পশ্চিমবঙ্গে যৌথ নারী আন্দোলন : সেকাল একাল এবং আগামী সম্ভবনা
Women's Movement in West Bengal

দেশজুড়ে আজ ঘরে বাইরে মেয়েদের ওপর যৌন হেনস্থা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও গণধর্ষণ, নৃশংস হত্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সর্বগ্রাসী সামাজিক সংকট ও নৈরাজ্য এবং সর্বোপরি মনুবাদী নারী-বিদ্বেষী আরএসএস বিজেপির শাসন এর জন্য মূলত দায়ী। আমরা মেয়েরা প্রতিরোধ আন্দোলনও গড়ে তুলছি নানাভাবে। যেমন, শাহিনবাগ আন্দোলন। কিন্তু সমস্ত বামপন্থী প্রগতিশীল নারী সংগঠনগুলো আগের মতো একজোট হয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারছি কই?

এই প্রশ্নটা মনে জাগছিল গত ১৮ অক্টোবর ঐতিহাসিক তেভাগার লড়াকু নেত্রী এবং কমিউনিস্ট আন্দোলন তথা নারী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা কমরেড ইলা মিত্রের জন্মদিনে। ১৯৮০-৯০’র দশকের কথা। আমরা এরাজ্যে এবং জাতীয় স্তরে মূলত বামপন্থী ও কয়েকটি নারীবাদী সংগঠনের সঙ্গে একজোট হয়ে কত আন্দোলন গড়ে তুলেছি। আমাদের নেত্রী সার্বজনীন গীতাদির (গীতা দাস) ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেইসব সংগঠনের নেত্রীদের সঙ্গেও একটা সুসম্পর্ক গড়ে উঠে ছিল।

তখন বানতলা, মানিকচক, বিরাটি, ফুলবাগান ইত্যাদি অঞ্চলে নারী নির্যাতন ও গণধর্ষণের একের পর এক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত নিন্দনীয়। এসবের প্রতিবাদে এবং সরকারের গা-ছাড়া মনোভাবের বিরুদ্ধে আমরা নিজেরা সংগ্রামে নেমে যৌথ আন্দোলনের আহ্বান জানাই। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ছাড়া অন্যান্য বামপন্থী ও নারীবাদী মহিলা সংগঠন সকলেই এই আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন।

আমি তখন প্রগতিশীল মহিলা সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা। আমি বয়সে বেশ খানিকটা কম হওয়ার জন্য ইলাদি আমাকে যেমন স্নেহ করতেন তেমনি সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। আমাদের সংগঠন ছোট হলেও তাকে সমান গুরুত্ব দিতেন। শুধু ইলাদি নয়, সেই সময়ে একইরকম ভালো ব্যবহার পেয়েছি গীতা মুখার্জী, গীতা সেনগুপ্ত, শেফালী ভট্টাচার্য, বিদ্যা মুন্সি, অপরাজিতা গোপী, কনক মুখার্জি, সাধনা চৌধুরী, মৃণালিনী দাশগুপ্তের মতো বিশিষ্ট নেত্রী এবং অন্যান্য মহিলা সংগঠনের নেত্রীদের কাছ থেকেও। ভালো মাত্রায় রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও এঁদের সঙ্গে একসাথে চলতে কোন অসুবিধা হতনা।

আশির দশকে মহারাষ্ট্রের আদিবাসী নাবালিকা মথুরা পুলিশ হেফাজতে ধর্ষিত হন। যখন অভিযুক্ত পুলিশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ছাড়া পায় তখন নারীসমাজ সোচ্চার হয়। এক ঐতিহাসিক খোলা চিঠি যায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির কাছে। মহিলা আইনজীবীরা এতে স্বাক্ষর করেন।

আশি থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত ছিল নারী আন্দোলনের এক সুবর্ণ সময়। নারী ইস্যুগুলো প্রকৃত রাজনৈতিক আন্দোলনের ইস্যু হয়ে উঠেছিল। জনসমর্থনও ছিল, ফলে সরকার এবং প্রশাসনও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হতো। একটা অন্যরকম রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি ছিল।

রাজনৈতিক মতভেদ থাকলেও, নারী আন্দোলনের প্রশ্নে সমস্ত সংগঠন একাত্ম এবং আন্তরিক ছিল।

আশির দশকে মথুরা ধর্ষণ মামলার রায়ের প্রতিবাদে, কলকাতায় শবর ছাত্রী চুনি কোটালের আত্মহত্যা, অর্চনা গুহর ওপর লকআপে অত্যাচারে মামলা, দেওরালায় সতীদাহ ঘটনা, রাঁচিতে পুলিশ কর্তৃক নাবালিকা ধর্ষণ, এরাজ্যে বিভিন্ন কারাগারে নিরাপত্তার অজুহাতে নিরাপরাধ বন্দিনীদের মামলা, বিজ্ঞাপনে নারী দেহ পণ্য করার বিরুদ্ধে, নাবালিকা পরিচারিকাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু, বধুহত্যা, পণপ্রথা ইত্যাদি ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে ওঠে।

নারীর দৈনন্দিন শোষণ নিপীড়নের বিষয়টি পার্টিতেও প্রাধান্য পাওয়ায় গ্রামাঞ্চলে এবং বস্তি এলাকায় মহিলা সংগঠনও গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনগুলোতে পরে বহু এনজিও যুক্ত হয়। ফলে কর্মসূচিগুলোতে বহু মহিলার সমাবেশ যেমন ঘটতো তেমনি আন্দোলনের পরিধির বিস্তারও ঘটেছিল।

আরেকটি ঘটনা, সংসদে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের দাবিতে গীতাদি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিলেন। তাই আমরা এই দাবিতে কর্মসূচিতে প্রধান বক্তা হিসেবে ওনাকে রেখেছিলাম। ফোন করে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এবং সঙ্গে এও জানিয়েছিলাম পথসভা হবে শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে। সবটা জেনেই সাংসদ গীতাদি রাজি হয়েছিলেন, আসার জন্য কোনও গাড়িও পাঠাইনি। নিজেই যথাসময়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। আমাদের ব্যবস্থাপনায় ছিল কেবল গুটিকয়েক চেয়ার আর মাইক। খোলা আকাশের নিচে অন্ধকারে বেশ খুশি মনেই গীতাদি বক্তব্য রেখেছিলেন।

সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির নেতৃত্বে ১৯৯৭’র ৩০ এপ্রিল সংরক্ষণের দাবিতে পুলিশের লাঠি, জলকামাল উপেক্ষা করে প্রায় ৬,০০০ মহিলা সংসদ অভিযান করেন। এবং পরদিন প্রধানমন্ত্রীর হাতে এই দাবির সমর্থনে প্রায় দু’লক্ষের বেশি সই জমা দেওয়া হয়। এই দাবিতে ১ আগস্ট ‘প্রতিবাদ দিবসে’ কলকাতায় আইপোয়ার উদ্যোগে এক কনভেনশনে বামফ্রন্টের মহিলা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন। আবার চার বাম দলের মহিলা সংগঠনের আয়োজনে ২০ আগস্ট ‘প্রতিবাদ দিবসে’ আইপোয়ার নেত্রীরা বক্তব্য রাখেন। এইভাবে সংরক্ষণ ইস্যুতে অন্য সব রাজনৈতিক মতপার্থক্য সরিয়ে রেখে মহিলা সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছিল।

প্রাক্তন বিধায়ক অপরাজিতা গোপীর (ফরওয়ার্ড ব্লক ও অগ্রগামী মহিলা সংগঠনের নেত্রী) সাথেও আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল। তার ছাপ পড়ে আমাদের কর্মসূচিতে ওনার বক্তব্যে মধ্যে।

১৯৯২’র ৩০ আগস্ট পাটনায় দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়া বিরোধী মহিলা কনভেনশনের মধ্যে দিয়ে আঠারোটি বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক মহিলা সংগঠন সরকারের আর্থিক নীতি ক্রমবর্ধমান নারী নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে যৌথ ফোরাম গঠন করে। এর আদলে এরাজ্যেও একটি ফোরাম গঠনের লক্ষ্যে ১৯৯৩’র ফেব্রুয়ারিতে আমরা মৌলালীর বিএমপিইইউ হলে একটি কনভেনশনের আয়োজন করি। মূল আলোচ্য বিষয় ছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সারাদেশে বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও মৌলবাদী মতাদর্শের উত্থানের বিরুদ্ধে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ নারী আন্দোলন গড়ে তোলা যায়। কিন্তু অন্যান্য মহিলা সংগঠন আমাদের ডাকে সাড়া দিলেও যেমন পাটনায় সর্বভারতীয় কনভেনশনে তেমনি এরাজ্য ও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী যৌথ আন্দোলনে যোগ দিতে অস্বীকার করে। এর বদলে তাঁরা তাঁদের পার্টির লাইন অনুসারে ‘গণতান্ত্রিক’ অর্থে জনতা দল এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ অর্থে কংগ্রেসের মহিলা সংগঠনকে নিয়ে চলেছিলেন।

