(নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্যকে মনে রেখে এই লেখাটি প্রকাশিত হল আগের লেখাটির ধারাবাহিকতায়।)
১৯১৭’র নভেম্বর বিপ্লবে বিজয়ের পরে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের মুখে শ্রমিক ও কৃষকদের নতুন সরকারকে পড়তে হয়েছিল, তার অন্যতম ছিল রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ।
রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর সূচনাকাল বেশিরভাগ ঐতিহাসিক ১৯১৮’র মাঝামাঝি থেকে ধরতে চান এবং মনে করেন ১৯২০ পর্যন্ত তা চলেছিল। কিন্তু অনেকের মতে অক্টোবর বিপ্লবের অব্যবহিত পর থেকেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধর সূচনা ধরা উচিত, কেননা তখন থেকেই বলশেভিকদের রাশিয়ার নানা ফ্রন্টে নানা শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিল। এটা ঠিক যে ১৯১৭’র ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় বলশেভিক পার্টির সদস্যসংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র চব্বিশ হাজার, সেটা অক্টোবর বিপ্লবের সময় বেশ কয়েকগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল তিন লক্ষতে। কিন্তু রাশিয়ার বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় শুধু নয়, রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের হিসেবেও সংখ্যাটা ছিল বেশ কম। উপরোন্ত বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার মধ্য ও উত্তর পশ্চিম অংশে যতটা ছিল, অন্যত্র ততটা ছিল না। শ্রমিকদের মধ্যে এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে যথেষ্ট প্রভাব থাকলেও কৃষকদের মধ্যে বলশেভিকদের প্রভাব ছিল তুলনায় কম এবং সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারিদের (এসআর) কৃষকদের ওপর প্রভাব ছিল অনেক বেশি।
অক্টোবর বিপ্লবের কয়েকদিনের মধ্যেই বলশেভিকদের প্রধান ক্ষমতাকেন্দ্র পেত্রোগ্রাদে কিছু তরুণ ইয়ুঙ্কার কাদেত বিদ্রোহ করে। জেনারেল ক্রাসনভের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কসাক রেজিমেন্টের একটি অংশও বিদ্রোহী হয়। সেনাবাহিনীর অন্য একটি অংশ বলশেভিক পন্থী আন্তোনোভ ও কর্ণেল মুরাভিয়েভের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহকে দমন করে। মস্কো শহরে বেশ কিছুদিন রাস্তায় রাস্তায় চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। মধ্য ও উত্তর পশ্চিম রাশিয়ার অন্যান্য প্রধান শহরগুলিতে বলশেভিকরা ক্ষমতা দখল করতে পারে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, কিন্তু এজন্য তাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল। বছর শেষ হবার আগেই রাশিয়ার পঁচাত্তরটি প্রদেশ ও অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গায় বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৯০০টি সোভিয়েতে বলশেভিকদের শক্তি ক্রমশই বাড়তে থাকে। কিন্তু ককেশাস অঞ্চল, ফিনল্যান্ড, ইউক্রেনের চারটি প্রদেশ এবং কসাক অধ্যুষিত ওরেনবার্গ, ডন ও কুবান অঞ্চল বলশেভিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যায়। ডন অঞ্চলে বলশেভিক বিরোধী অংশের নেতৃত্বে ছিলেন কসাক নেতা জেনারেল আলেক্সি কালেদিন।
বিপ্লবের অব্যবহিত পরে ঘোষিত ডিক্রিগুলি একান্ত বলশেভিক নীতির বদলে সাধারণ সোভিয়েত নীতি হয়ে ওঠায় বলশেভিক সরকারের জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়েছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় ডিক্রিটিতে বলশেভিকরা নিজেদের জমির জাতীয়করণ ও সোশালিস্ট ফার্ম গঠনের নীতির বদলে জমিদারদের জমি অধিগ্রহণ করে চাষীদের মধ্যে তা বন্টনের এসআর নীতিমালাটিই গ্রহণ করেছিল। এসআর’দের মধ্যেও একটা বিভাজন হয় এবং বামপন্থী এসআর’রা বলশেভিকদের কাছাকাছি চলে আসে ও সরকারে অংশগ্রহণ করে। এরফলে বলশেভিকদের কাজ অপেক্ষাকৃত মসৃণ হয়। এসআর ও বলশেভিকরা ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি অনেকটা হীনবল হয়ে পড়েছিল। বিশেষত মধ্য ও দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শিবির প্রতিদিন তাদের সমর্থন ও জনভিত্তি হারাচ্ছিল।
