গত ২০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হল এআইসিসিটিইউ’র নবম কলকাতা জেলা সম্মেলন। সম্মেলনের সভাগৃহের নামকরণ হয় প্রয়াত পরিবহন কর্মী তপন সাউ’এর নামে, এবং মঞ্চের নামকরণ হয় প্রয়াত মিড-ডে-মিল কর্মী ভারতী ঘোষের নামে। সভার শুরুতে শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন এআইসিসিটিইউ’র রাজ্য সভাপতি অতনু চক্রবর্তী সহ অন্যান্য প্রতিনিধিরা। রাজ্য সভাপতি ও পর্যবেক্ষক অতনু চক্রবর্তী ছাড়াও সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইপোয়া’র পক্ষ থেকে চন্দ্রস্মিতা চৌধুরী এবং আইসা’র শুভাশিস।
এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত বেশ কিছু পুরুষ ও মহিলা। স্কিম ওয়ার্কার ছিলেন ১১ জন (তাঁরা সকলেই মহিলা)। পরিচারিকা ২ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৮ জন, ডবলুবিটিসি নন পেনশনার্স এন্ড পেনশনার্স এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ৪ জন, হোসিয়ারীর পক্ষ থেকে ৪ জন, গ্যাস ১ জন। এছাড়াও ডবলুবিটিসি’র স্থায়ী শ্রমিকদের ইউনিয়ন থেকে ৫ জন, যাদবপুর ইউনিভার্সিটির কন্ট্রাক্ট কর্মী ছিলেন ৩ জন, রিক্সা ২ জন। হকার ছিলেন ৫ জন, জয় ইঞ্জিনিয়ারিং ১ জন, প্রেস শ্রমিক ১ জন এবং ১ জন উবের চালক। এবং বাকি সবাই বিভিন্ন ক্ষেত্রের সংগঠকরা। উপরিউক্ত অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা শ্রমিকগণ এবং তাঁদের সংগঠকদের মোট সংখ্যা ছিল ৭৫ জন। যাঁর মধ্যে ১৯ জন ছিলেন মহিলা। অর্থাৎ মোট জন্যসংখ্যার প্রায় ২৬ শতাংশ মহিলা কর্মজীবী উপস্থিত ছিলেন সভায়। এছাড়াও এই সভায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরাও উপস্থিত ছিলেন।
এই সভা শুরু হয় রাজ্য সভাপতির বক্তব্য দিয়ে। তিনি দাবি রাখেন, কাতারে ফিফা বিশ্বকাপে কাজ করতে গিয়ে যেসব ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যু হয়েছে, ভারত সরকার যেন তাঁদের নামগুলি পেশ করে এবং তাঁদের পরিবারগুলিকে যেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়। এছাড়াও তিনি বলেন, বর্তমানে স্থায়ী শ্রমিক ক্রমে ক্রমেই কমানো হচ্ছে। ক্যাজুয়াল কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়ছে। আগামীদিনের যে লেবার কোড লকডাউনের সময় পাশ হয়, তাতে স্থায়ী শ্রমিকদের মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, মালিক পক্ষ শ্রমিককে যে কোনো মাইনের বিনিময়ে নিয়োগ করতে পারে। ট্রেড ইউনিয়নের কিচ্ছু বলার থাকবে না। অর্থাৎ কর্পোরেটদের হাতে ইন্ডাস্ট্রিগুলিকে তুলে দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, লকডাউন চলাকালীন এইসব ইন্ডাস্ট্রিগুলির রোজগার লক্ষ কোটি কোটি টাকা বেড়েছে। অন্যদিকে শ্রমিকদের অবস্থা ব্যাপকভাবে দারিদ্রসীমার নিচে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। বহু স্থায়ী কর্মচারীরা চাকরি হারিয়েছেন। তাই এর বিরুদ্ধে মানুষকে আরও সোচ্চার হতে হবে। লড়াই তো চলছে, এই লড়াই’এর প্রথম স্তরে যাঁরা লড়াই করছেন তাঁরা হলেন, স্কিম ওয়ার্কাররা (মিড-ডে-মিল, অঙ্গনওয়াড়ি এবং আশা)। এরপরে আছেন, সাফাই কর্মীরা। এবং তিন নম্বর হল কন্ট্রাক্ট ক্যাজুয়াল কর্মীরা। ফলত, এই তিনটি স্তরকে এক করার দায়িত্ব এআইসিসিটিইউ’র। মানুষের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায় মানুষকে তাঁদের বাসস্থানে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। এছাড়া আগে মানুষের কর্মক্ষেত্রগুলিতে দুর্ঘটনা ঘটতো এখন