বিশ্বাসঘাতক মোদী সরকার এবং তৃণমূল সরকারের বঞ্চনা ও প্রতারণার বিরুদ্ধে
ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন জয়ী হয়েছে। কিন্তু চলমান কৃষক সংগ্রাম জারি আছে। চরম মিথ্যাচার, ঘৃণাপ্রচার ও সন্ত্রাসের উপর নির্ভর করে মোদী সরকার যে কর্পোরেট ফ্যাসিস্ট আগ্রাসন নামিয়ে এনেছে তার বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলন। জাতপাত, ধর্মীয় পরিচিতি, রাজনৈতিক দলীয় মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে অভূতপূর্ব কৃষক ঐক্য, তার সাথে গ্রামীণ গরীব মানুষের জোট, শ্রমিক শ্রেণী ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় সমর্থন সব মিলে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল গৈরিক ষড়যন্ত্রের জাল। জনশক্তির সেই জাগরণের কাছে উদ্ধত শাসক মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। স্থগিত রাখা হয়েছিল কর্পোরেট স্বার্থবাহী তিন কৃষি-আইন।
কিন্তু যে লিখিত প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে নজীরবিহীণ কৃষক আন্দোলন দিল্লীর রাজপথ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, প্রায় ১০ মাস হয়ে গেল তার কোনও দাবি সরকার আজও পূরণ করেনি। দিল্লীর কৃষক আন্দোলন চলাকালে ৯ ডিসেম্বর ২০২১ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি ও কৃষক কল্যান দপ্তরের সচিব সঞ্জয় আগরওয়াল এক চিঠির মাধ্যমে সংযুক্ত মোর্চার নেতৃবৃন্দকে আশ্বাস দেন কৃষক আন্দোলনের মূল মূল দাবিগুলি মেনে নেওয়া হবে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণে এক কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তাতে সরকারের তল্পিবাহক এবং কৃষক আন্দোলন বিরোধিতা করা কয়েকটি তথাকথিত কিষাণ সংগঠনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রেখে কিষাণ মোর্চার প্রতীকী অংশগ্রহণের কথা জানানো হয়। কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ এই শঠতামূলক প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। কেন্দ্রীয় সরকারের লিখিত প্রতিশ্রুতি ছিল বিদ্যুৎ আইন ২০২২ সংশোধনী বিল আপাতত স্থগিত রাখা হবে। এটা নিয়ে কিষাণ মোর্চার নেতৃত্বের সাথে আলোচনা করা হবে। কিন্তু দেখা গেল এই বিল লোকসভায় পেশ করে দেওয়া হল। ঋণমুক্তি নিয়ে সরকারের আদৌ কোনো ভাবনাই নেই। সরকার ক্রমশ এগিয়ে চলেছে খাদ্যনিরাপত্তাকে ধ্বংস করার পথে। এমএসপির সাথে যা অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। সম্প্রতি রেশনে গম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আইনি জটিলতায় বহু সংখ্যক গরিব মানুষকে গণবণ্টন থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের ভূখা মারার চক্রান্ত চলছে। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন না হওয়ার কারণে কৃষকরা চরম লোকসানে ঋণগ্রস্ত। দেশজুড়ে কৃষকের আত্মহত্যা বেড়ে চলেছে। ঘনঘন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি। সার, বীজ, কীটনাশক, বিদ্যুৎ, সেচ সহ কৃষি উপকরণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। কর্পোরেটদের জন্য লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মুকুব-কর ছাড়, অথচ কৃষকদের ভর্তুকি বা কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়নে বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১০০ দিনের কাজ নেই, লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মজুরি বকেয়া। বনাঞ্চল আইন পাল্টে দিয়ে আদিবাসী জনগণের অধিকার হরণ করে তাঁদের জীবন-জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করে দেওয়া হচ্ছে।
এভাবে ঘুরপথে নয়া কৃষি-আইন চালু করার লক্ষ্যে মোদী সরকার এগিয়ে চলেছে।
