১৯ বছর লড়াইএর পরে শ্রম ট্রাইবুনালে ঊষা কারখানার শ্রমিকদের জয়
After 19 years of struggle

আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে, ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২২-২৩-২৪ তারিখে কলকাতার প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেডের  (ঊষা সেলাই মেশিন) কারখানার সামনে জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড মজদুর ইউনিয়নের পক্ষে এআইসিসিটিইউ-র নেতা প্রয়াত কমরেড নরেন পাইন সমেত  ৪ জন সদস্য অনশন ও অবস্থান করেছিল। তাঁরা কারখানার জমি বিক্রি করার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই অনশন চালাচ্ছিল। তখন রাজ্যে প্রবল প্রতাপশালী বামফ্রন্ট সরকার, শিল্প পুনগর্ঠনমন্ত্রী শ্রমিক নেতা মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি সিটুর সহসভাপতিও ছিলেন। ঊষা কারখানার সিটু ইউনিয়নও তখন প্রায় একচেটিয়া প্রতিপত্তিশালী। যতদূর মনে পড়ছে এলাকার সিপিআই(এম) নেতা ও সিটু নেতা বিমল চ্যাটার্জী কারখানার ব্যাপারে শেষ কথা, কারখানার শ্রমিকদের ভিতর থেকে নেতা ছিলেন পেলব রায়চৌধুরী। মজদুর ইউনিয়েনের সম্পাদক ছিলেন কমরেড মন্টু ঘোষ। কারখানার জমি বিক্রির ব্যাপারে মালিকপক্ষ (সিদ্ধার্থ শ্রীরাম) বামফ্রন্ট সরকার তথা সিটুর গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে গেছে। মালিকের বক্তব্য ছিল সমস্ত শ্রমিককে রেখে দেওয়া হবে, তবে তাঁদের স্থানান্তরিত করা হবে বাঁশদ্রোনীর ঊষা ফ্যান কারখানায়। কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেছে। প্রকল্প জমা পড়ে গেছে। বিআইএফআর-এও কথাবার্তা হয়েছে। ওই জমি বিক্রির থেকে পাওয়া টাকায় জয় ইঞ্জিনিয়ারিং-কে পুনরুজ্জীবিত করা হবে।

সর্ব শক্তিশালী সিটু ও বামফ্রন্ট সরকার মেনে নিলেও, এআইসিসিটিইউ-র অন্তর্ভুক্ত জয় এঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড মজদুর ইউনিয়ন মানতে রাজি নয়। তাঁরা বুঝতে পারছিলেন, কারখানা স্থানান্তর করার পরে জমি বিক্রির টাকায় মালিক শ্রমিকদের বহাল রেখে কাজকর্ম চালু রাখবে এমনটা নয়। দ্বিতীয়ত, জমি বিক্রির টাকা কারখানায় নিয়োজিত হবে তেমনটাও নয়। তৃতীয়ত, জমি বিক্রির থেকে প্রাপ্তব্য অর্থের যে পরিমাণ দেখানো হচ্ছে ওই এলাকায় জমির দাম তার কয়েকগুণ, এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল কারখানায় নিয়োজিত আড়াইশত ক্যাজুয়াল শ্রমিকের কী হবে? যখন মজদুর ইউনিয়ন অনশনে বসতে যাচ্ছে তখন থেকেই সিটু চরম বিরোধিতা শুরু করে। বলতে থাকে নকশালরা কারখানার পুনরুজ্জীবনে বাধা দিচ্ছে ও অনশনকে তারা জোর করে তুলে দেবে। সমস্ত রকম বিরোধিতা সত্বেও অনশন চালু হয়, চলতেও থাকে।

