গত ৯-১০ নভেম্বর ২০২২ রাঁচির পুরনো বিধানসভা হলে ২ দিন ব্যাপি অল ইন্ডিয়া কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের জাতীয় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। শহীদদের স্মরণ করার পর, ঝাড়খন্ডের জনজাতির গণসাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। উদ্বোধনী ভাষণ রাখেন এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সম্পাদক রাজীব ডিমরী। কর্মশালায় মোট ৫টি পেপার রাখা হয় –
এই পেপারগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। গ্রুপ ডিসকাশন হয় যা বিশেষ উল্লেখজনক।
ভারতবর্ষে নির্মাণ শিল্প একটি শ্রম-নিবিড় শিল্প যেখানে প্রায় ৪ কোটি নথিভুক্ত নির্মাণ শ্রমিক দেশের জিডিপি অর্জনে বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। ২০১৬ সালে আমাদের দেশে ১৫৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ব্যবসা হয়েছে। এবং আশা করা হচ্ছে আগামী ১০ বছরে ৮-১০ শতাংশ হারে এই শিল্পের বিকাশ হবে। নির্মাণ শিল্প মূলত দু’টি ভাগে বিভক্ত —(১) পরিকাঠামো, (২) রিয়েল এস্টেট। এই শিল্পে এখন দেশী-বিদেশী কর্পোরেটরা প্রবেশ করেছে। কিছু উদাহরণ — যেমন এলঅ্যান্ডটি, ডিএলএফ, এসএএফএএল, এসএভিভিওয়াই, এএফসিওএনএস। বিদেশি সংস্থার মধ্যে বিইসিএইচটিএএল (মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র), হুন্ডাই (জাপান), মিৎসুই (জাপান), ওবাইশি (জাপান), স্যান্ডেসা (সুইডেন), টারফেল হাউস (ইউকে), দুবাই পোর্ট ওয়ার্ল্ড। এছাড়াও আরো অনেক বড় বড় কোম্পানি এই শিল্পে যুক্ত আছে এবং রেডিমিক্স কোম্পানি গড়ে উঠেছে। যেখানে লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক কাজ করে, তাদের মধ্যে বড় সংখ্যক নির্মাণ শ্রমিক হল পরিযায়ী শ্রমিক। বড় বড় নির্মাণ শিল্পে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু ও স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এ যেন এক মৃত্যু উপত্যকা। আইএলও’র রির্পোট অনুযায়ী এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রতিবছর এক লাখে ১২.৭ জন নির্মাণ শ্রমিক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এছাড়াও পেশাগত রোগে প্রতি বছরে লক্ষ লক্ষ নির্মাণ শ্রমিক মারা যায় কর্তৃপক্ষের নির্মম অবহেলার জন্য। এদের থেকে কোনো সংগ্রামী ইউনিয়ন কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। যাই হোক, আমাদের কাজের অভিজ্ঞতা হল, ১৯৯৬ সালে নির্মাণ শ্রমিকদের জন্য দুটো আইন হওয়ার পর তাঁদের অধিকার অর্জনে সংগঠিত করতে থাকি যারা মূলত স্বনিয়োজিত বা ছোট নির্মাণকাজে যুক্ত থাকতেন। পরবর্তীতে, ক্রমশ সামাজিক সুরক্ষা প্রদান হ্রাস পেতে পেতে ও সমস্ত কিছু অনলাইনে চালু হওয়ায় ইউনিয়নের ভূমিকা কমতে থাকে। বর্তমানে শ্রমিকদের কাছে ইউনিয়ন সামাজিক সুরক্ষা আদায়ের মাধ্যম (এজেন্ট) হিসাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের নেতাদের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে একমাত্র নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা আদায় করার জন্য ফর্ম ফিলাপ করা ও সরকারি দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা। সামাজিক সুরক্ষায় ঘাটতি, অনলাইন চালু হওয়া ও ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব হয়ে পড়ায় নির্মাণ শ্রমিকদের জমায়েত কমতে শুরু করেছে। শ্রেণী-চেতনা ও শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে উঠছে না।
বর্তমানে ৪টি লেবার কোড হওয়ার পর যে যে পরিবর্তন এসেছে তাকে অনুধাবন করতে না পারলে পুরনো ধারায় কাজের অনুশীলন থাকলে ইউনিয়নে নতুন প্রাণের সঞ্চার হবে না ও গতিরুদ্ধতায় পড়ে যাবে। নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদে নথিভুক্ত ৪ কোটি নির্মাণ শ্রমিক সহ সমগ্র শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষার ১৫টি আইন ছিল তা কেন্দ্রীয় সরকার ১টি লেবার কোডে অন্তর্ভুক্ত করছে। সামাজিক সুরক্ষা ২০২০ পেশাগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কাজের অবস্থার কোড ২০২০, নির্মাণ শ্রমিকদের আইন ১৯৯৬ ও সেস আইনের ওপর বড় ধরনের আঘাত নামিয়ে এনেছে। সামাজিক সুরক্ষা এবং পেশাগত সুরক্ষা, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থার কোডে ধারা-১ ও সামাজিক সুরক্ষা কোড নির্মাণ শ্রমিকের সংজ্ঞা নির্ধারণে