প্রস্তাবিত বিমানবন্দরের জন্য জমি না দেওয়ার অঙ্গীকার আজমগড়ের কৃষকদের
land for proposed airport

“এখানে বিমানবন্দরের প্রস্তাবিত স্থলের জন্য আমরা আমাদের জমি দেবো না। এটা তোমাদের উন্নয়ন হতে পারে, কিন্তু আমাদের জন্য সর্বনাশ।… শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমরা লড়াই করে যাব, কেননা, এটা আমাদের অস্তিত্বের লড়াই।” হিন্দিতে এই কথাগুলো লেখা ছিল উত্তরপ্রদেশের আজমগড় জেলার মান্দুরি গ্ৰাম সংলগ্ন রাস্তায় টাঙানো ফ্লেক্স বোর্ডে। আজমগড়ে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণের কথা জানতে পেরে আটটা গ্ৰামের কৃষকরা একযোগে প্রতিবাদে নেমেছেন। সরকারের চোখে এবং নীতিতে যা উন্নয়ন, কৃষক ও গ্ৰামবাসীদের কাছে তা সর্বস্ব খুইয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার পথ। যে ভূমিতে তাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন এবং যে জমি তাঁদের কাছে জীবিকার মূল উৎস, বসবাসের সেই স্থল ও চাষবাসের সেই জমি থেকে উচ্ছেদ হতে হলে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ দুইই নিমজ্জিত হয় অতল অন্ধকারে। ভিটে থেকে উচ্ছেদ হয়ে কোথায় যাবেন, জীবিকার সন্ধান কী হবে, কৃষক হওয়ায় পরিবারের অঙ্গ হিসাবে গবাদি পশুদের হাল কী হবে — এসব প্রশ্নই জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার মুখে দাঁড়ানো মানুষদের চিন্তাচ্ছন্ন করে, তাঁদের খাওয়া-ঘুম চলে যায়, আতঙ্ক তাঁদের তাড়া করে বেড়ায়। জমি নেওয়ার জন্য সরকারের তরফে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা অবশ্য থাকে — কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কিছু নগদ টাকার হস্তান্তরে পরিণত হয়, নতুন জীবিকার সংস্থান সরকারি কর্তব্যের বাইরে থেকে যায়, যথার্থ পুনর্বাসনের লক্ষ্যে সরকার কখনই নিজেকে চালিত করে না। নানান ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া বহু মানুষ আজও প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণ থেকে বঞ্চিত হয়ে রয়েছেন, যথার্থ পুনর্বাসন তো দূরের কথা। প্রকৃত পুনর্বাসনের এই দুর্লভতারই উন্মোচন ঘটেছে জমি দিতে অসম্মত এক কৃষকের কথায়, “আমাদের হয়তো ফ্ল্যাটের সঙ্গে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, কিন্তু গরু-মোষেরা কোথায় যাবে? তাদেরও কি ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত করা হবে?” সাধারণ জনগণকে সরকার কতটা অবহেলার চোখে দেখে, এই কৃষকের কথায় তারই প্রতিফলন এবং তারমধ্যে প্রতিভাত উচ্ছেদ হওয়া বহু মানুষের প্রতিকূলতার অভিজ্ঞতা।

