সর্বজনীন সমমানের শিক্ষা-প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর, ধনী-নির্ধন সকল পড়ুয়াকে সমভাবে দেখা না দেখার শহরগুলির, বিশেষত কলকাতা, হাওড়া, শিলিগুড়ি, আসানসোল, দুর্গাপুরের মতো শহরগুলির বিদ্যালয়গুলির দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে (যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের সরকার বেতন দেয় এবং স্কুল সার্ভিস কমিশন বা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমে নিয়োগ করে) পড়ুয়াদের সংখ্যা কমছে। বহু বিদ্যালয় পড়ুয়াদের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলির অধিকাংশেই পড়ার জন্য আকুতি বাড়ছে, বহু পড়ুয়া ভর্তি হতে গিয়ে নিরাশ হচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে পড়ুয়াদের বেতন নেই, অন্যান্য খরচও কম, শিক্ষিকা শিক্ষকরাও বহুবিধ যাচাই’এর মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত হয়ে নিযুক্ত হন, তাঁদের বেতন ও অবসরের পরে পেনশন সরকার নির্ধারিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী হয়। বিপরীতে বেসরকারি বিদ্যালয়গুলিতে বেতন অনেকগুণ বেশি, সাথে অন্যান্য খরচও প্রচুর, শিক্ষিকা শিক্ষকরা বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পছন্দমত নিযুক্ত হন, তাঁদের বেতন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বেতনক্রম মেনে হয় না, অবসরের পরে কোথাও কোথাও পেনশন পাওয়া গেলেও তা সরকারি বিদ্যালয়ের তুলনায় নগণ্য। এছাড়া, যত দামি বিদ্যালয় তত বেশি খরচ প্রাইভেট টিউশনের জন্য। বোঝা যায়না, নাম করা বেসরকারি বিদ্যালয়ে কী এমন ভালো পঠনপাঠন হয় যে, বেশি খরচের প্রাইভেট টিউশন অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।
যাই হোক, উপরের অনুচ্ছেদে কখনো বাণিজ্যিক বিদ্যালয় লেখা হয়নি, সচেতনভাবেই হয়নি। কারণ, আমাদের দেশে মুনাফার জন্য বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা যায়না। কিন্তু সকলেই জানে যে, ওই সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই মুনাফা করে থাকে। সাধারণত, সোসাইটি বা ট্রাস্টের দ্বারা প্রতিষ্ঠানগুলি খোলা হয়, যে সোসাইটি বা ট্রাস্ট কোনো কোম্পানির দ্বারা গঠিত হয়। কোম্পানি প্রতিষ্ঠানগুলির সম্পত্তির মালিক হয় ও সেগুলি ব্যবহারের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে অর্থ আদায় করে ও মুনাফা করে। ফলে ঘুরপথে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই বিদ্যালয়গুলি খোলা হয়ে থাকে। সম্প্রতি প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে হইচই পড়ে গেছে। যে পরিমাণ অর্থ নগদে দেখা গেছে তার কয়েকগুণ নিশ্চয়ই এখনো লুকোনো আছে, যা ভবিষ্যতে দেখা যেতেও পারে নাও পারে। লক্ষ্যণীয় ‘উন্নত’ শিক্ষা প্রদানকারী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির গঠনের মধ্যেই লুকোছাপা রয়েছে। সেগুলি ‘মুনাফার জন্য নয়’, কিন্তু মোটা অঙ্কের বেতন পড়ুয়াদের কাছ থেকে নেয়। মুনাফাও করে। ফলে, অনুমোদন পাওয়ার জন্য ক্ষমতাবান ‘শিক্ষামন্ত্রী’কে খুশি করা তাঁদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।
বহুদিন ধরেই শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ বরাদ্দের কথা শুনে আসছি আমরা। শিগগিরি আমরা নাকি ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হব। এখন তা ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলে শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ ১৯,২০০ কোটি ডলার বা ১৫,৩৬,০০০ কোটি টাকা। হচ্ছে তার অর্ধেকেরও কম, ৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ভিত্তিক আভ্যন্তরীণ উৎপন্নের পরিমাণ ১৫.১১ লক্ষ কোটি টাকা। ৬ শতাংশ হিসেবে শিক্ষাখাতে ব্যয় হওয়া উচিৎ ৯১ হাজার কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালের সংশোধিত হিসেব অনুসারে ব্যয় করা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা, ৪৩ শতাংশের মতো। কেবল তুলনার জন্য চিনের শিক্ষাখাতে ব্যয়ের পরিমাণকে দেখা যেতে পারে। চিনে শিক্ষাখাতে ২০২১ সালে সরকারি ব্যয় হয়েছিল ৩.৭৬ ট্রিলিয়ন য়ুয়ান, যা ৪৪ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। চিনের জনসংখ্যা ভারতের থেকে সামান্যই বেশি। ফলে চিনে মাথাপিছু শিক্ষাখাতে ব্যয় ভারতের থেকে ৬ গুণের বেশি। পশ্চিমী দেশগুলির মাথাপিছু ব্যয়ের কথা বলে নিজেদের লজ্জা না দেওয়াই ভালো। এই পরিসংখ্যান থেকে এদেশে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাই যাচ্ছে।
