দারিদ্র্য ক্ষুধা বৈষম্যের পৃথিবীকে আরও বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত করে গেছে কোভিড। সঙ্গে সঙ্গত করে চলেছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ যুদ্ধ আর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাণঘাতী ঝাপ্টা। আর এসবের সহজ শিকার যে দরিদ্র অসহায় মানুষ সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার মধ্যে আবার সবচেয়ে নির্যাতিত নারী ও শিশু।
কিন্তু কোভিড-উত্তর নয়া উদারবাদী বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার হিংস্রতার যে ছবি সম্প্রতি সামনে এসেছে তা হয়তো অনেকেরই জানা ছিল না। পিতৃতান্ত্রিক শোষণকে এমন নিষ্ঠুর এবং নৃশংসভাবে হাতিয়ার করে নারী ও কিশোরীদের রক্ত ঘাম মাখা শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে ভাঙা কোমর সোজা করার মরিয়া চেষ্টাটা লিঙ্গভিত্তিক উৎপীড়নকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আধুনিক বিশ্বের শাসকদের সেই নির্মম অমানবিকতার দলিল তুলে ধরেছে অক্সফ্যাম তার ‘অ্যাসল্ট অব অস্টারিটি’ (ব্যয়সংকোচের হামলা) শীর্ষক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার অতিমারীতে তলিয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে টেনে তোলা এবং লাফিয়ে বেড়ে চলা মূল্যস্তরকে বাগে আনতে ব্যয়সংকোচের আশ্রয় নিয়েছে। এবং তার অব্যর্থ কোপটা পড়েছে গণ পরিষেবার ওপর। শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টি জল সরবরাহ পরিবহন সামাজিক সুরক্ষা, মা ও শিশুর পুষ্টি ও পরিচর্যা – সমস্ত ক্ষেত্রে পরিষেবা ছেঁটে দেওয়া হচ্ছে, ভর্তুকি তুলে দেওয়া হচ্ছে খরচ কমানোর জন্য। আর তার আঘাতটা সরাসরি গিয়ে পড়ছে মহিলা কিশোরী ও সামাজিক লিঙ্গ বৃত্তের বাইরে থাকা (non-binary) মানুষদের ওপর, যারা এই পরিষেবাগুলির ওপর একান্ত নির্ভরশীল ছিলেন। বিশেষ করে গরিব নিম্নবর্ণের প্রান্তিক মহিলা ও কিশোরীরা। তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে চরমতম দারিদ্র্য, ঝুঁকি, অনাহার, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অকাল মৃত্যুর দিকে। কোভিড-উত্তর অর্থনীতির উদ্ধারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে মহিলা ও বালিকাদের জীবন, ঘর্মাক্ত শ্রম ও নিরাপত্তাকে দলিত মথিত পিষ্ট করে। এ কথা বলেছেন অক্সফ্যাম জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড জেন্ডার রাইটস্-এর প্রধান অমৃতা হার্সি। রিপোর্টে এই প্রক্রিয়াকে “স্ল্যাশ অ্যান্ড বার্ন” পদ্ধতি আখ্যা দেওয়া হয়েছে – নতুন কৃষির জন্যে গাছ পালা কেটে পুড়িয়ে দাও! এই অত্যাবশ্যক পরিষেবা ছাঁটাইয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব নারী ও বালিকাদের দেহ মন অনুভূতি ও সংবেদনশীলতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
২০২০-র চেয়ে ২০২১-এ অনেক বেশি মহিলা কাজ হারিয়েছেন। ২০১৯-২০২২-এর মধ্যে মহিলারা বিজ্ঞাপিত কর্মসংস্থানের মাত্র ২১% এ নিয়োজিত হতে পেরেছেন, তা ও তার মধ্যে অনেকগুলোই আগের চেয়ে বেশি শোষণমূলক ও বিপজ্জনক। পরিচর্যার দায়িত্ব পালনে ২০২০ তে মহিলাদের পারিশ্রমিকবিহীন অতিরিক্ত ৫.১২ বিলিয়ন ঘন্টা শ্রম করতে হয়েছে।
