টিএমসি নেতা পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ সহকারী এক অভিনেত্রীর দুটো ফ্ল্যাট থেকে নগদে ও সোনায় ৫০ কোটি টাকারও বেশি বাজেয়াপ্ত হওয়ার চমকপ্রদ ঘটনা পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আরও একবার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পশ্চিম বাংলায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ব্যাপক বেনিয়ম ও নির্লজ্জ কারচুপির পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পরিণামেই এই অর্থ-উদ্ধার, তারপর মন্ত্রীর গ্ৰেপ্তারি এবং শেষে মন্ত্রীর অপসারন। আর আদালতের এই রায় এসেছে বঞ্চিত প্রতারিত কর্মপ্রার্থীদের দীর্ঘ নাছোড়বান্দা আন্দোলন। গ্ৰেপ্তার হওয়া মন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীদের নিয়েই যখন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম এই ইস্যুটার খবরাখবর করছে, আমাদের তখন সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিতে হবে বঞ্চনার কবলে পড়া এইসব হবু শিক্ষকদের ন্যায়বিচার লাভের ওপর, যাঁরা এই দুর্নীতির প্রত্যক্ষ শিকার।
ছ-বছর আগে পশ্চিম বাংলার স্কুল সার্ভিস কমিশন নবম-দশম এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে রাজ্য স্তরের এক সিলেকশন টেস্ট নিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০১৭’র নভেম্বর এবং ২০১৮’র মার্চে প্রকাশিত ফলাফলে প্রার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর ও মেধা তালিকায় স্থান উল্লিখিত হল না, প্রার্থীরা পাশ করেছে কি করেনি এটুকুই শুধু জানানো হল। আদালতের চাপে পরবর্তীতে মেধা তালিকায় কার স্থান কত তা প্রকাশ করা হলেও নিয়োগ মেধা তালিকা অনুসারে হল না। দেখা গেল যে, মেধা তালিকায় স্থান না হলেও ভালো প্রশাসনিক যোগাযোগ থাকা প্রার্থীরা চাকরি পেল; একটা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতে হলে বলা যায় আরেক মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে এইভাবে চাকরি পেয়েছিলেন। বঞ্চিত প্রার্থীরা ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতা প্রেস ক্লাব ময়দানে অনির্দিষ্টকালের অনশন প্রতিবাদ শুরু করলেন এবং তখন থেকেই এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুরু হল দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন।
অনশন আন্দোলন এক মাস চলার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে সমস্ত অসংগতি শুধরে নেওয়া এবং মেধা তালিকা অনুসারে সবার দ্রুত নিয়োগের আশ্বাস দেন। একটা কমিটি তৈরি হয় এবং ২৮ মার্চ অনশন আন্দোলন তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু বঞ্চিত প্রার্থীরা আবারও ধাক্কা খেলেন যখন তাঁদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অরত্যন্ত স্থুলভাবে ভঙ্গ করল সরকার। ফলে প্রতিবাদ আবার শুরু হল, এবং তার সঙ্গে এবার শুরু হল আইনি লড়াই। আর নেমে এল পুলিশি নিপীড়ন। তবু, প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা এবং অতিমারি ও বিধানসভা নির্বাচন জনিত বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আন্দোলন চলতে থাকল। যোগ্যতা অর্জন সত্ত্বেও বঞ্চনার শিকার হওয়া যুবক-যুবতীদের লাগাতার দৃঢ় সংগ্ৰাম পরিশেষে উন্মোচিত করল, হাইকোর্ট যাকে আখ্যায়িত করেছে, “হিমশৈলের ভাসমান চুড়া”।
এই উন্মোচন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের অপশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভকে আবার জাগিয়ে তুলেছে। বিজেপি পশ্চিম বাংলার ঘোলা জলে মাছ ধরার সুস্পষ্ট সুযোগ পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার নয় যে, মহারাষ্ট্রের পর পশ্চিমবঙ্গ ও সংলগ্ন ঝাড়খণ্ড বিজেপির ক্ষমতা-হাতানোর অস্ত্র ‘অপারেশন লোটাস অভিযানের’ বিশেষ নিশানা। ইতিমধ্যেই ঝাড়খণ্ডের তিন কংগ্রেস বিধায়ক গাড়িতে প্রচুর টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় হাওড়া জেলায় ধরা পড়েছেন, আর চিত্র তারকা থেকে বিজেপির ব্র্যাণ্ড অ্যামব্যাসাডারে পরিণত হওয়া মিঠুন চক্রবর্তী দাবি করছেন যে অন্তত পক্ষে ৩৮ জন তৃণমূল বিধায়ক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। আধিপত্যকারী টিআরপি-হাতানো মিডিয়া যখন রগরগে কেচ্ছাকাহিনীর সোনার খনি খুঁজে পেয়েছে এবং বিজেপি যখন তার ঘোড়া কেনাবেচার ফন্দিফিকিরে মেতে রয়েছে, তখন কাজ ও ন্যায়বিচারের জন্য যুবক-যুবতীদের আন্দোলনকে তার এজেণ্ডার প্রতি অবিচল থাকতে হবে এবং বামেদের এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে পরিপূর্ণ সমর্থন জানাতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী এখনও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে প্রকাশ্যে কোনো আলোচনা করেননি, তবে তৃণমূল কংগ্রেস নেতা অভিষেক ব্যানার্জি নিজের পছন্দসই কিছু প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেছেন এবং এইভাবে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহের সৃষ্টি করেছেন।
কর্মপ্রত্যাশী যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চনা করে নিয়োগ-দুর্নীতি এবং যোগ্য ছাত্রছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার ভর্তি কেলেঙ্কারি আজকের ভারতে এক ন্যক্কারজনক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে এই ধরনের দুর্নীতিগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে এবং প্রতিবাদ-বিক্ষোভগুলোকে নৃশংসভাবে দমন করা হচ্ছে। মধ্যপ্রদেশের কুখ্যাত ব্যাপম কেলেঙ্কারি এমন একটা আতঙ্কজনক দৃষ্টান্ত যেখানে ন্যায় বিচার লাভের প্রয়াসকে দমন করতে বহু ব্যক্তিকে একেবারে জানে মেরে দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকারী যুবক-যুবতী এবং পশ্চিমবঙ্গের সুবিচারকামী জনগণকে এই কৃতিত্ব দিতে হবে যে, তাঁরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির উন্মোচন ঘটিয়েছেন এবং ন্যায়বিচারের আন্দোলনকে আজকের এই সন্ধিক্ষণে পৌঁছে দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের আন্দোলনরত যুবক-যুবতীদের প্রতি সকল শুভিবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে সর্বাত্মক সমর্থন জানাতে হবে যাতে তাঁরা এই ঘৃণ্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে এবং বাংলার তরুণ প্রজন্মের অধিকার ও স্বপ্নকে সুব্যবস্থিতভাবে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে প্রশ্নাতীত বিজয় অর্জন করতে পারেন।
(এম-এল আপডেট সম্পাদকীয়, ২ আগস্ট ২০২২)