৬ বছর আগে, নভেম্বরের ৮ তারিখে, সন্ধে রাতে ছিলাম বিধান সরণীতে, বাড়ি থেকে ১০-১২ কিমি দূরে। হঠাৎ স্ত্রী ফোন করে বললেন, ফেরার সময় যেন দোকান বাজার করে নিয়ে আসি কারণ, ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল হয়ে যাচ্ছে রাত ১২টা থেকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মোদিজি তেমনটাই ঘোষণা করেছেন খানিক আগে রাত ৮ টার সময়ে। যেহেতু অর্থনীতির ছাত্র ও রাজনীতিও অল্পবিস্তর করি তাই বুঝতে চেষ্টা করলাম কী ঘটতে চলেছে। মানিব্যাগে একটি ৫০০ টাকার নোট ও আরো শ দুয়েক টাকা ছিল। সেটা জানিয়ে স্ত্রীকে বলেছিলাম, বাজার যাই করি না কেন, ওই দুশো টাকার মধ্যেই করতে হবে কারণ, রাত ১২টা অবধি ৫০০ টাকা চালু থাকলেও কেউ এখন তা নেবে না। ফলে কেন ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত ৫০০/১০০০ টাকার লেনদেনের বন্দোবস্ত খুলে রাখা হয়েছিল তা বোধগম্য হল না, যদিও পরে বুঝেছিলাম। তার পরের দিন থেকে বাজারে যেতে পারিনি, বাসেও উঠতে পারিনি। বিক্রেতাদের কাছে ধার দেনা করে চালিয়েছি। যেহেতু সচ্ছল মধ্যবিত্ত তাই পরিচিত বিক্রেতারা ধার দিয়েছেন। কিন্তু দরিদ্র দিন আনা দিন খাওয়া অটোচালক, রিক্সাচালক, বাসচালক, বাস কন্ডাক্টর অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবন দুর্বিসহ ছিল।
নোট বাতিলের পরে একজন কলেজ সহপাঠী, যিনি বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ, এখন মাঝেমাঝে বাংলায় সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকে অর্থনীতি সংক্রান্ত বিশেষ লেখা লেখেন, সম্পাদকীয় পাতায়, তিনি সামাজিক মাধ্যমে ওই নোটবাতিলের গুণাগুণ বললেন, কীভাবে তা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে তা বললেন, এবং সেই সময় কলকাতায় এসে তিনি যে কোনো অসুবিধের সম্মুখীন হননি, বাজারের বিক্রেতাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তাও জানালেন। ৬ বছর পরে ওই সব বিদ্যে বোঝাই বাবুমশাইদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, “কালো টাকা কত পাওয়া গেল শুনি।“ যে সমস্ত অর্থনীতিবিদ, হিসাব রক্ষক, উকিল, চিকিৎসক, অভিনেতা ও ভক্তজন নোটবাতিলের পক্ষে উদ্বাহু হয়ে নেচেছিলেন, তাঁরা বলতে পারবেন, কত কালো টাকা উদ্ধার হয়েছিল, নোট বাতিলের ফলে?
কালো টাকাকে সমূলে বিনাশ করার আত্মম্ভরী ঘোষণাকারী নরেন্দ্র মোদি দেশের মানুষের স্বার্থ নিয়ে নাটকীয়তায় পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। সামাজিক সূচকে ক্রমাগত পিছিয়ে চলা দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি নিজ দেশের মধ্যে জনপ্রিয়তার নিরিখে বিশ্বে জনপ্রিয়তম রাষ্ট্রপ্রধান। যদিও তাঁর মূল কৃতিত্ব নাটকীয় ঘোষণার মাধ্যমে জনসাধারণকে কখনো ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করিয়ে, আবার কখনো রেললাইনে শুতে বাধ্য করে মৃত্যুমুখে পাঠানোয়। কোনো ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা ব্যতিরেকেই হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করে লাখো পরিযায়ী শ্রমিককে, শিশু পরিবার সহ, যোজনের পর যোজন হাঁটতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। যদিও, হু-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোভিডের ফলে ভারতে মারা গেছেন প্রায় আধ কোটি লোক, যা ভারত সরকারের পরিসংখ্যানের প্রায় ১০ গুণ। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই ১২ বছরের শিশু শ্রমিক জামালো মাকদামের কথা যে ছত্তিশগড় থেকে ওড়িশা গিয়েছিল কাজ করতে, ২৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি পৌঁছানোর কয়েক কিলোমিটার আগে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা গিয়েছিল। ফলে কোভিডের লকডাউন কোভিড নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হোক না হোক, জনসাধারণকে কষ্ট দিতে যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে। ‘জনপ্রিয়তম’ প্রধানমন্ত্রী নোট বাতিলেও অনুরূপ মর্ষকামী আনন্দ পেয়েছিলেন কি? নাহলে নোট বাতিলের পরে কীভাবেই বা হাসতে হাসতে বলেন, ‘ঘর মে সাদি হায়, পয়সা নেহি হায়’।
