২০ নভেম্বর এআইসিসিটিইউ’র পঞ্চম উত্তর ২৪ পরগণা সম্মেলন। সম্মেলন স্থল : বোকে হল, নৈহাটি। পতাকা উত্তোলন করে এআইসিসিটিইউ’র ৫ম উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলনের সূচনা করেন বর্ষীয়ান নেতা কমরেড নারায়ণ দে।
সম্মেলনের শুরুতে পর্যবেক্ষক এবং এআইসিসিটিইউ রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বাসুদেব বসু বলেন, এই প্রথম দেশবাসী তথা শ্রমজীবী মানুষের ওপর একযোগে রাজনৈতিক, আর্থিক, আইনগত এবং শারীরিক হামলা চালানো হচ্ছে। আর সেটা চালাচ্ছে ফ্যাসিবাদী আরএসএস-বিজেপি সরকার। এই হামলাকে রুখতে হলে প্রথমে নিজেদের কারখানা ইউনিটগুলিকে শক্তিশালী করতে হবে। কমরেড বসু বলেন, লেবার কোডের মাধ্যমে যেমন সংগঠনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তেমনই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতি ছড়িয়ে শ্রমিক-ঐক্য ভাঙার চেষ্টা চলছে। ১৯২১’র তৃতীয়বারের তৃণমূল সরকারও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকারকে সংকুচিত করে চলেছে। রাজ্যের শ্রমনিবিড় দু’টি শিল্প — চা-বাগান ও চটকলে দীর্ঘদিন মজুরি-ভাতা নিয়ে কোন ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়নি। তিনি আরও বলেন, সংগঠনের বিস্তার ও ট্রেড ইউনিয়ন কাজের বৈচিত্র্যে বিশিষ্ট জেলা উত্তর ২৪ পরগণা। এখানে মিড-ডে-মিলের সংগঠন ও জমায়েত ক্ষমতাও তুলনামূলকভাবে ভালো। তিনি জানান আগামী ২১ নভেম্বর দিল্লীর যন্তর মন্তরে প্রকল্পকর্মী ফেডারেশনের সদস্যরা সামাজিক সুরক্ষার দাবিতে ধর্ণায় বসছেন। সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
এরপর ঘড়ি ধরে চলা সম্মেলনের ঠাসবুনোট কর্মসূচির ছোট্ট ফ্রেমে যেন ঐ পর্যবেক্ষণের বাস্তব প্রতিচ্ছবিই ধরা পড়েছে ঘুরে ফিরে। বর্ষীয়ান ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ওমপ্রকাশ রাজভর হিন্দিতে এবং বিদায়ী জেলা সম্পাদক নবেন্দু দাশগুপ্ত বাংলায় প্রতিবেদন পাঠের পর একুশ জন প্রতিনিধি তার ওপর বক্তব্য রাখেন। তারআগে উত্তর ২৪ পরগণা সিপিআই(এমএল)-এর জেলা সম্পাদক সুব্রত সেনগুপ্ত সম্মেলনের উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের গণতান্ত্রিক পরিসর, যা একটি বিপ্লবী সংগঠনের আত্মাস্বরূপ, তাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সম্মেলনের মধ্য দিয়ে শক্তি বাড়িয়ে এআইসিসিটিইউ, সংগঠনের নিচ থেকে উপর সমস্ত স্তরের ভাবনায় কাজে মেলবন্ধন ঘটিয়ে, বিভিন্ন শিল্পের বিভিন্ন ধারার সংগ্রামের মধ্যে যোগসূত্রের মাধ্যমে একমুখী এক বলিষ্ঠ লড়াই গড়ে তুলে শ্রমিকদের উপর হামলার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তিনি বিপন্ন চটশিল্প, শ্রমিক ও একই সঙ্গে সঙ্কটে থাকা পাটচাষিদের সমস্যা প্রতিকারে ‘জুট বাঁচাও, জুট শ্রমিক বাঁচাও’ আন্দোলনকে তীব্র করতে আবেদন করেন। মিড-ডে-মিল আন্দোলনে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
বেঙ্গল চটকল মজদুর ফোরামের সব বক্তাই জুট মিল শ্রমিকদের মজুরি চুক্তি না হওয়ার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। দৈনিক ১,০০০ টাকা মজুরির দাবিও জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
রন্ধনকর্মী ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন মজুরি বৃদ্ধি, সামাজিক সুরক্ষা ও শ্রমিকের মর্যাদা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়াও ১২ মাসের কাজে ১০ মাসের ভাতা, ছাত্র পিছু অনেক কম রন্ধনকর্মী নিয়োগ, ৬০ বছর হলেই অবসরকলীন কোনও প্রাপ্য ছাড়াই বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে — এসব নানা সমস্যার কথা উঠে আসে।
ইটভাটা ইউনিয়নের নেতা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বলেন, সরকারি নীতির ফলে বেশিরভাগ ইটভাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এআইসিসিটিইউ অনুমোদিত ইউনিয়ন প্রতিবছর সম্মানজনক মজুরি চুক্তি করতে সফল হয়েছে। কিন্তু সঙ্কট বাড়ছে উৎপাদন সামগ্রীর অভাবে। মাটি নেই, কয়লা নেই, বালি তোলা বন্ধ। মাটির ইটের জায়গা নিচ্ছে কর্পোরেটদের সিমেন্ট ইট। দু’একটা ভাটায় উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে সমস্যা রয়েছে।