মৌলালীর কনভেনশনে অপরাজিতাদি বলেছিলেন, পাটনা কনভেনশন থেকে যে জাতীয় স্তরে ফোরাম গড়া হয়েছে তেমনটি এরাজ্যে সম্ভব নয়, যতক্ষণ না গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির মতো বড় সংগঠনকে সামিল করানো যায়। ‘বড় সংগঠনের’ এই মনোভাবের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, দেশকে রক্ষা করতে গেলে আমাদের সকলকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠতেই হবে।

সিপিআই এবং পশ্চিমবঙ্গ মহিলা সমিতির নেত্রী বিদ্যা মুন্সিও বলেন, রাজ্যের মূল বামপন্থী মহিলা সংগঠনের সঙ্গে এ’বিষয়ে আলাপ আলোচনার দ্বার খুলতে আমি এবং আমরা উদ্যোগ নেব। এসইউসিআই এবং মহিলা সাংস্কৃতিক সংঘ’র নেত্রী সাধনা চৌধুরী সহ অন্যেরাও যৌথ আন্দোলনের উপর জোর দেন।

পশ্চিমবাংলার প্রথম নারী কমিশনের সহ-সভানেত্রী ছিলেন গীতা সেনগুপ্ত। তিনি আরএসপি ও নিখিল বঙ্গ মহিলা সংঘের রাজ্যস্তরের নেত্রী। ‌‌‌‌‌‌‌ওনার সঙ্গে সম্পর্কটা এরকমই ছিল যে, সকালে ফোন করেছি বিকেলে প্রোগ্রাম — তাতেও হাজির থেকেছেন। আন্তরিকতার এতটুকু খামতি তো ছিলই না, নিজের পদমর্যাদার জন্য কোনও দূরত্বও আমাদের সঙ্গে রাখতেন না।

সিদ্ধার্থ সরকারের অত্যাচারী পুলিশ অফিসার রুণু গুহনিয়োগীকে যখন জ্যোতিবাবুর সরকার প্রমোশন দিল তখন তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন বামপন্থী মানুষজন। তার ‘সাদা আমি কালো আমি’ বই প্রকাশনার বিরুদ্ধে আমরা অর্থাৎ সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি রুখে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এই আন্দোলনকে জোরদার করতে আমরা একটি কনভেনশনের আয়োজন করি। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি ছাড়া বামফ্রন্টের অন্যান্য শরিক মহিলা সংগঠনের নেত্রীরা এই প্রতিবাদে অংশ নিতে রাজি হয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির তৎকালীন সভানেত্রী কমরেড কনক মুখার্জির সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভালোই ছিল তাই ওনাকে ফোন করে বলেছিলাম, এই খুনি অফিসারের বিরুদ্ধে আমাদের একসাথে লড়তে হবে। কনকদি বলেছিলেন অবশ্যই, আমি তো চোখে দেখতে পাই না, কনভেনশনে যেতে পারবো না। তোমরা আমাদের অফিসে এসো চিঠি লিখে দেব। আমি আর গীতাদি (গীতা দাস) গিয়েছিলাম, আমাদের সামনেই একজন মহিলা কমরেডের সাহায্য নিয়ে রুণু গুহনিয়োগীর বইয়ের বিরোধিতা করে চিঠি লিখে দিয়েছিলেন কনকদি। কনভেনশনে সেই চিঠি পড়া হল। সংবাদপত্রে যৌথ প্রতিবাদের সে খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়।

নারীবাদী লড়াকু নেত্রী মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জির সঙ্গে আমাদের কিছু রাজনৈতিক মতপার্থক্য ছিল। কিন্তু একাত্মতার কোনও ঘাটতি ছিল না।

১৯৯৮ সালে ১৮ ডিসেম্বর পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড বিনোদ মিশ্র মারা যাওয়ার পর ‘প্রতিবিধান’ পত্রিকা ‘বিনোদ মিশ্র সংখ্যা’ প্রকাশ করে। মৈত্রেয়ীদি তাতে ‘বামপন্থা ও নারী আন্দোলন’ নামে একটি লেখা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “১৯৮৩তে প্রগতিশীল মহিলা সমিতির ডাকে সাড়া দিয়ে যে যৌথ মঞ্চ তৈরি হয় তার নামকরণ হয় ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ’। রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নারীবাদী সব ধরনের সংগঠনই ছিল। সচেতনা, মহিলা গবেষণা কেন্দ্রে, মহিলা পাঠাগার, মহিলা পাঠচক্র, লহরী নিয়ে মহিলা সমিতি যৌথ কর্মসূচি আরম্ভ করে। এরসঙ্গে পরে যুক্ত হয় ‘প্রতিবিধান’ পত্রিকা। ...”