নোটবাতিলের ফলে আমাদের মতো সমালোচকরাও ভেবেছিল, ব্যাঙ্কে ২-৩লক্ষ কোটি টাকার দুনম্বরি অর্থনীতির সূত্রে জমা থাকা নোট ফিরবে না। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ব্যাঙ্কে ফেরেনি মাত্র ১১ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে আমাদের বাড়ির ১০০০ টাকার একটি নোট, আমার আমেরিকা প্রবাসী বন্ধুর দেশ থেকে ঘুরে যাওয়ার পরে থেকে যাওয়া লক্ষাধিক টাকা, অপর বন্ধুর পুত্রদ্বয়ের উপনয়নে পাওয়া ১৭ হাজার টাকাও রয়েছে। অর্থাৎ ওই ১১ হাজার কোটি টাকা মোটেই দুনম্বরি টাকা নয়, দুনম্বরী আয়ের টাকা যথাবিহিত রাস্তা তৈরি করে ফিরে গেছে মালিকের কাছে। তার জন্যই মোদিজি ওই ৪ ঘন্টার (৮টা থেকে ১২টার) সময়কাল নির্দিষ্ট রেখেছিলেন। কেবল তাই নয়, লাখো জনধন ব্যাঙ্ক একাউন্ট তৈরি করানো ছিল, সম্ভবত যেখানে জমা করিয়ে সেই টাকার সামান্য ভাগ দিয়ে ওই সব দুনম্বরি টাকার মালিকরা পুনরায় টাকার মালিক হয়েছে। ফলে অর্থনৈতিক অনুমানেও যে পরিমাণ নগদ দুনম্বরি টাকা জমা ছিল তাদের মালিকদের কাছে তাও শাসক-মালিক কারসাজিতে ব্যাঙ্কে জমা পড়ে গেছে।
৬ বছর আগে ঘটানো নোটবাতিলের রাজনীতি ভারতীয় অর্থনীতির নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষজনের যে দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিয়েছে তা শুধরানো কোনোদিন সম্ভব হবে না। যারা নোটের লাইনে দাঁড়িয়ে মারা গেছেন তাঁরা ফিরে আসবেন না। বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ব্যবসায় লাটে উঠেছে, তার হদিশ পাওয়া যাবে না। কিন্তু অর্থনীতির উপরের তলার মানুষজন অনলাইন ব্যবসায়, ইউপিআই এসব নিয়ে অধিকতর ধনী হয়ে উঠেছে, তারা কখনো নোটবাতিলের বিরোধিতা নাও করতে পারেন। তাই নোটবাতিলের বৈধতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা উঠলে সরকার বলতে পারে অবলীলাক্রমে, নোটবাতিল বিষয়টি একাডেমিক তাই মামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই। ঘটনাট ৬ বছর পরেও নোটবাতিলের বৈধতা সাজানো হচ্ছে তাই কোর্টে হলফনামা দিতে গড়িমসি করা হচ্ছে। একথা অনস্বীকার্য, নোটবাতিলের ফলে ‘কালো টাকা’ উদ্ধার হয়নি, জাল নোট অকার্যকরী হওয়ায় ‘সন্ত্রাসবাদী’ কাজকর্ম শেষ হয়ে যায়নি। যদি তেমনটাই হয়ে থাকে তাহলে ২০১৬ সালের পরে ইউএপিএ-তে সমাজকর্মীদের, সিদ্দিক কাপ্পান, উমর খালিদদের গ্রেফতার করা হয় কেন, কেন কাশ্মীরে পন্ডিতরা বাসস্থান ছাড়েন, কেন রোজ ‘সন্ত্রাসবাদি’দের ‘এনকাউন্টার’এ হত্যা করা হয়, কেন পিএফআই নিষিদ্ধ হয়? নোটবাতিলের ফলে সরকারের কাঙ্খিত নগদ লেনদেনের অর্থনীতিও নগদহীন লেনদেনের রাস্তায় হাঁটেনি, গত ৬ বছরে জনসাধারণের হতে নগদের পরিমাণ বেড়েছে ৭০%। সব মিলিয়ে মোদিজির কোনো ঘোষিত লক্ষ্যই পূরণ হয়নি। অবশ্য ওই সব লক্ষ্যগুলি সত্যিই ছিল কি?
মনে হয় না। যদি দুনম্বরি টাকা ধ্বংস হত তাহলে কোন টাকায় কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে বিধায়ক কেনাবেচা হত? যদি নোটবাতিল করে আয়কর ফাঁকি দেওয়া টাকা উদ্ধার করাই উদ্দেশ্য হত, তাহলে নোটবাতিলের পরদিন প্রতিটি কাগজে পাতাজোড়া পেটিএমএর বিজ্ঞাপনে নরেন্দ্র মোদির ছবি কীভাবে থাকত? জানিনা কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসায়িক সংগঠনের হয়ে প্রধানমন্ত্রী বিজ্ঞাপন দিতে পারেন কিনা। সেটি যদি বেআইনি নাও হয়, অনৈতিকতো বটেই। যে পেটিএমএর বিজ্ঞাপনী আইকন হয়েছিলেন মোদিজি, তারাই মূলধনী বাজার থেকে শেয়ারে ১৮,৩০০ কোটি টাকা তুলেছিল, যার বাজার মূল্য এখন কমে ৫,০০০ কোটি টাকায় তলানিতে ঠেকেছে। পেটিএমএর শেয়ার ক্রেতারা মোদিজির ব্রান্ড ভ্যালু ভালোই বুঝতে পারছেন। সে অর্থে পেটিএম-এর শেয়ার ছাড়া খুচরো বিনিয়োগকারীদের ঠকানোর একটা কারসাজি ছিল। মোদিজিকে সেই কারসাজির সূত্রপাতের অংশ বলে ধরা অনুচিত হবে কি?
– অমিত দাশগুপ্ত