অনশনের দ্বিতীয় দিনে মালিকপক্ষ ক্যাজুয়াল শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ নিয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়। ১২৬ জন ক্যাজুয়াল শ্রমিককে তাৎক্ষণিক স্থায়ী করার চুক্তি হয়, ও বাদবাকি শ্রমিককে পরবর্তীতে স্থায়ী করার কথা বলা হয়। মজদুর ইউনিয়ন যদিও আশঙ্কায় ছিল যে জমি বিক্রির পরে মালিকপক্ষ কথা রাখবে না এবং ফ্যান কারখানাকেও গুটিয়ে নেবে। তবুও সাধারণ শ্রমিকদের শঙ্কিত করার জন্য সিটুর প্রচার, জমি বিক্রি না হলে মালিক কারখানাকে ব্ন্ধ করে দেবে, শ্রমিকরা কাজ হারাবে, তাছাড়া মালিক তো ক্যাজয়াল শ্রমিকদের স্থায়ী করার দাবি অনেকটাই মেনে নিয়েছে,  সার্বিক বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি। যাই হোক, আলোচনা ও চুক্তির প্রেক্ষিতে অনশন তুলে নেওয়া হয়।

কারখানার জমি সমেত শ্রমিক কোয়ার্টারগুলির জমি বিক্রি হয়ে যায়। এখন সেখানে সাউথ সিটি মল ও আবাসন। বড়লোকের বসত ও বিনোদনের জায়গা। শ্রমিকরা ঊষা কারখানায় কিছু দিনের জন্য নিয়োজিত হয়। বছর ৪-৫ যেতে না যেতেই মজদুর ইউনিয়নে আশঙ্কা সত্যিতে পরিণত হয়। কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছাবসর প্রকল্প নামক শ্রমিক ছাঁটাইএর কাজ শুরু করে। প্রায় তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই অতি অল্প কিছু শ্রমিককে কাজে বহাল রেখে বাকি সকলকেই স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য করা হয়। আনাোয়ার শাহ রোডের কারখানা থেকে আসা প্রায় সকলেই স্বেচ্ছাবসরের তালিকায় থাকে। নামে স্বেচ্ছাবসর হলেও, যদি তালিকায় থাকা কেউ তা না নেয়ে তাহলে তাকে কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয় না। একদিকে কোনো ধরনের মজুরি না পাওয়া, অপরদিকে বাধ্যতামূলক স্বেচ্ছাবসর নিলে এককালীন কিছু টাকা, পিএফ ও গ্রাচুইটির টাকা পাওয়ার ভাবনা থেকে অধিকাংশ তালিকায় থাকা শ্রমিক স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করে।

এতদসত্বেও মজদুর ইউনিয়ম ভুক্ত ও সিটু ইউনিয়ন ভুক্ত কতিপয় শ্রমিক হার মানেনি, স্বেচ্ছাবসর গ্রহণ করেনি। কর্তৃপক্ষের অন্যায় ছাটাইএর বিরুদ্ধে শ্রম ট্রাইবুনালে যান। ২০০৩ সালের ১ আগস্ট থেকে তাদের ছাটাই করা হয়। ১৯ বছর পরে গত ১০ নভেম্বর শ্রম ট্রাইবুনাল রায় দিয়েছে যে যে ১০ জন শ্রমিক এখনো জীবিত রয়েছেন তাঁদের ১ আগস্ট ২০০৩ থেকে পুনর্নিয়োজিত করতে হবে, এবং গত ১৯ বছরের সমস্ত মজুরি ও সুবিধে দিতে হবে। যারা মারা গিয়েছেন তাঁদের প্রয়াণের দিন পর্যন্ত প্রাপ্য মজুরি ও সুবিধে তাঁদের উত্তরাধিকারীদের দিতে হবে। এসব ৬০ দিনের মধ্য কোম্পানিকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মজদুর ইউনিয়েনের সেদিনের লড়াই কত যথার্থ ছিল কর্তৃপক্ষের আচরণ তা প্রমাণ করেছে। বামফ্রন্ট সরকার যে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ তাও পরিষ্কার। অপরদিকে সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা সিটু আদতে মালিকের স্বার্থ দেখতেই পারদর্শী তাও জয় ইঞ্জিনিয়ারিংএর ঘটনায় খোলামেলা হয়েছে।

তথাপি, কয়েকজন লড়াকু শ্রমিক নিজেদের অধিকার বুঝে নেওযার জন্য শত প্রলোভন ও অভাব সত্বেও লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন ১৯ বছরের বেশি সময় ধরে সেটা এক ঘন মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎরেখা। তাঁদের জানাই কুর্নিশ।

খণ্ড-29
সংখ্যা-45