“আইপিএফ এবং প্রগতিশীল মহিলা সমিতি যৌথভাবে ১৯৮৬ সালে কলকাতার ত্যাগরাজ হলে একটি বড় সম্মেলন করে। এখানে সব ধরনের নারী সংগঠনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সম্মেলনে কানপুরের নারীবাদী সংগঠনের প্রতিনিধিরা মার্কসবাদের তীব্র সমালোচনা করেন। আয়োজকদের তরফ থেকে কিন্তু তাঁদের বক্তব্য ধৈর্য্য সহকারে শোনা হয়। সম্মেলনের কোনও পর্বেই আয়োজকদের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, এমনকি সম্মেলনে আলোচনার নথি লেখার ভারও তাঁরা অন্য সংগঠনের প্রতিনিধিদের উপর ন্যস্ত করেছিল। বামপন্থী রাজনীতিতে এই ধরনের উদারতা বিরল। এর কৃতিত্ব অনেকাংশেই প্রয়াত নেতা বিনোদ মিশ্রের প্রাপ্য। তিনিই প্রথম স্বপ্ন দেখেন সব ধরনের সংগঠনকে নিয়ে জঙ্গি কমিউনিস্ট নারী আন্দোলনের। ... ১৯৮৮’র ফেব্রুয়ারিতে পাটনায় যে সম্মেলন হয় সর্বভারতীয় স্তরে তা অভূতপূর্ব সারা জাগায়।

চল্লিশের দশক থেকে নব্বই দশকে অন্য কোন বামপন্থী রাজনৈতিক দল নারী আন্দোলন নিয়ে এই স্তরে ভাবেনি এবং এখনো ভাবে না। তাদের সংকীর্ণ এবং রক্ষণশীল মনোভাবের পাশে সিপিআই(এমএল)-এর দৃষ্টিভঙ্গি এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।”

মৈত্রেয়ীদি আসলে ছিলেন আমাদেরই একজন, ওনার প্রবন্ধের টুকরো থেকে একথা পরিষ্কার বোঝা যায়।

প্রতিবিধান পত্রিকা প্রকাশনা শুরু থেকে আমাদের সংগঠনের তিন চার জন সদস্য ছাড়াও বাইরের বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল বহু মানুষ যুক্ত ছিলেন। সকলেই জানতেন এই প্রকাশনা শেষ বিচারে সিপিআই(এমএল)-এর, কিন্তু তা নিয়ে এঁদের মধ্যে কোনও দ্বিধা কখনও দেখা যায়নি। অনেকেই পত্রিকা এবং মহিলা সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে সামিল হতেন।‌ বলা যায়, পত্রিকা অনেকটা সংগঠকের ভূমিকা পালন করতো।

ঐ সময়ে রাজ্য নারী কমিশনে আমরা স্থায়ী সদস্য না হলেও আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে কমিশনের বেশিরভাগ বৈঠকে ডাকা হতো। বিভিন্ন ইস্যুতে আমরাই বেশি সোচ্চার হতাম এবং অন্যান্য সংগঠনের সদস্যরাও তাতে আওয়াজ তুলতেন। এখানেও একটা যৌথতার পরিবেশ গড়ে ওঠে। কমিশনের পরবর্তী সভানেত্রী যশোধরা বাগচীর সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। এখনতো রাজ্যে নারী কমিশনের কোনো অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায় না!