প্রতি বছর বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে পৃথিবী জুড়ে ৮০০০০০ মহিলা ও বালিকার মৃত্যু ঘটে। জল সরবরাহ পরিষেবার কাটতির জন্য মহিলাদের কষ্ট আরও বেড়ে যাবে। শুধু জল সংগ্রহের জন্য মেয়েদের অন্তত ২০০০ লক্ষ ঘন্টা সময় ব্যয় করতে হবে। মূল্যবৃদ্ধির এই ভয়াবহ ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে খাদ্য সংগ্রহও দুরূহ হয়ে পড়বে।
লকডাউনের সময় বাজেট বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের জন্য অন্তত ৮৫% দেশ তাদের অত্যাবশ্যক জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ায় মহিলা ও বালিকাদের আরও বেশি লিঙ্গ-হিংসার শিকার হতে হচ্ছে। গত বছরে প্রতি ১০ জনে ১ জন নিজের পরিজনের দ্বারা যৌন অত্যাচার ও শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছে। ২০২৩-এ পৃথিবীর অন্তত ৮৫% মানুষ এই ব্যয়সংকোচ পদক্ষেপের কবলে পড়বেন। স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো তাদের মিলিত সামরিক ব্যয়ের মাত্র ২% ব্যয় করলে, ১৩২টি দেশে ব্যক্তিগত স্তরে লিঙ্গভিত্তিক হিংসা বন্ধ হতে পারে।
মহিলারা অত্যাবশ্যক পরিষেবা, সামাজিক সুরক্ষা ও পরিকাঠামোগত সুবিধা ছাঁটাইয়ের দরুণ শাঁখের করাতের মত দু’বার যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছেন। প্রথমত সরাসরি-চাকরি খোওয়ানো, আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধির চাপ; দ্বিতীয়ত পরোক্ষ ভাবে সমাজের ‘শক অ্যাবজর্বার’ হিসেবে — রাষ্ট্র যখন বিবেকশূন্য হয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে, এই মহিলাদের, বালিকাদের তখন কোনক্রমে নিজেকে এবং পরিবারকে টিঁকিয়ে রাখার দায় শীর্ণ, দুর্বল কাঁধে তুলে নিতে হচ্ছে। কারণ আবহমান কাল ধরে সাংসারিক প্রাত্যহিকতার খুঁটিনাটি তাদেরই দেখতে হয়। নিজে ক্ষুধার্ত থেকেও সকলের খাবারের সংস্থান করতে হয়, সকলের যত্ন করতে হয়। আরও একটু বিশদে বলি-এই আকাশ ছোঁয়া দাম আর পৃথিবীর ক্ষুধার্ত মানুষের ৬০% এর বেশি মহিলা ও বালিকারাই — এই তথ্য আইএমএফ-এর অজানা নয়। তবু এই সংস্থা চোখ কান বুজে ৯টি দেশকে (যার মধ্যে ক্যামেরুন, সেনেগাল, সুরিনামও রয়েছে) ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স চালু করতে বাড়াতে নির্দেশ দিয়েছে। আর সেগুলো খাদ্যসহ অত্যাবশ্যক পণ্যের ওপর!
লিঙ্গসাম্যের ব্যাপারে সরকারগুলো এত নির্বিকার যে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যের অর্ধেকও তারা যোগাড় করতে পারেনি।