পাঁচটা বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার এ’বছরের জুলাই মাসে ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। প্রস্তাবিত এই বিমানবন্দরগুলো হল — আজমগড়, আলিগড়, চিত্রকূট, সোনেভদ্র ও শ্রাবস্তি। আজমগড়ে বিমানবন্দরের জন্য প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজন হবে ৩৬০ একর ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৩১০ একর জমির। এই জমি নেওয়ার পরিকল্পনা আটটা গ্ৰাম থেকে এবং সেগুলো হলো হাসানপুর, কাদিপুর, হরিকেষ, জামুয়া হরিরাম, জামুয়া জোলহা, গদনপুর চিন্দনপট্টি, মান্দুরি জিগিনা করমপুর ও জেহরা পিপরি। জমি অধিগ্রহণের জন্য সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি না হলেও সরকারি কতৃপক্ষ পরপর দু’দিন জমি সমীক্ষায় অংশ নেয়। প্রথম দিন, ১৩ অক্টোবর ২০২২ মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট (এসডিএম) পুলিশ বাহিনী ও পিএসি’র সশস্ত্র সদস্যদের নিয়ে জামুয়া গ্ৰামে জমি সমীক্ষায় আসেন। কিন্তু ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ককে বয়ে বেড়ানো ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ জনগণ তাদের ঘিরে ধরলে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ১৪ অক্টোবর আবার বৃহত্তর বাহিনী নিয়ে হাজির হয় জমি সমীক্ষার উদ্দেশ্যে। পরিকল্পনা মতো তারা পুরুষদের ঘরে আটকে রাখে, কিন্তু মহিলারা সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন এবং পুলিশ বাহিনী তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। এই ঘটনার পর জামুয়া, জিমিয়া, হাসানপুর, করিমপুরের গ্ৰামবাসীরা একযোগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র ও বিমানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে ১৪ অক্টোবরের পুলিশি বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তাঁরা জমি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা সমবেতভাবে স্বাক্ষর করা চিঠিতে জানিয়েছেন, বহু সংখ্যক ‘অসম্মতি পত্র’ পাঠিয়েছেন এবং জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ধরনা সংগঠিত করেছেন। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন — জমি দিতে তাঁদের অসম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে সমীক্ষার প্রয়োজন কি আদৌ রয়েছে? তাঁদের আরও প্রশ্ন — আজমগড় থেকে কয়েক ঘন্টার দূরত্বে রয়েছে বেনারস, কুশিনগর, গোরখপুর, অযোধ্যা ও লক্ষ্ণৌ বিমানবন্দর। সেক্ষেত্রে আজমগড়ে বিমানবন্দর নির্মাণ কি একান্তই আবশ্যক? উল্লিখিত ব্যক্তিদের কাছে লেখা চিঠিতে তাঁরা তাঁদের উন্নয়নের আকাঙ্খার রূপরেখাকে তুলে ধরে বলেছেন, “আমরা বিমানবন্দর চাই না, কিন্তু ভালো স্কুল, হাসপাতাল ও একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাই।”

Azamgarh farmers pledge

বিমানবন্দর নির্মাণের নামে উন্নয়নের যে মডেলের প্রয়োগ যোগী সরকার উত্তরপ্রদেশে ঘটাতে চাইছেন তা গণতন্ত্র এবং তার সাথে জনস্বার্থেরও বিরোধী। জমি অধিগ্রহণের প্রশ্নে জমির মালিক কৃষকের সম্মতিকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করা হচ্ছে। কৃষকদের মতামতকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে জমির ওপর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে খারিজ করা হচ্ছে। জমি শুধু কৃষকের নয়, কৃষি শ্রমিকেরও জীবিকার উৎস। সেই জীবিকাকে উৎসর্গীকৃত করা হচ্ছে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির চূড়ান্ত লক্ষ্য কর্পোরেট স্বার্থের বেদীমূলে। আজমগড়ের কৃষকরাও বলছেন, কর্পোরেট কর্তা ও রাজনীতিবিদরা পারস্পরিক স্বার্থের বন্ধনে আবদ্ধ, এবং কর্পোরেটদের অর্থনৈতিক স্বার্থই যোগী সরকারকে চালিত করছে ‘উন্নয়ন’এর বিমানবন্দর নির্মাণের পথে যা দাঁড়িয়ে রয়েছে সমগ্ৰ কৃষক স্থার্থের বৈপরীত্যে। কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়েরই জীবিকার অধিকার এইভাবে রাষ্ট্রের চালানো উন্নয়নের রথের চাকায় নিষ্পেষিত হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী যেমন সংসদীয় গরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করছেন সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই নিজেদের কাঙ্খিত প্রকল্পগুলোকে অবাধে চালিত করতে, উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকারও বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর ভিত্তি করে কৃষক জনগণের সমবেত প্রতিরোধের বিরুদ্ধেই নিজেদের দাঁড় করাচ্ছে। মোদী সরকারের তৈরি তিন কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা আজমগড়ের কৃষকদের প্রতিরোধে সমর্থন জানিয়েছে এবং তারাও কৃষকদের সমর্থনে প্রতিবাদ সংগঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া, সমাজবাদী পার্টি, কংগ্ৰেস, বিএসপি’র মতো বিরোধী পক্ষের দলও কৃষকদের জমি দানের অসম্মতির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। দেড় দশক আগে পশ্চিমবাংলাতেও জমির ওপর কৃষকের অধিকার বনাম কর্পোরেট স্বার্থে জমি অধিগ্রহণের সংঘাত মঞ্চস্থ হয়েছিল। টাটার কেশাগ্ৰ কাউকে স্পর্শ করতে দেওয়া হবে না বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সদম্ভ হুঙ্কারের পর তাদের যাবতীয় আত্মম্ভরিতাকে ধুলোয় মিশে যেতে আমরা দেখেছিলাম। আজমগড়ের কৃষকদের প্রতিরোধ শেষমেষ কোন পরিণতি পায় তার দিকে আমরা অবশ্যই সাগ্ৰহে তাকিয়ে থাকব।

– জয়দীপ মিত্র

খণ্ড-29
সংখ্যা-44