ভারতের নারী আন্দোলনের অন্যতম শরিক হয়ে পশ্চিমবাংলায় প্রগতিশীল মহিলা সমিতি তার যাত্রাপথের চার দশক অতিক্রম করেছে।
দেশজুড়ে নেমে আসা ফ্যাসিস্ট মোদী সরকারের দানবীয় অত্যাচার ও দেশের সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিভূমিকে বিরাট আঘাত হেনে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মোদীর চক্রান্তের বিরদ্ধে দেশ আজ এক সম্মিলিত প্রতিরোধের অপেক্ষায়। এই সময়েই ইরান থেকে ভারতের নারীরা তাদের স্বাধিকারের প্রশ্নে, তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরূদ্ধে পুরুষতন্ত্র ও মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক সরকারের বিরুদ্ধে “জান, জিন্দেগি ও আজাদী” (নারী, জীবন, মুক্তি) শ্লোগানে স্পন্দিত। কাজ, মজুরি, অধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য সরকারের অপশাসন ও সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে এই বাংলার মহিলারাও পথে নামছেন। এইরকম এক প্রেক্ষিতে কলকাতার মৌলালি যুবকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ১১তম পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন।
সম্মেলন উপলক্ষে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ অহল্যার নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে কলকাতাকে। দেশের ফ্যাসিস্ট শক্তির হাতে নিহত কর্ণাটকের নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে স্মরণ করে সভাগৃহকে তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। আর মঞ্চ নামাঙ্কিত করা হয়েছে মহিলা সমিতির প্রয়াত লড়াকু নেত্রী কমরেড কণা সরকারের নামে।
সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে তখন সারা দেশ এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছোঁয়া। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের সমস্ত সম্পদ দেশি-বিদেশি পুঁজিপতিদের কাছে জলের দরে বেচে দিচ্ছে। ভয়াবহ সন্ত্রাসের এক বাতাবরণ তৈরি করে এবং দেশের নাগরিকদের বেনাগরিক করার হুমকি দিয়ে অধিকারহীন অসহায় প্রজা বানানোর চক্রান্ত চালাচ্ছে ফ্যাসিস্ট বিজেপি। দেশজোড়া অর্থনৈতিক সংকট ও বিপন্নতায় সব থেকে বেশি বিপন্ন আমরা নারীরা। দেশের নারীদের জীবন-জীবিকা ও মর্যাদা আজ আক্রান্ত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ১৪৬টা দেশের মধ্যে লিঙ্গ-বিভেদের নির্দেশিকায় ভারত ১৩৫তম স্থানে রয়েছে। দেশের সরকার ভারতে লিঙ্গ-বিভেদের এই দুর্দশা নিয়ে কোনোরকম মুখ খুলছে না।
ভারতের নারীরা যে মুখ্য বৈষম্যের মুখোমুখি তার অন্যতম শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর কাজের বেহাল অবস্থা। বিশ্ব বৈষম্যের রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ভারতের মেয়েরা অতিমারী ও লকডাউনের সময় সবথেকে বেশি ঝামেলায় পড়েছেন। পুরুষ কর্মীদের তুলনায় মহিলা কর্মীদের কাজ থেকে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে ৫ গুণ বেশি। আবার লকডাউন উঠে গেলে কাজ ফিরে পেয়েছেন মাত্র ৫৩ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকাংশই কাজ ফিরে পাননি। শ্রমের বাজার থেকে উৎখাত হয়ে ঘরে থাকতে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। মোদী সরকার কাজ হারা শ্রমিক ও মহিলাদের কোনো সুরাহা তো করতেই পারেনি। বরং শ্রমকোড লাগু করে, কাজের সময় বাড়িয়ে কর্মনিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের নিরাপত্তা, যৌনহেনস্তা থেকে সুরক্ষিত থাকার সমস্ত ব্যবস্থাকে দুর্বল করেছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলারা। গ্রামাঞ্চলেও কাজ নেই। মনরেগা প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ অর্থ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে গ্রামীণ গরিব মানুষ ও মহিলারা আরো সমস্যায় পড়েছেন। কোটি কোটি অভাবী মহিলা আজও ঋণের জালে জর্জরিত। তাই গ্রাম ও শহর থেকে মহিলাদের কাজের ও মজুরির দাবি উঠে আসছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ছাত্রী, গর্ভবতী মহিলা, অনগ্রসর জাতি ও ট্রান্সজেন্ডার মেয়েরা।