নিও লিবারাল বিশ্ব অর্থনীতির আধিপত্য এ সব কিছুর মূলে যা প্রগাঢ়ভাবে পিতৃতান্ত্রিক। এই ব্যবস্থার নির্দেশিত তথাকথিত ‘ব্যয়সংকোচ’ নীতি আদৌ অনিবার্য বা অপরিহার্য নয়। ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে কর্পোরেশনকে সমর্থন দেওয়ার জন্য। বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়ন্ত্রণ বাড়ানো হচ্ছে। আর এই ক্ষমতাবানদের স্বার্থে আর্থিক নীতি সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে সমাজের দুর্বলতম প্রান্তিক মানুষদের থেকে সমর্থন কেড়ে নেওয়া হল। তাদের একান্ত প্রয়োজনগুলি নাকচ করে শোষণের জোয়াল কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া হল। বাজার-চালিত বিশ্বায়নে কম মজুরি ও শ্রম আইন ও বিধিগুলির অবসান ঘটিয়ে পণ্যায়িত নারী শ্রমকে শোষণের রাস্তা পাকা করা হল। তাই এই ব্যয়সংকোচ পদ্ধতি একাধারে শ্রেণি ও লিঙ্গ সংক্রান্ত প্রশ্ন। এটি শুধু লিঙ্গভিত্তিক একটি পদ্ধতিই নয়, লিঙ্গভিত্তিক একটি প্রক্রিয়াও বটে কারণ এটি মহিলাদের প্রাত্যহিক জীবনে তাদের আয়, তাদের পরিচর্যার দায়িত্ব, স্বাস্থ্য-জল-পরিবহন ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবার সুযোগ নেওয়ার সক্ষমতা এবং বাড়িতে কাজের জায়গায় রাস্তায় তাদের সামগ্রিক নিরাপত্তা ও যৌন-শারীরিক নিগ্রহ থেকে স্বাধীনতা – সবকিছু কেই প্রভাবিত করে চলেছে।
এই হিংস্র, অযৌক্তিক যৌন-বৈষম্যবাদী, বর্ণবিদ্বেষী পদ্ধতিটি পুরোনো ঔপনিবেশিকতারই উত্তরাধিকার। তার সঙ্গে বলি, লিঙ্গভিত্তিক হিংসা শুধু বাড়িতে রাস্তা ঘাটে আর কাজের জায়গায় সীমাবদ্ধ রইলো না, ম্যাক্রোইকোনমিক পলিসি ডিসিশনেও তার আগ্রাসী থাবা অক্সফ্যামের এই রিপোর্ট তুলে ধরেছে। মেয়েদের আরও দুর্দশা দারিদ্র্য অস্বাস্থ্য ও অকালমৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ব্যয়সংকোচ নীতির অন্তর্নিহিত হিংসা নিজেকে উন্মোচিত করেছে।
অক্সফ্যাম রিপোর্ট সব দেশের সরকারের কাছে তদারকিতে ব্যয়সংকোচ বন্ধ করে বিকল্প ব্যবস্থার সন্ধান করতে বলেছে। যেমন নারীসহায়ক বাজেট (ফেমিনিস্ট বাজেট) ও ধনীদের সম্পদের ওপর প্রগতিশীল হারে কর বসাতে বলেছে। বিশ্বের বিলিয়নিয়ার ট্রিলিয়নিয়ারদের উপর সম্পদ কর বসালেই এক ট্রিলিয়ন ইউএসডি-র বেশি অর্থ সংগৃহীত হতে পারে যা ২০২৩-এ ৫৪% দেশ অত্যাবশ্যক পরিষেবা তুলে দিয়ে সাশ্রয় করতে চাইছে। কর থেকে সংগৃহীত অর্থ সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ও জনপরিষেবায় বিনিয়োগ করতে পরামর্শ দিয়েছে এই রিপোর্ট। তাছাড়াও, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও মহিলা, বালিকা ও সামাজিক লিঙ্গ বৃত্তের বাইরে থাকা মানুষদের সুনির্দিষ্ট প্রয়োজনগুলি মাথায় রাখতে বলেছে এই রিপোর্ট।
এই রিপোর্টে আইএমএফ-কেও যন্ত্রণাদায়ক ব্যর্থ সমস্ত ব্যয়সংকোচ পদক্ষেপ বন্ধ করতে এবং চালু ঋণ প্রকল্পগুলি থেকে ব্যয়সংকোচ মূলক সমস্ত শর্ত প্রত্যাহার করে নিতে বলেছে। পরিশেষে অক্সফ্যাম রিপোর্টের বার্তাটি তুলে ধরি: “উই নিড টু এন্ড অস্টারিটি। দিস রিপোর্ট ইজ অ্যা বোল্ড কল টুয়ার্ডস ভিশনিং অ্যা নিউ অ্যান্ড অ্যাকশনেবল গ্লোবাল ইকোনমিক অর্ডার দ্যাট ইজ রুটেড ইন পিভোটাল প্রিন্সিপ্লস অব রিডিস্ট্রিবিউটিভ জাস্টিস ফর অল” আমার ভারত বিশ্ব লিঙ্গবৈষম্যের তালিকায় ১৪৬টি দেশের মধ্যে ১৩৫তম। তাই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন আমরাও!
সূত্র: দি অ্যাসল্ট অব অস্টারিটি
(অক্সফ্যাম রিপোর্ট)
নিউজক্লিক, ২৫ নভেম্বর ২০২২
-- জয়ন্তী দাশগুপ্ত