সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়টি মোদী সরকারের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের জন্য ১০% কোটা (সংরক্ষণ)-কে অনুমোদন করেছে। উদ্দেশ্য – অগ্রসর জাতিগুলিকে সংরক্ষণের আওতায় আনা। এই রায় ভারতীয় সংবিধানের মর্মমূলে নিহিত সংরক্ষণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে। এই রায় বঞ্চিত শ্রেণিগুলির প্রতি ঐতিহাসিক অবিচারকে আরও শক্তি জোগালো। তারই পুনরাবৃত্তি শোনা গেল বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাটের পর্যবেক্ষণে যিনি এই রায়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তিনি ভারতের প্রধান বিচারপতি ইউ ইউ ললিতের সঙ্গে সহমত হয়ে, ইডব্লুএস সংরক্ষণের রায়ে বলেছেন — “এই আদালত প্রজাতন্ত্রের সাতটি দশকে এই প্রথম স্পষ্টতই একটি বহিষ্কারমূলক ও বৈষম্যমূলক নীতিকে অনুমোদন করল। আমাদের সংবিধান বর্জনের ভাষা বলে না। আমার সুচিন্তিত অভিমত, এই রায় বাদ দেওয়ার কথা বলে সামাজিক ন্যায়ের বুনন তথা বুনিয়াদি কাঠামোর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত হেনেছে।”
ভারতীয় সংবিধান যখন আজকের চেহারা পাচ্ছিল, তখন ‘সাম্যবাদী ভারত’ গড়ার লক্ষ্যে, জনগণের বঞ্চিত অংশের জন্য সংরক্ষণের নীতি এর মধ্যে বুনে দেওয়া হয়েছিল। সেটিই প্রতিফলিত হয়েছিল ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় যা “মর্যাদা ও সুযোগের সমতার” আশ্বাস দেয়। হাজার হাজার বছরের জাতিভিত্তিক বৈষম্য ওবিসি, দলিত, আদিবাসীদের সমস্ত অধিকার ও সুযোগ কেড়ে নিয়ে তাদের সমাজের এক প্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল। বস্তুত সংরক্ষণ শব্দটি অনূদিত হয় প্রতিনিধিত্বে, ঐতিহাসিক অবিচার ও বৈষম্যের জন্য ‘বর্জিতদে’ প্রতিনিধিত্ব ও সমান সুযোগ দেওয়ার চেতনায়। এই বিষয়টিই পুনরায় উচ্চারিত হয়েছে এই ভিন্ন মতের রায়ে “নাগরিকদের মধ্যে সংবিধান-স্বীকৃত অনগ্রসর শ্রেণিগুলির সম্পূর্ণ এবং স্বেচ্ছাচারী বর্জন এবং আরও নির্দিষ্টভাবে তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়গুলির বর্জন, বৈষম্য ছাড়া আর কিছুই নয় আর সেটা পৌঁছে গেছে অন্তর্ঘাতের পর্যায়ে, এবং সমতার সংহিতা, বিশেষ করে বৈষম্যহীনতার নীতিকে ধ্বংস করছে।”
শীর্ষ আদালতের পূর্বোল্লিখিত ঐ বিকৃত রায় ভারতের জাতি ব্যবস্থা এবং বঞ্চিত সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রকাশের আসল বাস্তবতা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। সংবিধানে উল্লিখিত “অনগ্রসর” শ্রেণির জন্য সদর্থক পদক্ষেপ হিসাবে এবং নভেম্বর, ১৯৪৮-এ সাংবিধানিক পরিষদে (কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি)-র বিতর্কে বিস্তারিত আলোচনার মূলে থাকা সংরক্ষণের উদ্দেশ্য দারিদ্র্য দূরীকরণ ছিল না। বরং ছিল সামাজিক ন্যায় অর্জন। শীর্ষ আদালতের রায় তাই ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক চেতনাকে লঙ্ঘন করেছে।
সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে মোদী সরকার সংসদে সংবিধান (একশো তিনতম সংশোধন) আইন ২০১৯ পাস করে ইডব্লুএস সংরক্ষণ চালু করার চেষ্টা শুরু করেছিল। এর ফলে সরকার উচ্চতর শিক্ষা ও সরকারি কর্মসংস্থানের ব্যাপারে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে সংরক্ষণ চালু করার ক্ষমতা পেয়ে গেল। এই আইন অগ্রসর শ্রেণিগুলির জন্য সংরক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে সংবিধানে ১৫(৬) ও ১৬(৬) সন্নিবেশিত করে ১৫ এবং ১৬ নং ধারায় সংশোধন করে।
এই সংশোধনের উদ্দেশ্য তফসিলি জাতি/উপজাতি/অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিগুলির কোটাকে তলে তলে বিলুপ্ত করা, আরএসএস যা বহুদিন ধরে চেয়ে আসছে। বস্তুত বিচারপতি বেলা ত্রিবেদী এবং বিচারপতি পার্দিওয়ালা, যারা বিচারপতি দীনেশ মাহেশ্বরীর সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমত গঠন করেছেন, তারা তাদের ঐকমত্যের অভিমতে জানিয়েছেন — সংরক্ষণের বিষয়টি পর্যালোচনা করা ও তার মেয়াদের সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। সংরক্ষণ ব্যবস্থায় ক্রমশ অযথা বিলম্ব, আইনি ফাঁকফোকর খোঁজা আর অ-কার্যকর করার প্রবণতা বেড়েছে। আর এখন তাকে গোপনে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে নিরঙ্কুশ বেসরকারিকরণের মাধ্যমে।
সংবিধান কেবলমাত্র সামাজিক ও শিক্ষাগত অনগ্রসরতাকেই সংরক্ষণের ‘মানদণ্ড’ হিসেবে স্বীকার করে। অন্যভাবে বলতে গেলে, সংবিধান সেই নীতিকেই স্বীকার করে যে নীতি অনুসারে সংরক্ষণ অর্থনৈতিক বঞ্চনা প্রশমনের কোনো উপায় নয়, শুধুমাত্র প্রথানুগ সামাজিক ও শিক্ষাগত বৈষম্য ও বর্জনকে (কিছুটা পরিমানে) কমাতে পারে। উচ্চ বর্ণের মানুষ, গরিব হলেও, প্রথানুগ বৈষম্য, বর্জনের শিকার, এবং শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সুযোগবঞ্চিত — এই দাবিটি কিন্তু পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান বা সমীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। কর্মহীনতা এবং দারিদ্র্য একটি স্বতন্ত্র সমস্যা এবং তার প্রতিকারের জন্য চাই কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আরও বেশি মজুরি। আর এই ক্ষেত্রেই মোদী সরকার লক্ষ্যণীয়ভাবে ব্যর্থ।
অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর অংশের (ইডব্লুএস) জন্য ১০% সংরক্ষণ — বাস্তবে এই অভিধাটির সম্পূর্ণ অপপ্রয়োগ হয়েছে। এই সংরক্ষণ নিরঙ্কুশভাবে শুধু উচ্চ বর্ণের জন্য যার উদ্দেশ্য — বঞ্চিত অংশের জন্য সদর্থক পদক্ষেপের নীতিকে গুরুত্বহীন করে দেওয়া। সত্যিই দলিত, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিগুলিকে ইডব্লুএস সংরক্ষণের দাবিদারের তালিকা থেকে স্পষ্টতই বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি যোগ্যতার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন করাও এক মস্ত প্রতারণা। শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে ইডব্লুএস সংরক্ষণ কার্যকরী করার জন্য তৈরি নিয়মাবলী অনুযায়ী, যোগ্যতা হল — বার্ষিক আয় ৮ লক্ষ অর্থাৎ মাসিক আয় ৬৭০০০ টাকা। ঐতিহাসিক জাতিভিত্তিক অবিচারের কারণে উৎপীড়িত সম্প্রদায়গুলির ভয়াবহ দারিদ্র্যের প্রতি এটা হল এক নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ! এই মাপকাঠি ‘দারিদ্র্যের’ সংজ্ঞাকে অর্থহীন করে ফেলেছে। আর উচ্চ বর্ণের গরিব ও বেকারদেরও কার্যকরী ভাবে নিশানায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে।