নির্মাণ ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা অনুমোদিত সরকারি সুবিধাগুলো পুনরায় লাগু করা ও মজুরি বৃদ্ধির সংগ্রাম গড়ে তোলার আবেদন করেন। একদিকে মানুষের আর্থিক সমস্যার জন্য নির্মাণের কাজ কমে গেছে। অন্যদিকে সরকারি সব সুযোগ সুবিধা বন্ধ। নিয়মগুলোর জটিলতা বেড়েছে। ফলে সংগঠনকে টিঁকিয়ে রাখা ও বাড়ানো এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাশীপুর জিএন্ডএস (পার্মানেন্ট) ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেন, ২০১৯ সালে প্রতিরক্ষা শিল্পকে ‘কর্পোরেশন’ করার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ৫ দিনের ধর্মঘটকে এআইসিসিটিইউ সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিল। এই প্রসঙ্গে প্রতিরক্ষা শিল্পের অন্যান্য সরকার স্বীকৃত ইউনিয়নের ভূমিকা নিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রদপ্তর দানবীয় এডসা আইন একবছরের জন্য চালু করেছিল, কিন্তু এখনও তা জারি আছে। ‘ওপেন ব্যালট’ মেম্বারশিপে লড়াকু ছোট ইউনিয়নগুলো স্বীকৃতি পাচ্ছে না ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কর্তৃপক্ষের মুখোমুখি হতে পারছে না। তিনি আরও বলেন কর্তৃপক্ষ বলপূর্বক উৎপাদন ভিত্তিক মজুরি এবং আউটসোর্সিং’এর দিকে ঝুঁকছে, চলছে জবরেট কার্টেলমে্ন্টে সবের তীব্র বিরোধিতা করতে হবে।
ইস্টার্ন রেলওয়ে এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের (এআইসিসিটিইউ ভুক্ত) প্রতিনিধি বলেন, সংগঠিত ও অসংগঠিত শিল্পের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সংগ্রামের মধ্যে মেলবন্ধন গড়ে তুলতে হবে। স্বাাধীনতার আগে রেল শ্রমিকরা চা, চট, বস্ত্র ইত্যাদি শিল্পের সংগ্রামের পাশে থেকেছেন। ১০ বছর পর কেন সম্মেলন হচ্ছে তার কারণ খুঁজতে হবে। রাজনীতিকরণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী থেকে দক্ষ সংগঠক গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। বিপন্ন পরিবেশ ও কর্মহীনতার জন্য সমাজে বেড়ে চলা অপরাধ নিয়ে ভাবতে হবে। বেসরকারিকরণ শুধুমাত্র রেলে নয়, সরকারি সব প্রতিষ্ঠানে হছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আউটসোর্সিং ও ঠিকাদারি প্রথা চলছে। রেলের প্রতিটি বিভাগে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে, এর সংখ্যা ৮ লক্ষের মতো হবে। নৈহাটি, কাঁচড়াপাড়া ওয়ার্কশপে ঠিকা শ্রমিকদের সাথে যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
সব শেষে বিদায়ী সম্পাদক বলেন সম্মেলনে বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ক্ষেত্র থেকে উপস্থিত ছিলেন ১১৯ জন প্রতিনিধি। তিনি বলেন শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়নের উপর যে হামলা নেমেছে তার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বাধীন কর্মসূচির পাশাপাশি যৌথ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিতে হবে। এছাড়াও ১৫টি দাবির কথা উল্লেখ করে, নিজের নিজের ক্ষেত্রে এই দাবিগুলো নিয়ে সোচ্চার হওয়ার জন্য আবেদন করেন।
পঞ্চম উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলনে গৃহীত দাবিসমূহ।
১) কেন্দ্রীয় সরকার চার শ্রমকোড বাতিল কর।
২) রাজ্য সরকারের শ্রম কোড রুলস তৈরি করা চলবে না।
৩) ব্যাঙ্ক, রেল, প্রতিরক্ষা, বিএসএনএল সহ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বেসরকারিকরণ করা বন্ধ কর।
৪) প্রতিরক্ষা শিল্পে দানবীয় ইডিএসএ বাতিল কর।
৫) রাজ্য সরকারি পরিবহনে ফ্রাঞ্চাইজি, ঠিকা প্রথা বাতিল কর।
৬) মিড-ডে-মিল কর্মীদের সরকারি কর্মী হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।
৭) নির্মাণ ও পরিবহন শ্রমিকদের প্রকল্প কাটছাঁট করা চলবে না।
৮) সব সংগঠিত, অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে।
৯) মহিলা, পুরুষ সবাইকে সম কাজে সম বেতন দিতে হবে।
১০) কর্মস্থলে মহিলাদের উপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে আইসিসি গঠন করতে হবে।
১১) অবিলম্বে চটকলের দাবি সনদের মীমাংসা করতে হবে।
১২) স্কুল নিয়োগে অভিযুক্তদের শাস্তি দাও, যোগ্যদের চাকরি দাও।
১৩) অবিলম্বে জুটমিল সহ বন্ধ কারখানা খোলা এবং মজুরি সহ সব ধরনের বকেয়া পরিশোধ করতে হবে।
১৪) অবিলম্বে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বর্ধিত ডিএ দিতে হবে।
১৫) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলুন।
সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত ৫৩ জনের কাউন্সিল, ২৭ জনের কার্যকরী কমিটি এবং ১৪ জনের কার্যনির্বাহী কমিটি রাজ্য পর্যবেক্ষক ঘোষণা করেন। এরপর শ্লোগানের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।