(হুগলির চন্দননগরের রবীন্দ্র ভবনে ১৪-১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আয়ারলার সপ্তম জাতীয় সম্মেলনে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়)
১। বি আর আম্বেদকর জাতিপ্রথাকে শ্রমিকদের মধ্যে বিভাজন রূপে যে বিশ্লেষণ করেছিলেন আমরা তাকে অনুমোদন করি এবং মোদী সরকার সমাজে জাতপ্রথাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আমরা তার বিরোধিতা করি। সুপ্রিম কোর্ট অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বলতর অংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের প্রতি যে অনুমোদন দিয়েছে তাতে উচ্চ বর্ণের জন্য ১০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের মোদী সরকারের সিদ্ধান্তই বহাল রইল। এর মধ্যে দিয়ে সামাজিক ন্যায়ের নীতিই লঙ্ঘিত হলো যা তফশিলি জাতি, তফশিলি জনজাতি, এবং অন্যান্য পশ্চাদপদ শ্রেণীর মতো সংবিধান স্বীকৃত গোষ্ঠীগুলির জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থার পিছনে মূল নীতি হিসাবে কাজ করেছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় ১০ শতাংশ কোটা থেকে এই গোষ্ঠীগুলোকে বাদ দেওয়ার ওপর ভিত্তি করেই হয়েছে। সংরক্ষণ দারিদ্র প্রশমনের কোনো পন্থা নয়, এর জন্য কর্মসংস্থান ও মজুরির উন্নয়ন ঘটাতে হবে আর এই বিষয়ে মোদী সরকার চূড়ান্ত রূপেই ব্যর্থ হয়েছে।
২। আয়ারলা ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও গ্ৰামীণ ঋণগ্ৰস্ততার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য তার সদস্যবৃন্দ ও সাধারণ জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। ঋণগ্ৰস্ততার জন্য যে মৃত্যুগুলো ঘটছে তা মূল্যস্ফীতি এবং গ্ৰামীণ দরিদ্রদের নিঃস্ব হয়ে পড়ার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার লক্ষণগুলোকেই নির্দেশিত করে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের স্থান নিকৃষ্ট দেশগুলোর মধ্যেই রয়েছে এবং এই সূচকে স্থানের ধারাবাহিক অবনমন দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সরকার গ্ৰামীণ দরিদ্রদের শিশুদের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছে যে শিশুরা ওয়েস্টিং (বয়সের তুলনায় ওজন কম) এবং স্টানটিং (বয়সের তুলনায় উচ্চতা কম) আক্রান্ত এবং ক্রমেই আরও বেশি করে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। সরকারের অবহেলায় শিশু মৃত্যুর এই বিষয়টা উপস্থিত প্রতিনিধিদের উদ্বিগ্ন করছে এবং চাপিয়ে দেওয়া এই স্বাস্থ্যহীনতা, অপুষ্টি ও মৃত্যুর বিরুদ্ধে সমাবেশিত হতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
৩। লাগামছাড়া মূল্যস্ফীতি এবং বেকারির ক্রমবর্ধমান যে স্তর জনগণকে খাদ্যগ্ৰহণ হ্রাসে বাধ্য করছে, তার বিরুদ্ধে আমরা অবশ্যই সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলব। সরকার একদিকে মূল্যস্ফীতি এবং বেকারির নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা গ্ৰহণ করছে না, বিপরীতে কর্পোরেট মিত্রদের আরও ধনী করার নীতি নিয়ে অসাম্যকে বাড়িয়ে তুলছে।
৪। পশ্চিম বাংলায় শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির উন্মোচন ঘটেছে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের পূর্বতন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি জেলে রয়েছেন। শিক্ষক নিয়োগের মূল ইস্যুটাকে কিন্তু ঠান্ডাঘরে আবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা দাবি জানাচ্ছি, গ্ৰামীণ দরিদ্রদের শিক্ষাকে বানচাল করা চলবে না এবং দ্রুতই স্বচ্ছতার সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ করতে হবে।