বিপ্লবের সময় রাশিয়ার জনসংখ্যা ছিল ষোল কোটি মত। তার একটা অপেক্ষাকৃত ছোট অংশ, দু’কোটি ষাট লাখ মতো বিভিন্ন শহরে থাকত, জনসংখ্যার বড় অংশটিই ছিল গ্রামে। গ্রামে এসআর’দের শক্তি অনেক বেশি থাকলেও শহরে বলশেভিকদের প্রভাব ছিল বেশি। শহরাঞ্চলে সাংবিধানিক গণতন্ত্রী কাদেতদের প্রভাব দ্রুত কমছিল। সংবিধান সভার নির্বাচনে শহরাঞ্চলে কাদেতরা পেয়েছিল ২৪ শতাংশ ভোট আর বলশেভিকরা পেয়েছিল ৩৬ শতাংশ ভোট। তবে শহরাঞ্চলগুলিতে বলশেভিকদের জনপ্রিয়তা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছিল এবং সমীকরণ বলশেভিকদের অনুকুলে প্রতিদিন বদলে যাচ্ছিল। পেত্রোগ্রাদে বলশেভিকরা পেয়েছিল ৪৫ শতাংশ ভোট, মস্কোতে তা ৫০ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছিল। সব মিলিয়ে শহরাঞ্চলের চার কোটি ভোটের মধ্যে বলশেভিকরা এক কোটি চল্লিশ লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছিল। সংবিধান সভার ভোটে প্রায় ৫০ লক্ষ সেনা ভোট দেন এবং সেই ভোটের মধ্যে বলশেভিকরা পায় ৪২ শতাংশ। এসআর’রাও ৪১ শতাংশ ভোট পায়। রাজধানী পেত্রোগ্রাদে সেনাবাহিনীর অবশ্য বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ ছিল। সেখানে বলশেভিকরা পায় ৮০ শতাংশ ভোট ও এসআর’রা পায় ১২ শতাংশ ভোট। মস্কোতেও সেনাবাহিনীর ভোটের ৮০ শতাংশ পায় বলশেভিকরা, এসআর’রা পায় ৬ শতাংশ।
প্রাথমিক সাফল্যের পর বলশেভিকদের রাজনৈতিক বিরোধিতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়, যখন জানুয়ারি মাসে আহুত সংবিধান সভা তারা প্রথম রাতের অধিবেশনের পরেই ভেঙে দিল এতে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়। কিন্তু সংবিধান সভা ভেঙে দেবার পরে এই বোঝাপড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তা চরমে ওঠে এই সময়েই চলা ব্রেস্ট লিটোভস্ক চুক্তিকে কেন্দ্র করে। এসআর’রা এর তীব্র বিরোধিতা শুরু করে। জার্মান রাষ্ট্রদূতকে তারা হত্যা করার পর তাদের সরকার থেকে বের করে দেওয়া হয় ও ধরপাকড় শুরু হয়। বলশেভিকদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এই সময় থেকে আবার বাড়তে থাকে।
কিন্তু রাশিয়া জুড়ে বলশেভিকদের উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সময়ে ভেতরের এই রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এককভাবে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটানোর মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হতে পেরেছিল জারপন্থী সেনাপ্রধানদের সক্রিয়তা এবং বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মধ্যে দিয়ে। ১৯১৭’র ব্যর্থ অগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই কার্ণিলভ বন্দী ছিলেন পেত্রোগ্রাদ থেকে চারশো মাইল দূরবর্তী সেনার সদর দপ্তর মগলিয়েভের নিকটবর্তী এক কারাগারে। বিপ্লবের সময় মগলিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিজেকে অস্থায়ী সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন দুখোনিন নামের এক তরুণ সেনাপতি। তিনি রাজনৈতিকভাবে ছিলেন বলশেভিক বিরোধী। মধ্যপন্থী এসআর’দের একটি অংশ পেত্রোগ্রাদ বলশেভিকদের হাতে চলে যাবার পর মগলিয়েভে চলে আসেন এবং দুখোনিনের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে একটি বলশেভিক বিরোধী ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ার