কর্মক্ষেত্রের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় রাস্তা এমনকী বাড়িতেও (গিগ ওয়ার্কার ও প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কার) যে দুর্ঘটনা ঘটছে, সরকারকে সেগুলোকে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা হিসাবে গণ্য কর্যে হবে। এই গিগ এবং প্ল্যাটফর্ম ওয়ার্কাররাও ইউনিয়ন করা শুরু করেছেন, তাই এই নতুন ক্ষেত্রটিকে জোর দিতে হবে। এছাড়াও সরকারি কর্মচারী যাঁরা পেনশন পাননি তাঁদের জন্যও নতুন একটি ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
তারপর একে একে বক্তব্য রাখেন শ্রমজীবী কিছু মানুষ। তাঁরা নিজেদের অসুবিধের কথা উল্লেখ করেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বক্তার বক্তব্য আলোচনা করা হল। মিড-ডে-মিল কর্মী বাণী রায় বলেন, তাঁদের মাইনে বাড়াতে হবে। ৫০ টাকা প্রতিদিন। কী করে সম্ভব আজকের দিনে ওই কটা টাকা দিয়ে? দীর্ঘ ৯ বছর যাবৎ তাঁরা ওই একই মজুরিতে কাজ করে চলেছেন। তাই তিনি কথা দিয়েছেন এই সংগঠনের সঙ্গে তিনি আছেন। যখনই কোথাও ডাকা হবে, তিনি আসবেন। এরপর আইসিডিএস কর্মী ছন্দিতা ব্যানার্জী বলেন, তাঁদের কোনো ছুটি নেই। ওই কটা টাকা সম্মানী হিসেবে দিয়ে কিছু হয় না। কিন্তু তিনি আশা রেখেছেন ভালো কিছুর জন্য। এবং তিনি একটি গান শোনান তাঁর বক্তৃতা শেষে। পরিবহন শ্রমিক গৌরাঙ্গ সেন বলেন, মানুষের অনেক দাবি আছে। এবং এই দাবি রাখতে গেলে নিজেকে খুব শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হবে। নিজের লড়াই নিজেকেই লড়তে হবে। নেতৃত্বে যাঁরা আছেন তাঁরা পথ বাতলে দেবেন, এবং সেই মতো এগিয়ে গিয়ে লড়তে হবে। সবাইকে সংঘবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন জয় ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার শ্রমিক, শম্ভু মন্ডল। তিনি বলেন, কারখানা থেকে ভিআরএস দিয়ে ছাটাই করার বিরুদ্ধে তাঁরা লড়াই লড়েন, মাত্র ১৪-১৫ জন শ্রমিক ছিলেন। কিন্তু শেষমেশ তাঁরা জয়লাভ করে। এবং এআইসিসিটিইউ’র নেতৃত্বে তাঁরা জিতেছেন। এবং তাই তাঁরা চেষ্টা করছেন সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর। এবং তিনি চান এই রকম সম্মেলন আরও হোক, এবং তিনি তাতে যোগদানে ইচ্ছুক। এরপর হকার ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শাহাবুদ্দিন বলেন, হকারদের ওপর যেভাবে পুলিশ অত্যাচার চালাচ্ছে, এর বিরুদ্ধে সবাইকে এক হয়ে লড়তে হবে। ২০-২৫ বছর ধরে তাঁদের এই লড়াই চলছে। তিনি এইসব সমস্যার থেকে মুক্তি চান। মিথিলেশ সিং উবের ড্রাইভার বলেন, সরকারি হোক বা বেসরকারি শ্রমিক সকলকে একসাথে মিলে লড়াই লড়তে হবে। এবং ধীরে ধীরে তিনি ট্রেড ইউনিয়নের কাজ শিখতে চান। এবং আরও অনেকে এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত ও আলোচনা করেন।
এই আলোচনার পর এআইসিসিটিইউ থেকে যে দাবিগুলি রাখা হয়, তা হল –
ক) সকলকে সংগঠিত করা।
খ) আগামী জাতীয় সম্মেলনের (সেপ্টেম্বর/অক্টোবর ২০২৩) আগে কলকাতা জেলায় ৬০০০ সদস্য সংগ্রহ।
গ) কলকাতা জেলায় নূন্যতম ৩০ জনকে এআইসিসিটিইউ’র ক্যাডার হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
ঘ) ইতিমধ্যে যে কয়েকটি জায়গা কাজের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে সেগুলির প্রতি জেলা কমিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই আলোচনার শেষে ৫৬ জন ত্রিস্তরীয় সদস্য, ২৬ জন কার্যনিবাহী সদস্য এবং ১৩ জন অফিস বিয়ারার বা কার্যনির্বাহক সদস্য নির্বাচন করা হয়।
- অবন্তী ভট্টাচার্য