এই সময়েই নারীর স্বায়ত্বতা ও সমতার প্রশ্নও কেন্দ্রের ফ্যাসিবাদী ও জনবিরোধী সরকারের হাতে চূড়ান্তভাবে বিপন্ন। নারীর স্বাধীকার হরণ করা হচ্ছে ‘পরিবার’ ও ‘সম্মান রক্ষা’র নাম করে। নারীর স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও শ্লোগানকে তারা ভয় পায়। তারা চায় মেয়েরা ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংঘ নির্দেশিত সংজ্ঞা নিরবে মেনে চলুক। তারা চায় মেয়েরা কুসংস্কার এবং অবৈজ্ঞানিক আচার বিচারে আবদ্ধ থাকুক। শিক্ষাকে আজ এত মহার্ঘ করে দেওয়া হচ্ছে যাতে নিম্নবিত্ত ও গরিব ঘরের ছাত্র ছাত্রীরা তার নাগাল না পায় এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকে।
মোদী সরকার একদিকে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ বলে — অন্যদিকে ধর্ষণকারীদের পক্ষে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করে কাঠুয়ায়, হাথরাসে। সবই করা হয় ভারত মাতার জয়ধ্বনি দিয়ে। গুজরাটে গণহত্যা ও দাঙ্গার সময় নিজের তিন বছরের শিশু কন্যাসহ পরিবারের সাতজনকে হারিয়ে, নিজে গণধর্ষিতা হয়েও অনমনীয় দৃঢ়তায় আট বছরের দীর্ঘ লড়াই জিতে নিয়ে বিলকিস বানো দোষীদের যাবজ্জীবন কারাদন্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর এবছরে ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’ গুজরাটের বিজেপি সরকার পালন করল, ঐ গণধর্ষণকারীদের জেল থেকে মুক্ত করে, ফুলের মালায় বীরের সম্বর্ধনা দিয়ে। ৭৫ বছরের স্বাধীনতা দিবসে এই অপরাধীদের মুক্তির খবর শুধু বিলকিস নয়, দেশজুড়েই নারীর ন্যায় বিচারের দাবিকে নস্যাৎ করে মোদী সরকারের নারী-বিরোধী রূপ আরো একবার জঘন্যভাবে প্রকাশিত হল।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা ভারতের জনগণের বিভিন্ন অংশের উল্লেখযোগ্য লড়াই প্রত্যক্ষ করেছি। গুজরাটে উনায় দলিত জনতার নিপীড়ন বিরোধী জাগরণ, নাগরিকত্ব আইনের বৈষম্যমূলক সংশোধনীর বিরুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শাহীনবাগ আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন, যা কৃষিতে কর্পোরেট রাজ কায়েমের লক্ষ্যে বানানো তিনটে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে মোদী সরকারকে। এই আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে ছিলেন নারীরা কৃষাণীরাই। দেশের নারীরাই সিএএ-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যে আইন নাগরিকত্ব সম্পর্কে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র-বিরোধী এক ধারণার প্রবর্তন করে দেশের সংবিধানটাকেই ওলটপালোট করে দিতে তৎপর।
কৃষক আন্দোলনকারীরা ছাড়াও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার বেসরকারিকরণের বিরূদ্ধে, ক্যাম্পাস গণতন্ত্র বা মোদীরাজের বিরূদ্ধে আন্দোলনে সোচ্চার হয়েছেন। দেশজুড়ে বিভিন্ন গণআন্দোলনকারী কর্মী ও নেতৃত্বকে বিভিন্ন অজুহাতে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ্যাডভোকেট তিস্তা শীতলবাদের মতো সমাজকর্মী বা নাতাশা, গুলফিসা, সাফুরা, সুধা ভরদ্বাজ, সোমা সেনের মতো আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রদ্রোহিতার কেস দিয়ে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। প্রতিবাদীদের মুখ বন্ধ করতে এক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে দেশজুড়ে।
এই সর্বব্যাপী ভয়ের পরিবেশের বিরূদ্ধে নারী সমাজের ঐক্য ও নারীর নির্ভয় স্বাধীনতার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠনকে প্রস্তুত করাও আসন্ন সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে জনতার রায়ে ক্ষমতায় আসীন তৃণমূল সরকার। এখানেও চলছে সর্বত্র দুর্নীতি গুন্ডামি তোলাবাজি, নৈরাজ্য, নারীনির্যাতন, খুন, গণহত্যা ও সন্ত্রাস। চলছে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন, পুলিশী নিপীড়ন।
এরাজ্যে সব থেকে বেশি আলোচিত বিষয় হল নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি। দুর্নীতিতে যুক্ত থেকেছে প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের আমলারা, এমনকি স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীকেও জেলা ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু চাকুরি প্রার্থীদের মূল দাবি — সমস্ত যোগ্য চাকুরি পর্থিরা এখনো চাকুরী পাননি।
এসএসসি, টেট সহ বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ যোগ্য চাকরি প্রার্থীরা (যাদের অনেকেই মহিলা) আজ নিজেদের ন্যায্য চাকরির দাবিতে কলকাতার রাজপথে। ১০০, ২০০ বা ৬০০ দিন ধরে রোদ, বৃষ্টি, শীতকে উপেক্ষা করে পুলিশের লাঠি, জল কামান, গ্রেফতারী সহ্য করে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছন তালিকাভুক্ত যোগ্য চাকুরি প্রার্থীরা।
সারা দেশের মতো রাজ্যেও অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি, সম-কাজে সম-মজুরির দাবিগুলি অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। আশা অঙ্গনওয়াড়ি, মিড-ডে-মিল কর্মীরা যৎসামান্য ভাতায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের ভাতাবৃদ্ধি ও সরকারি কর্মীর স্বীকৃতির দাবিকে কোনো সরকারই কর্ণপাত করছেন না। আবার গৃহ-সহায়িকা, বিড়ি শ্রমিক বা জরি শিল্পের শ্রমিক সহ বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি, অবসর ভাতা ও শ্রমিকের স্বীকৃতি দানে রাজ্য সরকারের কোনো সদিচ্ছাই নেই।
মুখ্যমন্ত্রী থেকে গোটা পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তায় নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটে চলেছে একের পর এক।
সরকারের বহুল প্রচারিত কন্যাশ্রী প্রকল্প এরাজ্যে বাল্যবিবাহ রুখতে পারেনি। ‘লক্ষ্মীর ভান্ডারে’র যৎসামান্য সহায়তা দিয়ে মহিলাদের স্থায়ী কাজ ও ন্যায্য মজুরির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বাস্তবে এগুলো মহিলাদের আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তা দিতে পারেনি। নারী ও শিশুর কল্যাণ ও স্বাস্থ্যখাতে এই সরকারের ব্যয় বাড়েনি। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু এই কার্ড নিয়েও চলছে দুর্নীতি, সাধারণ মানুষের বিভিন্ন রোগে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেগুলো কাজে লাগে না।
এছাড়া মেয়েদের স্বাস্থ্য, পুষ্টির বিষয়টিও রাজ্যে চরমভাবে অবহেলিত। আজ সরকারের হোমগুলিতে কমেছে মেয়েদের নিরাপত্তা, বেড়েছে হোমগুলি থেকে নারী ও শিশু পাচার। নারী ও শিশু পাচার, কর্মহীনতা, ঘরে-বাইরে হিংসা, বাল্যবিবাহ সবেতেই বাংলা শীর্ষে। নারী নিগ্রহের বিভিন্ন ঘটনায় অপরাধীরা এরাজ্যে শাসক দলের মদত পাচ্ছে। হাঁসখালিতে ধর্ষিতা ও মৃতা মেয়েটির সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর কুরুচিকর মন্তব্য সমাজে অপরাধীদের এবং ধর্ষণ সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে।
এই নারী বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে দেশের সংবিধান ও গণতান্ত্রিক কাঠামোকে রক্ষা করার চ্যালেঞ্জ নিতে হবে আজ, একই সাথেই রাজ্য সরকারের সন্ত্রাস ও দুর্নীতির প্রতিবাদে এরাজ্যে ও গণতন্ত্র, প্রগতি ও নারী মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে নারী আন্দোলনের অগ্রণী কর্মীদের।
- ইন্দ্রাণী দত্ত