ভ্রম তৈরি করেছে। আগে ছিল, যে শ্রমিক বছরে ৯০ দিন নির্মাণ কাজে যুক্ত থাকবে তাকেই নির্মাণ শ্রমিক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। বর্তমান কোডে বলা হচ্ছে, যে নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে ১০ জনের কম শ্রমিক কাজ করবে তাদের নির্মাণ শ্রমিক নয়, অসংগঠিত শ্রমিক হিসাবে চিহ্নিত করা হবে। এছাড়াও নানাভাবে নির্মাণ শ্রমিকদের অসংগঠিত শ্রমিককে পরিণত করার নানা ফাঁকফোকর বর্তমান কোডে আছে। সুতরাং বর্তমান কোড অনুযায়ী যারা নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে নির্ধারিত হবেন তারাই নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ থেকে সামাজিক সুরক্ষা পাবে। ফলে আমাদের কাজের ৯০ শতাংশ নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের ই-শ্রম একটি নোডাল এজেন্সি মারফত সমস্ত সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করার কথা বলে, বিভিন্ন আইন মোতাবেক নির্মিত বোর্ডগুলো যেমন — নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ, বিড়ি সহ অন্যান্য বোর্ডকে অকার্যকর করতে চাইছে। বোর্ডগুলোতে গচ্ছিত হাজার হাজার কোটি টাকা শেয়ার মার্কেট বা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রদান করে কর্পোরেটদের শক্তি যোগাতে চাইছে। সামাজিক সুরক্ষার দায় মালিক ও সরকার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে বিমা কোম্পানির হাতে তুলে দিতে চাইছে। শ্রমিকরা পয়সা না দিতে পারলে সামাজিক সুরক্ষা পাবে না। যখন বোর্ড’ই থাকবে না তখন সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকরা অনথিভুক্ত হয়ে পড়বে। সামাজিক সুরক্ষা পাওয়া অন্তরায় হয়ে যাবে। সুতরাং ই-শ্রমে আমাদের নির্মাণ শ্রমিকদের নাম নথিভুক্ত করাটা একটা আবশ্যিক কাজ হয়ে পড়ছে। এ ব্যাপারে ১০ নভেম্বর ২০২২ দেশব্রতী পত্রিকায় এআইসিসিটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি ভি শংকরের লেখাটা সমস্ত সংগঠকদের অবশ্যই পাঠ করে নিতে হবে।
বর্তমানে ফ্যাসিষ্ট বিজেপি সরকার যখন ৪টি লেবার কোড মারফত শ্রমিকদের অধিকার হরণে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে। তখন সমস্ত নির্মাণ শ্রমিকদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এপ্রশ্নের জেলা ও ব্লক কমিটিগুলোকে শক্তিশালী ও নিয়মিতকরণ করতে হবে। জিডিপি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে বড় বড় নির্মাণ শিল্প মূল শিল্প হিসাবে দেখা যাচ্ছে। সুতরাং শ্রমিকদের অধিকার হরণে কেন্দ্রীয় সরকারের যে ভয়ংকর আক্রমণ শ্রমিকদের উপর নামিয়ে এনেছে তাকে মোকাবিলা করতে আমাদের ইউনিয়নের কাজকেও বড় বড় নির্মাণ শিল্পে মনোনিবেশ করতেই হবে। কাজটা কঠিন কিন্তু এই কাজটা আজকের সময় আবশ্যিক। ই-শ্রমের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার যখন সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিককে প্রায় ১২৬ ধরনের শ্রমকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনতে চাইছে, তখন আমাদেরও নয়া ফোরাম তৈরি করে সমস্ত অসংগঠিত শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করে জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে হবে। সামাজিক সুরক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি করা ও সরকার ও মালিকদের দায় নিতে বাধ্য করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্মাণ শ্রমিকদের আইনি অধিকার ও নির্মাণ শ্রমিকদের নতুনভাবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা রচিত হচ্ছে সে ব্যাপারে নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠকদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে রাজ্যস্তরেও উপরোক্ত ৫টি পেপার নিয়ে ওয়ার্কশপ (কর্মশালা) সংগঠিত করতে হবে। আসুন, পুরনো শক্তির উপর ভর করে নতুন দিশায় পথ চলা শুরু করি। শ্রমিক শ্রেণির শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলেই সমানাধিকার, সামাজিক সুরক্ষা, মর্যাদা, সম্মানজনক মজুরি আদায় করতে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ফ্যাসিষ্ট সরকারকে উৎখাত করার কাজ সুনিশ্চিত করে তুলি।
- কিশোর সরকার, সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ গৃহ ও অন্যান্য নির্মাণ শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন