প্রতিবেদন
রাজনৈতিক ভাষ্য : মডেলের ছড়াছড়ি, নীতি আদর্শের বালাই নেই
principles and ideals

শিলিগুড়ি মডেলের কথা সকলেরই মনে আছে। বছর ৪-৫ হয়ে গেছে রাজ্যের শাসনক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েছে সিপিএম, বহুবচনে বামফ্রন্ট। হাঁপিয়ে উঠেছেন নেতা থেকে কর্মী। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে। যাদের কাছে নীতি, আদর্শ, রাজনীতি, প্রভৃতি ততো গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারা ২০১১ সালে দিন বদলের সাথে সাথে (বলা ভালো, ক্ষমতার হাত বদলের সাথে সাথে) সরাসরি ক্ষমতার সঙ্গে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন যুক্তিতে পরিচিত বহু মুখ সিপিএম/বামফ্রন্ট ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। হাওয়া মোরগের মতো কিছু আগে থেকেই তারা ‘পরিবর্তনের’ আভাস পেতে শুরু করেছিলেন, কেউ কেউ সামনে ও পেছন থেকে পরিবর্তনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিলেন। এদের কথা বাদ নিন। এই সমস্ত ‘বামপন্থী ক্যাডাররা’ ক্ষমতায় আসীন নতুন শাসক দলে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন। অন্যদিকে যারা আদর্শে বিশ্বাসী, জনগণের ভালোমন্দ যাদের নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে তারা আরও কিছুদিন দিন বদলের আশায় অপেক্ষা করলেন। ভেবেছিলেন, তৃণমূল আর কতদিন? নীতি নেই, আদর্শ নেই, কর্মসূচি নেই, এ আর কতদিন টিকবে? বিরোধী দলের অবস্থান অনেকের কাছে অপরিচিত শব্দ। দীর্ঘ ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকে কেউ কেউ ভেবে নিয়েছিলেন আজীবন ক্ষমতায় থাকবেন।

২০১৫’র জুলাই আগস্ট মাসে শিলিগুড়ি পৌরসভা নির্বাচনে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ ধৈর্য হারানো, বিশ্বাস হারানো বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের আদর্শচ্যুতির নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করল। বামফ্রন্টের বৈঠকে শরিক দলগুলোর প্রশ্ন ও ক্ষোভের মুখে সিপিএমের তিন নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র জানালেন, কংগ্রেস, বিজেপির সঙ্গে কোনো ধরনের অনীতিনিষ্ট জোটে সিপিএম অংশ নেবে না। অথচ সংবাদ আসতে শুরু করল মহকুমা পরিষদের কিছু আসনে (ফাঁসিদেওয়া ব্লকে) ক্ষমতাসীন শাসক দলের সন্ত্রাস, দুর্নীতি ইত্যাদি মোকাবিলায় বিজেপি প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়েছে সিপিএম। এমনকি এই খবরও আসলো দলের রাজ্য সম্পাদক প্রতিবাদে যৌথ জনসভায় অংশ নিতে অস্বীকার করেন। জেলা সম্পাদক জানালেন, “কেউ কথা শোনে না”! রাজনীতি যখন ক্ষমতার সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কে পরিণত হয়েছে, তখন ক্ষমতা থেকে দূরে সরে থাকার বিশুদ্ধতার কোনো অর্থ নেই। শিলিগুড়ি মডেল তাই দলের মধ্যে জায়গা করে নিল, তাই নয়, পুরো সময়ের জন্য পৌরসভায় কংগ্রেসের ৪ জন পৌর প্রতিনিধি পাশে থাকল। বিজেপির জনা দুয়েক পৌর প্রতিনিধি জানিয়ে দিল, অনাস্থা প্রস্তাব আসলে আমরা “সব দিক বিবেচনা করেই অবস্থান ঠিক করব”। শিলিগুড়ি পৌরসভা নির্বাচনের দিনে শাসকদলের সন্ত্রাস রুখতে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়েছিল। চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল শিলিগুড়ি মডেলের কার্যকারিতা। হারানো ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার অব্যর্থ কৌশল।

যে মডেলের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল, দলের মধ্যে বিতর্ক ছিল, সেই মডেলই আরও বৃহত্তর পরিসরে — ২০১৬’র বিধানসভা নির্বাচন ও ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনে লক্ষ্য করা গেল। স্বাভাবিকভাবে কথার ফুলঝুড়িতে ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা হল সেই আত্মঘাতী জোট রাজনীতিকে। শর্টকাট পথে ক্ষমতায় ফিরে আসার পথের ফলাফল সকলের জানা। না, এতেও লক্ষ্য পূরণ হয়নি। ফলাফল নিয়ে আলোচনার আর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এই আত্মঘাতী রাজনীতি দলের কর্মীদের উৎসাহিত করার বদলে মতাদর্শের বিসর্জনকে আরও ত্বরান্বিত করল। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করতে বিজেপির মতো ফ্যাসিস্ট দলকে ভোট দিতে দ্বিধা করেননি তারা।

এরই অন্তিম পরিণতি দেখা গেল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে। শুধু দলের আসন সংখ্যা শূণ্যে নেমে এসেছে তাই নয়, দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে বামপন্থী গণভিত্তি গড়ে ওঠেছিল, একটা ভুল, আত্মঘাতী রাজনৈতিক লাইন ও কৌশল সেই গণভিত্তির স্থায়ী ক্ষয়ের জন্ম দিল।

শিলিগুড়ি পৌরসভা ও মহাকুমা পরিষদে যে মডেলের অনুশীলন ও পরিণতি আমরা দেখেছিলাম, এবার তারই অনুরূপ মডেল অনুশীলিত হচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমার ও মহিষাদল রাধাকৃষ্ণ সমবায় নির্বাচনে। বেশ কিছুদিন ধরে সলতে পাকানো হচ্ছে। ‘চোর ধরো জেল ভরো’ আন্দোলন জনপ্রিয় হতেই বিজেপি ও সিপিএমের মধ্যে একটা তরজা শুরু হয়। এই শ্লোগানের জনক বা সৃষ্টিকর্তা কে? শ্লোগানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য খুবই স্পষ্ট। উভয় দলই চায় “দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা মন্ত্রীদের” এবং সম্ভব হলে তৃণমূলী মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তার। শহুরে মধ্যবিত্ত, ছাত্র যুব ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় দাবি। বিশেষ করে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষা আধিকারিকদের পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি গণপ্রতিবাদ ও গণআন্দোলনে গতি দিয়েছে। একটা ফ্যাসিবাদী চরম দুর্নীতিগ্রস্ত দলের উদ্যোগের সঙ্গে ফারাক টানার কঠিন কাজে মনোযোগ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন সিপিএম নেতৃত্বের কাছে ছিল না। যে বিজেপি নেতারা তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের অনেকেই তৃণমূলে থাকার সময় ঐ সমস্ত দুর্নীতিতে যুক্ত ছিল। দেশ ও রাজ্যের অন্যান্য বিজেপি নেতাদের কথাতো ছেড়েই দিলাম। এদের সঙ্গে ফারাক টানার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না থাকায় বিজেপির পরিষদীয় নেতা অত্যন্ত সহজে বিজেপির নবান্ন অভিযানে সিপিএম কর্মীদের সামিল হওয়ার আহ্বান জানান, নীচুতলায় ‘নাগরিক ঐক্য’ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে লম্বা চওড়া ভাষণ দিতে থাকেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি আরও কুৎসিত ভাষায় বলেই ফেললেন, বুড়ো বুড়ো কিছু নেতার সঙ্গ ছেড়ে বিজেপির নবান্ন অভিযানে সামিল হতে ছাত্র-যুবদের কাছে আহ্বান জানান। বিনা উদ্দেশ্যে নয় এই আহ্বান। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের স্বার্থে বিজেপি ও সিপিএমের মধ্যে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ফারাকটা মুছে ফেলা। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আবহাওয়া গড়ে তোলার লক্ষ্যে শুরু হয়েছে মেদিনীপুর মডেলের অনুশীলন।

পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের বহরমপুর সমবায় সমিতি নির্বাচনে বিজেপি সিপিএম জোট, ‘পশ্চিমবঙ্গ সমবায় বাঁচাও’ মঞ্চ গড়ে ৬৩টি আসনের সবকটিতে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের হারিয়ে দেয়। এই নজরকাড়া সংবাদ প্রকাশ্যে আসার পর সিপিএম নেতৃত্ব এই জোটকে সম্পূর্ণ ‘অরাজনৈতিক বোঝাপড়া’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালান। এরপর একই ঘটনা দেখা গেল, পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের রাধাকৃষ্ণ সমবায় সমিতি নির্বাচনে। এই সমবায়ে ‘কৃষক সংঘর্ষ সমিতি’ গড়ে ৬২ আসনে বিজেপি এবং ১২ আসনে সিপিআই লড়াই করছে। এবার সিপিআই রাজ্য নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, “তারা কিছু জানেন না”। এই অরাজনৈতিক, অজানা জোট রাজনীতি কোন মতাদর্শ বহন করে চলেছে, তা বামপন্থী কর্মীদের বুঝে নিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নন্দকুমারের ‘মডেল’ মহিষাদলে মুখ থুবড়ে পড়ল। তৃণমূল কংগ্রেস ৬৭+১ (বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) আর অন্যদিকে জোট (সম্ভবত) ৭টি আসন পেয়েছে।

এভাবেই ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিজেকে অরাজনৈতিক, দুর্নীতি বিরোধী, সহযোগী শক্তি হিসাবে তুলে ধরার ছলচাতুরি শুরু করেছে। শ্রমজীবী জনগণের বুনিয়াদি দাবিগুলোতে জোরালো গণআন্দোলন গড়ে তোলা, দেশ ও রাজ্যের জনবিরোধী সরকারগুলির সমস্ত জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে নীতিনিষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালানো ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। অন্যথায় ২০১৯’র নির্বাচনের মতো ২০২৪-এ শোনা যাবে রাম ছাড়া গতি নেই। ছাত্র যুব মহিলা সহ সমাজের বিভিন্ন অংশের যে বামপন্থী কর্মীরা মেহনত করে পরিস্থিতি পরিবর্তনের চেষ্টা চালাচ্ছেন, একদল ক্ষমতালিপ্সু নেতার ভুল রাজনীতি তাকে ব্যর্থ করে দেবে? এখনি সতর্ক হওয়ার সময়।।

- পার্থ ঘোষ

খণ্ড-29
সংখ্যা-45