মোদী নিয়ে ব্যক্তি পূজোকে নিষ্ফলা করে দেওয়া এবং বিজেপির অপশাসনের অবসান ঘটানোর সময় সমুপস্থিত
Modi Cult and End BJP Misrule

হিমাচল প্রদেশ, দিল্লী এবং গুজরাতের নির্বাচনী মরশুম হাজির হয়েছে আরও একবার। পরবর্তী বিধানসভা ও সরকার গঠনের জন্য হিমাচল প্রদেশের ভোট ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, দিল্লীর পুনর্গঠিত পুরসভা নিগম নির্বাচিত করতে ভোট গ্ৰহণ হবে ৪ ডিসেম্বর ২০২২ আর গুজরাত বিধানসভার নির্বাচন দু’দফায় অনুষ্ঠিত হবে ১ ও ৫ ডিসেম্বর ২০২২। তাদের শাসনে চলা চূড়ান্তরূপের কলঙ্কিত ও অকর্মন্য জমানাগুলোর রক্ষায় মরিয়া হয়ে উঠে বিজেপি আরও একবার মোদীকে দিয়ে চড়া মাত্রার প্রচারের ওপরই অবলম্বন করছে, এবং তাঁর দিক থেকে মোদীও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির প্রচারকে তীব্রতর করে তুলতে নির্ভর করছেন তাঁর অনুগত ‘গোদি মিডিয়ার’ উপরই। আর এই প্রচার নির্বাচক মণ্ডলীর কাছে ক্রমেই আরও বেশি অপমানজনক এবং ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার ভবিষ্যতের কাছে আশঙ্কাজনক হয়ে দেখা দিচ্ছে।

গুজরাতে মোরবি সেতুর ভেঙ্গে পড়াটা রাজ্যে বিজেপির দীর্ঘকালের শাসনের দুর্নীতিপরায়ণ এবং অবহেলাকারী চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে উন্মোচিত করে দিয়েছে, যে শাসনকে সংঘের প্রচার যন্ত্র তথাকথিত ‘উন্নয়নের গুজরাট মডেল ও সুশাসন’ রূপে ঢাক পিঠিয়েছে। গোদি মিডিয়া আনুগত্যের বশবর্তী হয়ে এই কেলেঙ্কারিটাকে আড়াল করে গেছে, আর তার বিপরীতে মোদীর মোরবি হাসপাতাল পরিদর্শনকে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করেছে যেটাও আবার ছিল মোদীর নিজেকে জাহির করার এক নির্লজ্জ প্রয়াস। এর আগেও প্রচারের এক অপকীর্তির মুখোমুখি আমাদের হতে হয়েছিল যখন মোদীর এক ভুয়ো স্কুল পরিদর্শনের জালি ভিডিও তুলে ধরা হয়েছিল। আর প্রচারের এই ধারাটাকেই এখন নিয়ম করে তোলা হয়েছে, গুজরাত এবং হিমাচল উভয় রাজ্যেই এমন ভিডিওকে ভাইরাল করা হয়েছে যাতে দেখানো হয়েছে যে অ্যাম্বুলেন্সকে এগিয়ে যেতে দেওয়ার জন্যে মোদীর কনভয় দাঁড়িয়ে পড়ছে।

স্বৈরাচারী শাসককে সদয় ও পরদুঃখকাতর নেতা রূপে তুলে ধরার লক্ষ্যে প্রচারের এই ঝড় কিন্তু মোদীর অঢেল প্রচার ক্ষুধাকে তৃপ্ত করতে পারে না। তিনি তাই আহত-সত্তার তাস খেলছেন এবং নিজের কদর বৃদ্ধি ও নিজেকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার লক্ষ্যে নতুন-নতুন সুযোগ উদ্ভাবন করছেন। বিমুদ্রাকরণকে যুক্তিসম্মতভাবেই এতাবৎকালের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জালিয়াতি ও রাজনৈতিক চটকদারি বলা যায়; এই বিমুদ্রাকরণের ষষ্ঠ বার্ষিকী পূর্তিতে সাধারণ ভারতীয় জনগণ যখন স্মরণ করছিলেন তাঁদের ভোগ করতে হওয়া বিপুল যন্ত্রণা ও ক্ষতির আর ভারতকে চোকাতে হওয়া বিশাল অর্থনৈতিক মূল্যের মতো বিষয়কে, মোদী তখন আমাদের শোনাচ্ছিলেন যে, তাঁর সরকার কীভাবে প্রচারের চেয়ে সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার ওপরই অগ্ৰাধিকার দিয়েছিল! আত্মমগ্ন ‘ক্যামেরাজীবী’ যে মোদী মাকে দেখতে গেলে বা মন্দির পরিদর্শনে গেলেও ছবি তোলার লোকেদের সঙ্গে নিয়ে যান এবং যিনি তাঁর ও তাঁর নিকটতম বস্তু ক্যামেরার মধ্যে চলে আসা যে কাউকে অভ্যাসবশত ঠেলে সরিয়ে দেন, সেই মোদীর কাছ থেকে আসা এইসব বিষয়ের চেয়ে অসত্য আর কিছু কী হতে পারে?