৫। বাজেট বরাদ্দের হ্রাস ঘটিয়ে, সময়মতো মজুরি প্রদানের ব্যবস্থা না করে এবং মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারির এই সময়ে কর্ম প্রার্থীদের কাজ থেকে বঞ্চিত করে মোদী সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকার এমএনআরইজিএ-র যে লঘুকরণ ঘটাচ্ছে এবং তার বিকৃতি সাধন করছে, আয়ারলা তাকে ধিক্কার জানাচ্ছে। এটাকে আমরা গ্ৰামীণ দরিদ্রদের জীবন ও জীবিকার অধিকারের বিরুদ্ধেই পদক্ষেপ বলে মনে করছি, এবং প্রতিদিন কাজের শেষে মজুরি প্রদান, বছরে ২০০ দিনের কাজ এবং দৈনিক মজুরি ৭০০ টাকা করার দাবিতে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্ৰহণ করব।
৬। দলিত ও আদিবাসীদের জীবন, জীবিকা, মর্যাদা, মজুরি, শিক্ষা, কর্মসংস্থানকে যেভাবে পদদলিত করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুখে দাঁড়ানোর জন্য আমরা জনগণের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। মনুবাদকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মোদী সরকারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ সংগঠিত করব। দলিত নারীদের বিরুদ্ধে চালানো হিংসা এবং দলিত ও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নিপীড়নের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলব।
৭। এক কোটিরও বেশি যে মহিলারা সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণে যুক্ত আছেন তাদের আমরা সরকারের কর্মী ও শ্রমিক বলেই স্বীকৃতি দিই যাদের ন্যূনতম মজুরি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এই মহিলাদের অধিকাংশই গ্ৰামাঞ্চলে কাজ করেন এবং তাদের অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনকে সম্ভবপর করতে আমরা তাদের সংগঠিত করব।
৮। সমস্ত শষ্য এবং উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য লাভকে সুনিশ্চিত করতে রাজ্যপালদের ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের যে আহ্বান সংযুক্ত কিসান মোর্চা জানিয়েছে, আমরা আয়ারলার প্রতিনিধিরা তাতে সম্মতি জানাই। কৃষিকাজের কর্পোরেটিকরণ ঘটানোর যে নীতি সরকার নিয়েছে, তাকে আমরা কৃষি শ্রম/কাজের দর কষাকষির ক্ষমতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ বলেই গণ্য করি যে ক্ষমতা বহু সংগ্ৰামের অর্জিত ফসল।
৯। কাশ্মীরে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুতে আমরা মর্মাহত। এটা মোদী-শাহর নীতির পরিপূর্ণ ব্যর্থতারই পরিণাম; ঐ নীতি গোটা রাজ্যের ওপর দখল নিয়ে তাকে দুটো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে ভাগ করেছে, ৩৭০ ধারার বিলোপ ঘটিয়েছে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে অনাস্থার এক বিষাক্ত পরিমন্ডলের জন্ম দিয়েছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন কেন্দ্র সরকারের হাতে রাজনীতির খেলার খোরাক হতে পারে না। আমরা দাবি জানাচ্ছি, কেন্দ্র সরকারকে আইন তৈরি করে পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষাকে সুনিশ্চিত করতে হবে।
আয়ারলার জাতীয় সম্মেলনে ১৮টি রাজ্য থেকে প্রায় ৯০০ প্রতিনিধি অংশ নেন। সম্মেলন ২০৫ সদস্যের এক জাতীয় পরিষদ এবং ৭৯ সদস্যের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করেছে। ধীরেন্দ্র ঝা সম্পাদক হিসাবে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন এবং সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন সত্যদেব রাম। আয়ারলার পৃষ্ঠপোষক মনোনীত হয়েছেন রামেশ্বর প্রসাদ এবং সাম্মানিক সভাপতি মনোনীত হয়েছেন শ্রীরাম চোধুরী।