এই বিশ্বাসঘাতকতার মুখোশ খুলে দিয়ে আগামী ২৬ নভেম্বর ২০২২ দেশব্যাপী রাজভবন অভিযানের কর্মসূচি নিয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। দু’বছর আগে এই দিনেই কৃষক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। এদিন সারা দেশে সমস্ত রাজ্যের রাজধানীতে লক্ষ লক্ষ কৃষক, কৃষিমজুর, শ্রমজীবী মানুষ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপালের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে কৃষকদের বকেয়া দাবিগুলি পেশ করে হুশিয়ারী জানাবে। এই প্রক্রিয়ায় দিল্লীর কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতা সারা দেশ জুড়ে সংগঠিত করার প্রয়াস চালাবে পাঁচশোরও বেশি কিষাণ সংগঠনের সমন্বয়কারী মঞ্চ সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। এর আগে বিভিন্ন সময়কালে কৃষক আন্দোলন রাজ্য, জেলা বা বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, আলোড়ন সৃস্টি করেছে। কিন্তু এই প্রথম এক সাধারণ দাবিসনদের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় স্তরে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা সামনে এসেছে। কিষাণ মোর্চার নেতৃবৃন্দ একে কৃষক আন্দোলনের এক পূনরুজ্জীবন বলে অভিহিত করছেন। কেন্দ্রীয় দাবিসনদের মধ্যে রয়েছে, এমএসপি গ্যারান্টি আইন, ঋণমুক্তি, কার্যকরী ফসল বীমা, বিদ্যুৎ বিল প্রত্যাহার, মাসিক ৫ হাজার টাকা কৃষক পেনশন, লখিমপুর খেরীতে কৃষক হত্যাকারী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের শাস্তি, কৃষক আন্দোলনের কর্মীদের ওপর থেকে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ৭৪০ জন শহীদ কৃষকদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রভৃতি।
রাজভবন অভিযান কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন সরকারের বিরুদ্ধেও কৃষকদের দাবিগুলি তুলে ধরা হবে। এজন্য পৃথকভাবে এক স্মারকলিপি জমা দেওয়া হবে। কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত, তাই এপ্রশ্নে রাজ্য সরকারের বড় দায় রয়েছে। কেন্দ্র ২৩টি ফসলের এমএসপি নির্ধারণ করে থাকে। এর বাইরে এই রাজ্যে বহু ধরনের ফসল উৎপাদন হয়, বিশেষত রাজ্যের আলু ও সব্জি চাষিরা কোনও সরকারি দর পায় না। পর্যাপ্ত হিমঘর না থাকায় প্রায় ৪০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। গত ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য এমএসপি আইন চালু করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটা খসড়া বিল পাঠানো হয়। কিন্তু রাজ্য সরকারের কোন হেলদোল নেই। ফসলের সরকারি ক্রয় বা বিপনন থেকে সরকার হাত গুটিয়ে নেওয়ার কারণে রাজ্যে ধান পাট আলু সব্জি চাষিরা চরম লোকসানে। এদিকে গ্রামে কোনও কাজ নেই। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের ফলে মজুরদের কাজ জোটে বছরে ৩০/৩৫ দিন। দলে দলে গ্রামীণ যুব শক্তি বাইরে চলে যাচ্ছে। এরাজ্যে কোথাও সরকার নির্ধারিত মজুরি কার্যকর হয় না। শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ১০০ দিনের কাজ, আবাস যোজনা সহ গ্রাম উন্নয়নের টাকা নিয়ে চলছে সীমাহীন দুর্নীতি-দলবাজি-প্রতারণা। কৃষিকাজে সহায়তায় সমবায়গুলি বা পঞ্চায়েতের কোনও ভূমিকা নেই। সরকারি উদ্যোগে সার বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। চলছে খোলাখুলি সারের কালোবাজারি মজুতদারী। এই সমস্ত জ্বলন্ত ইস্যুগুলি রাজভবন অভিযানে তুলে ধরা হবে।
সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর ২০২২ দলমত নির্বিশেষে দেশের সমস্ত লোকসভা সদস্যদের কাছে এই দাবিসনদ পৌছে দেওয়া হবে যাতে পার্লামেন্টের আগামী শীতকালীন অধিবেশনে তারা সেটি উত্থাপন করেন। দেশের অন্নদাতাদের জীবন-মরণের এই দাবিগুলি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয় ও ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এটা কেবল কৃষক প্রশ্নই নয় এরসাথে দেশের খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্ন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। এটা দেশের ব্যাপক জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্ন। তাই বিভিন্ন গণসংগঠন, গণতান্ত্রিক শক্তি ও ব্যাক্তিবর্গকে এই কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।