চিনের মতো যদি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে বাধ্য করা যেত শিক্ষাখাতে অনুরূপ ব্যয় করতে তাহলে দেশের সর্বসাধারণের শিক্ষার মান কত ভালো হতে পারত। অতটা না ভেবে যদি জিডিপি’র ৬ শতাংশ হিসেবে ওই ব্যয় ১৫ লক্ষ কোটি টাকাও হত, তাহলেও অন্তত গ্রাম শহরের সাধারণ বিত্তের বা গরিব ঘরের পড়ুয়াদের উন্নত শিক্ষার পরিকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হত। কেবল তাই নয়, চিনে প্রাথমিক শিক্ষকদের বার্ষিক বেতন গড়ে ১৭৭ হাজার চিনা য়ুয়ান যা ভারতীয় টাকার অঙ্কে প্রায় ২১ লক্ষ টাকা। সামগ্রিক শিক্ষকদের গড় বেতন ভারতীয় টাকার অঙ্কে ৩০ লক্ষ টাকা। গড় বেতনের দিক দিয়ে এদেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা চিনের তুলনায় ৯ ভাগের ১ ভাগ পেয়ে থাকেন। কেবল তাই নয়, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতনের ক্ষেত্রে ভারতীয় শিক্ষকদের গড় বেতন প্রাথমিক শিক্ষকদের তুলনায় ৬ গুণ, চিনে তা আড়াইগুণ। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বেতন বৈষম্যও কম।
যদি এদেশে ধনী নির্ধন নির্বিশেষে সবার জন্য সমমানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করার আন্তরিক ইচ্ছে সরকারগুলির থাকে, তাহলে
১) পুরো বিদ্যালয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে সরকারি করা সর্বোত্তম উপায়। যদি তা না করা যায়, তাহলেও সরকারি বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষেই পাঠক্রমকে সমাপ্ত ও কেবল শ্রেণিকক্ষেই পড়াশোনা বাধ্যতামূলক করে সরকারি বিদ্যালয়গুলিকে সর্বোত্তম করে তুলতে হবে। অবশ্যই পড়ুয়া শিশুদের নিকটবর্তী বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা আবশ্যিক করতে হবে। কোনোমতেই সরকারি বিদ্যালয়ের মধ্যে অভিভাবকরা বাছাবাছি করতে পারবেন না।
২) কেবল মিড-ডে-মিলের মতো যেনতেন প্রকারের খাবার নয়, সকল পড়ুয়াকে বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সুস্বাদু বৈচিত্রপূর্ণ আকর্ষণীয় কিন্তু স্বাস্থ্যকর সুষম খাবার দিতে হবে।
৩) আগেই বলেছি, পাঠক্রম তৈরির বিষয়ে শিক্ষকদের গুরুত্ব সর্বোচ্চ, তদনুসারে পাঠক্রম তৈরি করতে হবে। এবং শিক্ষকদের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকাঠামো যোগান দিতে হবে সরকারকে। উপযুক্ত বিদ্যালয় ভবন, শ্রেণিকক্ষ, গ্রন্থাগার, প্রসাধন কক্ষ, শৌচাগার, কম্পুটার, যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের সীমা মেনে চলা-এসবই পরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত।
৪) সকল শিক্ষক শিক্ষিকাকেই বিদ্যালয়ের সন্নিকটে থাকার সুচারু বন্দোবস্ত করতে হবে সরকারকে। কেবল শিক্ষিকা-শিক্ষকের প্রয়োজনে বা তাগিদে বিদ্যালয় পরিবর্তন চলবেনা।
৫) শিক্ষিকা-শিক্ষকদের দায়িত্বশীল করতে হবে শ্রেণিকক্ষেই পাঠ সমাপন করাতে।
৬) শিক্ষিকা-শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সার্বিক স্বচ্ছতা রাখতে হবে। তাছাড়া নিয়োগের সময়ে শিক্ষিকা-শিক্ষকদের ওয়াকিবহাল করতে হবে যে, শ্রেণিকক্ষের সমস্ত পড়ুয়াদের সর্বোত্তম শিক্ষণের দায়িত্ব তাঁদের।
৭) শিক্ষিকা-শিক্ষকদের সঙ্গে অন্য সংগঠিত ক্ষেত্রের সমস্তরের কর্মীদের মধ্যে ও বিভিন্ন স্তরের শিক্ষিকা-শিক্ষকদের মধ্যে বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে।
৮) সর্বোপরি সরকারি শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অবৈতনিক কিন্তু সর্বোচ্চ মানের হতে হবে।
অবশ্যই এসব করতে সরকারকে প্রভূত অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ ব্যয় করলে সেই ব্যয়ের অনেকটাই করা সম্ভব। জিডিপি নিরপেক্ষভাবে সকলের জন্য উন্নত সর্বোচ্চমানের শিক্ষাকে যদি সরকার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়, তাহলে সেই অনুযায়ী শিক্ষাখাতে ব্যয় করতে হবে।
আসলে প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গীর, ধনী-নির্ধন সকল পড়ুয়াকে সমভাবে দেখা না দেখার।
- অমিত দাশগুপ্ত