।” এমনকি নিয়োগের ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি কুরেশিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদে উন্নীত হতে না দেওয়াটা মেনে নিয়ে শাসকের সিদ্ধান্তের কাছে নত হয়।

এসবের কোনোটাই কিন্তু কলেজিয়ামের বিচারপতি নিয়োগ সম্পর্কে ন্যায্য সমালোচনা, বিশেষভাবে স্বজনপোষণ এবং দলিত, আদিবাসী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নারী এবং ঐতিহাসিক ভাবে উৎপীড়িত অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে সমালোচনার গুরুত্বকে একটুও হ্রাস করে না। মোদী সরকারের এই আক্রমণের মুখে পড়ে প্রতিনিধিত্ব এবং নিয়োগ স্বচ্ছতাকে সুনিশ্চিত করার দায়ভার সুপ্রিম কোর্টের ওপরই বর্তাচ্ছে।

বিচারবিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের একটা বুনিয়াদি বৈশিষ্ট্য এবং ব্যবহারিক গণতন্ত্রের কাছে পরম গুরুত্বের। আম্বেদকর সংবিধান সভায় ঘোষণা করেছিলেন যে, বিচারবিভাগের সেই স্বাধীনতাটুকু থাকতে হবে “যতটা প্রয়োজন ভীত না হয়ে বা পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে ন্যায়বিচার সম্পন্ন করার জন্য”। আমরা এটুকুই আশা করতে পারি যে, রাজনৈতিক শাসক এবং সজাগ প্রহরীর মধ্যে ফারাকটা যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায়।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ২০ ডিসেম্বর ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-50