১৯৯৮ সালে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ মঞ্চ’ ভেঙে যায়। ২১ শতকের শুরুতে নতুন মঞ্চ ‘মৈত্রী’ গঠন হয়। এর ব্যানারে নারী ইস্যুতে সরকার বিরোধী বেশ কয়েকটি বড় কর্মসূচি পালিত হয়। নানা মতপার্থক্যের কারণে এই মঞ্চেরও আর বিশেষ ভূমিকা থাকল না।

তবে যৌথ আন্দোলনে ভাঁটার টান কিন্তু বেশি দিন থাকেনি। বামফ্রন্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যজুড়ে সিপিএমের কর্মীবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড হামলা নামায়। বিভিন্ন অঞ্চলে সিপিএম করার অপরাধে মহিলারা শারীরিক নিপীড়ন, গণধর্ষণের শিকার হন। আইপোয়া’র পক্ষ থেকে আমরা তৃণমূল কংগ্রেসের ঘৃণ্য প্রতিশোধমূলক আচরণের প্রতিবাদে স্বাধীন কর্মসূচি নেওয়ার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতিসহ অন্যান্য বামপন্থী মহিলা সংগঠনকেও যৌথ কর্মসূচির জন্য আহ্বান জানাই। সকলেই এমনকি এই প্রথম গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতিও এতে সাড়া দেয়। যৌথভাবে হামলা কবলিত এলাকায় অনুসন্ধান এবং থানা ডেপুটেশন, রাজ্যপালের কাছে স্মারকলিপি প্রদান, একটি যৌথ কনভেনশন ইত্যাদি কর্মসূচি চলতে থাকে। কিন্তু যৌথতার মধ্যেও গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির নেতৃত্বের মধ্যে নানা সংকীর্ণতা দেখা যায়। ফলে এই বৃহত্তর যৌথতা মূলত সিপিএমের ওপর দমনের ইস্যুতেই আটকে থাকে।

২০১২-১৩ সালে দিল্লীর নির্ভয়া কাণ্ড ও কামদুনির গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে এক নতুন জোয়ারের সূত্রপাত হয়। ২০১৩ সালের ২১ জুন কামদুনির নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতার মহামিছিল হয়। ব্যানার ছাড়াই বিভিন্ন নারী সংগঠনের কর্মীরা এতে যুক্ত হয়েছিলেন। যারা বাংলায় সরকার পরিবর্তন চেয়েছিলেন, তাঁদের বিবেকেও নাড়া দিয়েছিল নতুন রাজ্য সরকারের ঘৃণ্য ভূমিকা। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পর আরো একবার শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ পথে নেমেছিলেন। এই ব্যাপক বিস্তৃত আন্দোলনে প্রথম থেকেই আইপোয়ার ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। সবচাইতে বড় কথা, আন্দোলনের ময়দান থেকে কামদুনির গ্রাম্য মেয়ে বউ টুম্পা, মৌসুমী আন্দোলনের সুযোগ্য নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু মাটি থেকে উঠে আসা এই স্বতঃস্ফূর্ত সম্ভাবনাময় আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সুসংগত পরিণত নেতৃত্বের প্রয়োজন তার অভাবে এ লড়াই ধীরে ধীরে থিতিয়ে আসে।

Oneness of the Past and Future Possibilities

সম্মিলিত সংগ্রাম এখনও হয় কিন্তু তাতে সেই জোশ নেই। তবে সে জন্য আমরা হা হুতাশ করি না, কারণ আমরা জানি অতীতকে একইভাবে ফিরিয়ে আনা যায় না। জোয়ার ভাটার মধ্যে দিয়ে আন্দোলনের নদী নিজের পথ তৈরি করে নেয় নতুন পরিস্থিতি অনুসারে। আজ সারা ভারতে কেবল নারী-হিংসার বিরুদ্ধে নয়, রুটি-রুজির জন্য এবং সমমর্যাদা সম অধিকার স্বাধীনতার দাবিতে মেয়েরা নতুন নতুন ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলছেন। রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসকরা যত নারীদের উপর নতুন রূপে শোষণ বঞ্চনা নামাচ্ছে ততই মহিলাদের বিভিন্ন অংশ বা স্তর (যেমন স্কিম ওয়ার্কার, মহিলা কৃষি শ্রমিক) নিজ নিজ ক্ষেত্রে সংগঠিত হচ্ছেন, রুখে দাঁড়াচ্ছেন। আমরা তাঁদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করছি, তাঁরাই আমাদের শক্তির উৎস।

একজোট হয়ে সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য আজও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং যাব। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নিজেদের গণভিত ও স্বাধীন আন্দোলন বাড়িয়ে তুলেই আমরা পারবো যৌথ আন্দোলনেও নতুন প্রাণসঞ্চার করতে।

- চৈতালি সেন

খণ্ড-29
সংখ্যা-45