চেষ্টা চালাতে থাকেন। বিপ্লবের ছাব্বিশদিন পর ট্রেন বোঝাই করে বলশেভিক লাল রক্ষীরা মগলিয়েভে পৌঁছন, বাল্টিক সাগরের নৌ-সেনারাও চলে আসেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বলশেভিক সরকার নির্বাচিত নয়া সেনাপ্রধান ক্রাইলেঙ্কো। দুখোনিন রাস্তাতে একদল জনতার ক্রোধের সামনে পড়েন এবং তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তারা হত্যা করে। দুখোনিনের পতন হলেও নয়া সেনাপ্রধান ক্রাইলেঙ্কো মগলিয়েভে আসার ঠিক আগের দিন মগলিয়েভের দশ মাইল দূরে অবস্থিত সেনা কারাগার বাইখোভ জেল থেকে কার্ণিলভ পালিয়ে যান। তার সঙ্গেই পালান লুকোমস্কি, দেনিকিন, মার্কভ সহ অগস্ট প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের অন্যান্য অনেক বন্দী সেনাপতি। তারা বুঝলেন মধ্য রাশিয়ায় তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ৬০০ মাইল দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তারা চলে যান দক্ষিণ পূর্ব রাশিয়ায় ডন নদী তীরবর্তী কসাকদের এলাকায়। এই বাইকভ বন্দীরাই এরপর গড়ে তুললেন ‘শ্বেতরক্ষী বাহিনী’ এবং গৃহযুদ্ধ শুরু করলেন আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তির মদতে। রাশিয়ার রক্ষণশীল চার্চ এবং দক্ষিণপন্থী বলশেভিক ও সমাজতন্ত্র বিরোধীশক্তিগুলিও তাদের মদত জোগাতে থাকল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ও জারের রাশিয়া যেহেতু একপক্ষে থেকে জার্মানদের বিরুদ্ধে লড়ছিল, তাই রাশিয়াকে অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করার জন্য উত্তরে ফিনল্যান্ড সীমান্তের কাছে মার্মাস্কে একটি বন্দর ও মার্মাস্ক থেকে পেত্রোগ্রাদ অবধি একটি রেল লাইন তৈরি করা হয়েছিল। ব্রেস্ট লিটোভস্ক সন্ধির সময় থেকে এখানে ব্রিটিশরা সেনা মোতায়েন করে। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্মাস্ক যেন জার্মানদের হাতে চলে না যায়। পরে বলশেভিকদের হাতেও এর নিয়ন্ত্রণ যেন না যায়, সেই চেষ্টাও তারা চালিয়ে যায়। এই সময়েই আর্খানজেলেক্সে মার্কিন সহায়তায় শ্বেতরক্ষী বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে ও ব্রিটিশরা তাদের মদত দিতে থাকে। রাশিয়া সীমান্তের কাছে নানা বিদেশী শক্তি সেনা সমাবেশ করে। এরমধ্যে ছিল ২ ডিভিশন ব্রিটিশ সেনা, ২ ডিভিশন জাপানী সেনা, এক ব্রিগেড কানাডিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড মার্কিন সেনা, এক ব্রিগেড ইতালিয়ান সেনা, এক ব্রিগেড চিনা সেনা, ২ ব্যাটেলিয়ন ফরাসী সেনা ও এক লিজিয়ন চেক সেনা।
ব্রিটিশরা ১৯১৮ সালের অগস্টে বাকু বা আজারবাইজান দখল করে এবং সেখান থেকে ক্রমশ ছড়াতে থাকে। ১১ নভেম্বরে জার্মানীর আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এর সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশরা রাশিয়ার শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও নানা সাহায্য দিয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করতে শুরু করে। জানুয়ারি ১৯১৯এ বলশেভিক বিরোধী শ্বেতরক্ষীদের সংখ্যা হয় তিন লক্ষ এবং মার্চ ১৯১৯’র মধ্যেই তা পাঁচ লক্ষে পৌঁছে যায়। ব্রিটিশরা শ্বেতরক্ষী বাহিনীর হাতে দশ লক্ষ রাইফেল, পনেরো হাজার মেশিনগান, সাতশো সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাঙ্ক এবং প্রচুর গোলাবারুদ, পোশাক ও অন্যান্য নানা সামগ্রী তুলে দেয়। ফ্রান্স থেকেও তাদের জন্য সাহায্য আসে। বিশ্বযুদ্ধ শেষে ষাট হাজার সেনাসমৃদ্ধ চেক লিজিয়নও শ্বেতরক্ষী বাহিনীর হয়ে বলশেভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