এসসি-এসটি-ওবিসি বহির্ভূত অংশের অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিতদের জন্য চাকরি ও শিক্ষায় কোটার ভাবনা নিয়ে সওয়ালের ব্যাপারে মোদী কোনভাবেই ‘প্রথম’ নন। ১৯৯১ সালে নরসিংহ রাও সরকার একই রকম একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। সে সময়ে “জনগণের অন্যান্য অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশ যারা সংরক্ষণের প্রচলিত পরিকল্পগুলির কোনটির আওতাভুক্ত নন” তাদের জন্য সরকারি পদের ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। শীর্ষ আদালতের ৯ বিচারপতির এক সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই পদক্ষেপকে বাতিল করে দেয়। তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল, শুধু দারিদ্র্য অনগ্রসরতার মাপকাঠি (টেস্ট) হতে পারে না এবং যে কোনো সংরক্ষণের একমাত্র সাংবিধানিক ভিত্তি হল সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাদপদতা।
সামাজিক ন্যায় ও সংরক্ষণের প্রশ্ন দুটি পরস্পরকে জড়িয়ে আছে, আর তাদের কোনোভাবেই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হিসেবে আলাদা করে দেখা যাবে না। তফসিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য সদর্থক পদক্ষেপ বা সংরক্ষণের ভাবনা ছিল বঞ্চিত সম্প্রদায়গুলির জন্য সামাজিক ন্যায় ও সামাজিক গতিশীলতা সম্পর্কে ডঃ বি আর আম্বেদকরের স্বপ্নের একেবারে সার অংশ — প্রাণ ভোমরা। মোদী সরকার এবং আরএসএস একদিকে আম্বেদকরের দখলদারি নিতে ব্যস্ত আর অন্যদিকে উৎপীড়িত জাতিগুলির জন্য সংরক্ষণের প্রয়োজন সম্পর্কিত তাঁর মৌলিক ভাবনাকেই খারিজ করে দিচ্ছে!
ইডব্লুএস সংরক্ষণ, এইভাবে সংরক্ষণ ব্যবস্থার মধ্যে আরেকটা সমান্তরাল কাঠামো তৈরি করছে যার স্পষ্ট উদ্দেশ্য হল জাতিপ্রথা চালু করা এবং সমাজের ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত অংশের বিরুদ্ধে বৈষম্যকে আরও ঘনীভূত করা!
মোদী সরকার, যা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এখন ইডব্লুএস সংরক্ষণকে ব্যবহার করছে এক বেপরোয়া অপসারণ কৌশল হিসেবে। সদর্থক পদক্ষেপ চাকরিগুলোকে মোটেই ধীরে ধীরে গ্রাস করে নেয়নি – মোদী এবং আরএসএস মানুষকে যেটা বিশ্বাস করাতে চাইছেন। সরকার চাকরিগুলো, দেশবাসীর জীবনের মতোই , বলি দিয়ে চলেছে কর্পোরেট মুনাফাবাজি এবং তাদের দেশের সম্পদ লুণ্ঠনের বেদীতে। আজ ভারতে বেকারত্বের হার লাফিয়ে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৭৭ শতাংশে, যখন প্রতিদিন আরও আরও বেশি মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। তাদের এইভাবেই দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
আমাদের অত্যন্ত কঠোরভাবে ১০ শতাংশ ইডব্লুএস সংরক্ষণের বিরোধিতা করতে হবে কারণ এটি সংবিধানের চেতনার ভয়ঙ্কর লঙ্ঘন এবং সামাজিক ন্যায়ের নীতির প্রতি এক কুৎসিত বিদ্রুপ। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য চাই আরও কর্মসংস্থান, চাই অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন। আর তা অর্জন করতে হলে থামিয়ে দিতে হবে মোদী সরকারের নির্লজ্জ কর্পোরেট-ভজনা এবং বেসরকারিকরণের উৎকট উন্মাদনা!
(এমএল আপডেট সম্পাদকীয় ৮ নভেম্বর ২০২২)