প্রতিবেদন
হিম্মত কেবল আমাদেরই আছে
we have courage

– দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

চন্দননগরের বুকে লাল নিশান উড়িয়ে কোনো সর্বভারতীয় সম্মেলন, সম্ভবত এই প্রথম অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সমস্ত বামপন্থীরা এ’জন্য গর্বিত হবেন। ঐতিহাসিক এই নজির সৃষ্টির জন্য সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতিকে (আয়ারলা) অভিনন্দন। চন্দননগরের এক অনন্যসাধারণ ঐতিহ্য আছে। সারা দেশ যখন ব্রিটিশের দখলে তখন চন্দননগরে কিন্তু ব্রিটিশ রাজ ছিল না। এটি ছিল ফরাসি উপনিবেশ। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিথোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে চন্দননগরের নাম চির ঊজ্জ্বল। এই শহরের বীর সন্তান কানাইলাল দত্ত মাত্র কুড়ি বছর বয়সে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। জন্ম বর্ধমানে হলেও, মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাসবিহারী বসুও বড় হয়েছেন এই শহরেই। আর এই হুগলী জেলা ছিল বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুলেরও বিচরণক্ষেত্র। স্বাধীনতার দাবিতে, দাসত্বের বিরুদ্ধে, মহিলাদের মর্যাদার প্রশ্নে তাঁর কলম ঝলসে উঠেছে বারবার। এই ঐতিহ্যমন্ডিত হুগলী জেলা তথা চন্দননগরে যখন আয়ারলা’র ৭ম রাষ্ট্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তখন এর প্রথম সম্মেলনের কথাও বলা দরকার। জমি, মজুরি, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে কৃষিমজুরদের সংগ্রামগুলি ক্রমেই যখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছিল তখনই স্থির হল এই আন্দোলনকে রাষ্ট্রীয় চেহারা দিতে হলে রাষ্ট্রীয় স্তরে সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ২০০৩ সালে প্রথম সম্মেলনের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠল সারা ভারত কৃষি মজুর সমিতি (আয়লা)। এখন কৃষিমজুররা নতুন নতুন বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। গ্রামীণ গরিবদের, সমস্ত গ্রামীণ মেহনতীদের সংগঠিত করার জন্য আয়লা পালটে হয়ে উঠেছে আয়ারলা (সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি)। যেখানেই হোক না কেন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রশ্নে আয়ারলাকে লড়তে হবে। শুধু জমি নয়, শুধু গ্রাম নয়, সারা দুনিয়াটাকেই জিতে নিতে হবে — এটাই হবে আয়ারলার রণধ্বনি। সম্মেলনে বহু প্রতিনিধি এসেছেন। তবু মনে হচ্ছে, মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব আরো বাড়াতে হবে। সংগঠনে আদিবাসীদের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। করোনা অতিমারীর দাপটে সারা দেশ বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মূল্যবৃদ্ধি আকাশ ছুঁয়েছে, বেকারত্ব তীব্র হয়েছে। তাই দাবি উঠছে, “দাম বাঁধো কাজ দাও, কাজের পুরো দাম দাও”। শুধু ন্যূনতম মজুরি নয়, চাই বেঁচে থাকার উপযোগী মজুরি। আমরা দাবি করেছিলাম, সমস্ত গরিবদের প্রকৃত খাদ্য সুরক্ষা সহ খেতমজুরদের জন্য চাই এক সুসংহত আইন। এই দাবি আজও অর্জন করা যায়নি। গরিব মানুষদের জন্য সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে করোনাকাল তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। সময়ে ডাক্তার নেই, বেড নেই, অক্সিজেন নেই। সরকার বলছে পয়সা নেই। খেতমজুরদের স্বার্থে আইন কী করে আনব? পালটা আজ আওয়াজ তুলতে হবে, “যে কাজ চায় তাকেই কাজ দিতে হবে। কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দিতে হবে।” পশ্চিমবাংলায় ১ বছর ধরে ‘একশো দিনের কাজ’ বন্ধ। এটা চলতে পারেনা। আজ এখন আর একশো দিন নয়, বলতে হবে “একশো দিনটা দুশো দিন কর। যথা সময়ে মজুরি দাও।” ওদিকে মোদী বলছেন, “রেউড়ি বাঁটনেকে লিয়ে হাম নেহি আয়েঁ হ্যায়।” আমরা তোমার প্রজা নই। অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। দলিতদের জন্য কোন সামাজিক ন্যায় ছিল না। আমরা এই অধিকার আদায় করে নিয়েছি। বিহারে গরিবদের ভোট দেওয়ার অধিকারটুকুও ছিল না। আমরা এ অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছি। দলিত ও পিছিয়ে পড়ারা তাদের প্রতিনিধি রামেশ্বর প্রসাদকে লোকসভা আসনে জেতাতে সক্ষম হয়েছেন।

আজ দেশ কোথায় পৌঁছেছে? বিশ্ব দারিদ্র্য সূচকে আমাদের স্থান শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানেরও পিছনে। এ জিনিস চলবে না। ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামুল্যে বিদ্যুৎ, সকলের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জল — এ দাবিকে মানতেই হবে। সরকারী স্কুলে এমন দুর্দশা কেন হবে? কেন সরকারী স্কুলকে বলা হবে “খিচুড়ি খাওয়ার স্কুল?” জমি, বাড়ি বেচে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে গরিবরা বাচ্চাদের পাঠাবে কেন? গরিব মহিলাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়াবে না? মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির জুলুমে মহিলারা কেন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন? বিহারে আমরা দাবি তুলেছি, “সুস্থ বিহার, আমার অধিকার”। বদলে কেন্দ্র দিয়েছে ‘আয়ুষ্মান ভারতের’ কার্ড। পশ্চিমবঙ্গ দিয়েছে ‘স্বাস্থ্যসাথী কার্ড’। কার্ডে তো চিকিৎসা হয়না। কার্ডের নাম্বার থেকে নার্সিং হোমে টাকা চালান হয়। টাকা শেষ তো চিকিৎসাও শেষ।