১৯১৯ সাল জুড়ে শ্বেতরক্ষী বাহিনীর তিনদিক থেকে বলশেভিক নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় রাশিয়া ও মস্কো, পেত্রোগ্রাদের মতো রাজনৈতিক কেন্দ্রগুলির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। দক্ষিণ দিক থেকে অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন দেনিকিন। পূর্ব দিক থেকে আসা বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কোলচাক এবং উত্তর পশ্চিম দিক থেকে আসা শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতা ছিলেন ইউদেনিচ। ১৯১৯ সালের মাঝামাঝি ইউক্রেনের ক্রিমিয়া সহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্রোহ হয় এবং এর নেতৃত্ব দেন ইউক্রেনের অ্যানার্কিস্ট নেতা নেস্টর মাখনো। মাখনো বলশেভিক ও শ্বেতরক্ষীবাহিনী উভয়েরই বিরোধী ছিলেন তবে গৃহযুদ্ধের একটা পর্বে শ্বেতরক্ষীদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ে তোলেন। সেই সমঝোতা আবার ভেঙেও যায়। ইউক্রেনের শ্বেতরক্ষীবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন পিওতর ওয়ার্যাঙ্গেল।
এই সময় বলশেভিকদের রেড আর্মির নেতা ছিলেন লিও ট্রটস্কি। তিনি বুঝেছিলেন পিপলস মিলেশিয়া দিয়ে কেবল শ্বেতরক্ষী বাহিনীকে হারানো যাবে না। তাই সমালোচনা সত্ত্বেও ট্রটস্কি জার আমলের পেশাদার সেনা ও সেনাপতিদের রেড আর্মিতে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চালিয়ে যান। পাশাপাশি মস্কো সহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলের শ্রমিক শ্রেণির হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। এই জোড়া কৌশলের মাধ্যমে রেড আর্মির শক্তি অনেক বৃদ্ধি পায় এবং তারা ক্রমশ রণাঙ্গনে সাফল্য পেতে থাকে। ট্রটস্কি একটি বিশেষ ট্রেনে রাশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল গৃহযুদ্ধের গোটা সময়টায় চষে ফেলেন এবং সামনে থেকে শ্বেতরক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মির প্রতিরোধ আক্রমণকে নেতৃত্ব দেন। ১৯১৯ সালের শেষ ও ১৯২০ সালের শুরুর দিকে বলশেভিকরা শ্বেতরক্ষীবাহিনীকে অধিকাংশ রণাঙ্গনে কায়েম করে ও কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু জায়গাতেই বিক্ষিপ্তভাবে আরো কিছুদিন লড়াই চলে।
১৯২০ সালের মধ্যেই রাশিয়ার গৃহযুদ্ধ কার্যত শেষ হয়ে যায় এবং শ্বেতরক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে রেড আর্মি ও বলশেভিকদের নির্ণায়ক বিজয় হয়। ১৯২১ থেকে ১৯২৩ সালের মধ্যে ইতস্তত বিচ্ছিন্ন কিছু লড়াই চলে কোনও কোনও অঞ্চলে। পূর্বদিকের সীমান্তে ও মধ্য এশিয়ার এই সমস্ত লড়াইতেও বলশেভিকরা জেতেন। জর্জিয়া রেড আর্মির অধিকারে চলে আসে ১৯২১’র ফেব্রুয়ারি মাসে। এপ্রিলে রেড আর্মি আর্মেনিয়ার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২৫ অক্টোবর ১৯২২এ জাপান ভ্লাদিভস্তোক ত্যাগ করে এবং তার পরে রাশিয়ার মাটি বিদেশী সেনা মুক্ত হয়। ১৯২২’র শেষদিকে পূর্ব সীমান্তের দিকের লড়াইগুলিও শেষ হয়ে যায় ও সেসব জায়গা বলশেভিক নিয়ন্ত্রণে আসে।
গৃহযুদ্ধের সাফল্যের জন্য বলশেভিকরা বিশেষভাবে নির্ভর করেছিল কৃষক ও শ্রমিক মৈত্রীর ওপর। বিশেষ করে কুলাকদের কোণঠাসা করে ছোট ও মধ্য কৃষকদের বড় অংশটিকে নিজেদের দিকে নিয়ে আসার মধ্যে দিয়েই শ্বেতরক্ষী ও বিদেশী হানাদারদের সাঁড়াশি আক্রমণের মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছিল। উইলিয়ম হেনরী চেম্বারলিন বিপ্লবোত্তর রাশিয়ার প্রথম চার বছরের অনুপুঙ্খ ইতিহাস লেখার সময়ে গৃহযুদ্ধ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত বইতে বলেছিলেন এই যুদ্ধে শ্বেতরক্ষী ও বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে বলশেভিক ও লালফৌজের বিজয় নেহাৎ কোনও সামরিক ঘটনা নয়। এই জয়ও রাজনৈতিক বিজয় এবং বলশেভিকদের শ্রেণি সংগ্রামের অংশ।
- সৌভিক ঘোষাল