মোদী আর একবার আমাদের বলেছিলেন, কীভাবে তিনি তাঁর দিকে নিত্যই ধেয়ে আসা প্রচুর গালাগালিকে সহ্য করে তাদের পুষ্টিকর খাদ্যে পরিণত করতে শিখেছিলেন! এই কথাটা বলছেন এমন এক নেতা যিনি একেবারেই মৃদু সমালোচনাকেও সহ্য করতে অপারগ হওয়ার কুখ্যাতি অর্জন করেছেন, যিনি বিরোধী মত পোষণকারীদের জেলে পুরেছেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় যাঁর নেতৃত্বাধীনে সংঘটিত গুজরাত গণহত্যা সম্পর্কিত একটিমাত্র অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকার মাঝপথে ছেড়ে যাওয়ার কুখ্যাতি অর্জন করেছেন এবং ইতিহাসে ভারতের একমাত্র প্রধানমন্ত্রী রূপে নথিবদ্ধ হবেন, যিনি যথার্থ কোনো সাংবাদিক সম্মেলন করেননি, শুধুই চিহ্নিত গোডি মিডিয়ার সাংবাদিকদের আগেই নির্ধারণ করে রাখা সাক্ষাৎকারে অনুমোদন দিয়েছেন! মাঝে-মাঝেই তাঁর জীবনকে বিপন্ন করে তোলা ষড়যন্ত্রের অভিযোগের উদ্ভাবন থেকে তথাকথিত ‘প্রাতিষ্ঠানিক অভিজাতদের’ ঘটানো ‘অবমাননার’ অভিযোগ আর এখন আবার দৈনন্দিন গালাগালির গালগল্প — মোদী এইভাবে আহত-সত্তার তাসটাকে নিখুঁতভাবেই খেলছেন।

হিমাচল প্রদেশে বিজেপি অভ্যন্তরীণ বিবাদে জর্জরিত, সঙ্ঘ-বিজেপি হাই-কম্যান্ডের সার্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তিরিশটারও বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন। এক বিদ্রোহী প্রার্থীর প্রতি নরেন্দ্র মোদীর ফোনে আবেদন জানানোর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে মোদী প্রকাশ্যেই শ্রোতৃমণ্ডলীকে বলেন যে, বিধায়করা বিবেচ্য নয়, পদ্মর বোতাম টিপে জনগণকে মোদীকেই ভোট দিতে হবে। ক্ষমতার তামাম কেন্দ্রীকরণ এবং লাগামহীন ব্যক্তি পূজোর রাজনীতি এরচেয়ে প্রকটিত আর হতে পারে না।

জাতীয়তাবাদী উন্মাদনাকে উস্কিয়ে তুলে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্রতায় পর্যবসিত করে দৈনন্দিন জীবনের জরুরি ইস্যুগুলো থেকে জনগণের দৃষ্টিকে বিক্ষিপ্ত করতে গোদি মিডিয়া তাদের চেষ্টায় কোনো খামতি রাখছে না। টি-২০ বিশ্বকাপ গোদি মিডিয়ার কাছে হয়ে উঠেছিল নিজেদের নিম্নতম স্তরে নামিয়ে আনার একটা সুযোগ! লিগ পর্যায়ের খেলায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ বলে উত্তেজনাপূর্ণ বিজয় থেকে শুরু করে মিডিয়া ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ফাইনাল এবং স্বপ্নের সেই ফাইনালে পাকিস্তানের ওপর ভারতের গৌরবজনক বিজয়ের পূর্বাভাস নিয়ে অতিরঞ্জনে মেতে ওঠে, এবং উগ্ৰ-জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক ভাবনাকে তীব্রতর করে তুলতে পাকিস্তান দলকে অভিহিত করা হয় ‘বাবর সেনা’ রূপে। একটা চ্যানেল আবার ইংল্যান্ড ও ভারতের মধ্যে সেমিফাইনালের আগে জ্যোতিষীদের একটা দলকে হাজির করে যাদের সবাই ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, উত্তেজনাপূর্ণ লড়াইয়ের পর ভারত বিজয়ী হবে। ইংল্যান্ড ভারতকে দশ উইকেটে হারানোয় ম্যাচটা অবশ্য একেবারেই একপেশে হয়ে ওঠে!

ধর্মান্ধতা, ঘৃণা ও মিথ্যাচারের এই মাতামাতির মধ্যে আমরা এটুক আশা করতে পারি যে, হিমাচল প্রদেশ, গুজরাত ও দিল্লীর ক্ষুব্ধ জনগণ এই খেলাটাকে ধরে ফেলতে পারবেন এবং বিজেপির অপশাসনের অবসান ঘটাতে নিজেদের ভোটকে সফলভাবে প্রয়োগ করবেন।

(এমএল আপডেট সম্পাদকীয়, ১৫ নভেম্বর ২০২২)

খণ্ড-29
সংখ্যা-45