লড়াই জোরদার করতে হবে। বিহারে আমাদের বিধায়করা রয়েছেন। আমাদের বিধায়কেরা ভিআইপি নন। আপনারা লড়লে, আপনাদের সঙ্গে থেকে বিধায়করাও লাঠি খাবেন। মোদী জমানায় সংবিধানকে নস্যাৎ করা হচ্ছে। ৩৭০ ধারা বাতিল করা হল। ফল কী দাঁড়াল? জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের মর্যাদা হারাল। লাদাককে আলাদা করা হল। একটা আস্ত রাজ্যের অবনমন ঘটিয়ে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করা হল। এখন বিহারের একাংশ (সীমাঞ্চল) ও উত্তর বাংলাকে নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির ফন্দি আঁটা হচ্ছে। রাজ্যগুলির অধিকার এইভাবে খর্ব করা হচ্ছে। সীমান্ত থেকে ৫০ কিমি পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে বিএসএফ-কে। সংবিধানে আম্বেদকার সংরক্ষণের মূল স্পিরিট হিসেবে জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যকে সামনে এনেছিলেন। ফলে এসসি/এসটিদের সংরক্ষণের যে আইন তৈরি হয়েছিল তারজন্যই সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁদের মধ্য থেকে অনেকে প্রশাসনের উঁচু পদে বসতে পেরেছিলেন। এমন পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অংশের জন্য সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে। এতে দলিত আদিবাসীরা বঞ্চিত হবেন। এরা কারা? বছরে আট লক্ষ টাকা পর্যন্ত (মাসে ৬৬ হাজার) যাদের আয় এমন পরিবারগুলি এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আসল সচ্ছল, ধনী পরিবারগুলিই কেবল নতুন এই সংরক্ষণের সুযোগ পাবে।

National Conference of AIARLA

এখন বুলডোজার রাজ চলছে। বুলডোজারের নিশানা হল গরিবদের ঝুপড়ি ঘর। শুধু গরিব উচ্ছেদ হচ্ছে। ঝাড়খণ্ডে ল্যান্ডব্যাঙ্কের নামেও এই জিনিস চলছে। সরকার বস্তি উচ্ছেদ করে জমির দখল নিচ্ছে। পরে সেই সরকারী জমি আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। রাজধানী দিল্লীতে বুলডোজারের নিশানা হয়েছে সমস্ত ‘বে-আইনি’ বস্তি। মুসলিমরা এই আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু বুলডোজারই হোক আর এনআরসি’ই হোক — সমস্ত ধরনের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষরাই এসবের শিকার হচ্ছেন। মোদীরাজের বিরুদ্ধে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাই ব্যাপক ঐক্য দরকার। মোদীর পিছনে আছে গোটা সঙ্ঘ পরিবার, ১০০ বছর ধরে হিন্দুরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা আরএসএস। ফ্যাসিবাদকে খণ্ড খণ্ড করে দেখার জায়গা নেই। মমতা বলছেন, “আরএসএসের সবাই খারাপ নয়”। কেজরিওয়াল মোদীর বিরোধিতায় কর্মীদের গেঞ্জির পিছনে আম্বেদকার ও ভগৎ সিংয়ের ছবি আঁকতে বলেছিলেন। এখন তিনি সার বুঝেছেন! সেই গেঞ্জির সামনে এবার লক্ষ্মী আর গণেশের ছবি। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সেজন্য, অটুট, অখণ্ড শক্তি চাই যার কেন্দ্রে থাকবে বামপন্থীরা। আর বামপন্থী মানেই তো মজদুর, গ্রামের ব্যাপক মেহনতী মানুষ। চাই শাণিত চেতনা। এই চেতনা, প্রতিবাদী কলমকে মোদীজীরা ভয় পান। তাইএখন তিনি ‘কলমধারী নকশালদের’ জব্দ করার নামে সমস্ত বিরোধীস্বরকে স্তব্ধ করতে চাইছেন। সুতরাং লড়াই আরও কঠিন হচ্ছে। আবার লড়াইটা আরো জরুরী হয়ে উঠছে। কিন্তু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই, ব্রিটিশের অনুগত সামন্তপ্রভু ও ব্রাহ্মণ্যবাদী অনুশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইও কি কঠিন ছিলনা? দলিত হিসেবে ক্রমাগত লাঞ্ছনার মুখে আম্বেদকারকে বৌদ্ধ হতে হয়েছিল। সুতরাং লড়াই চলবে। আমাদের একটা বড় অস্ত্র — সংখ্যা। শ্রমজীবী মানুষ আমরা রয়েছি হাজারে, লাখে, কোটি কোটি সংখ্যায়। মেহনতীদের এই বিপুল জনশক্তিকে একত্রিত করার দায় আমাদের। এই কাজে যত বেশি সাফল্য আসবে তত বেশি আমরা লড়াইয়ে এগিয়ে যাব। কঠিন লড়াইকেও হাসিমুখে পরিচালনার হিম্মত কেবল আমাদেরই আছে।

খণ্ড-29
সংখ্যা-44