আরএসএসের ভারতে চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির জায়গা নাই
RSS has no place for thought

এম এস গোলওয়ালকর তাঁর ‘চিন্তন গঙ্গা’ গ্রন্থে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন। এতকাল বাদে ভারতীয় জনতা পার্টি গোলয়ালকরের সেই ইচ্ছাপূরণ করল। এই যুক্তরাষ্ট্রীয় সার্বভৌম কাঠামোকে ভেঙে ফেলার অন্যতম অভিনব পন্থা হল ‘গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স’ অর্থাৎ জিএসটি প্রণয়ন। জনতাকে বোঝানো হল জিএসটি এক বিপুল অর্থনৈতিক সংস্কার। যেমন নোটবন্দীর ক্ষেত্রে ঘটেছিল। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যায় জিএসটি আদপে রাজ্যগুলির অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা নিমেষে ছিনিয়ে নিল এবং রাজ্যগুলি তাদের বরাদ্দের ন্যুনতম ভাগের জন্যে এখন কেন্দ্রের দয়া দাক্ষিণ্যের শিকার। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে খর্ব করে দিয়ে আমাদের ভারতীয় সংবিধানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য দিকটি পঙ্গু করে দেওয়া হল। এবং অত্যন্ত সন্তর্পণে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে আঘাত হানল ওরা। খুব অবাক হওয়ারও কিছু নেই। এই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সার্বভৌম সংবিধান থাকলে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) এবং বিজেপি তাদের প্রক্রিয়া প্রণয়ন করবেই বা কী করে! এ যে তাদের প্রায় একশো বছরের অপেক্ষা! যার সূচনা হয়েছে গোলওয়ালকরের আগে কেবি হেডগেওয়ারের হাত দিয়ে। তাদের আরেকটি জোরদার পদক্ষেপ হল হিন্দি ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা। এই সব কটা পদক্ষেপ হল বহুত্ববাদ বিরোধী তাদের মূল ভারতীয় অস্মিতা-  এক রাষ্ট্র, এক ভাষা, এক জাতি, এক নেতার সার্থক রুপায়ন।  

শিক্ষাক্ষেত্রেও গল্পটা একই। বরং আরো ভয়ঙ্কর। ইতিহাস এবং শিক্ষা এই দুটি ক্ষেত্রে আরএসএসের বরাবর আগ্রহ ও উৎসাহ। হবে নাই বা কেন। ওখানেই তো বীজ বপনের মহা সুযোগ। পাঠ্যপুস্তকগুলোয় তারা চায় নিজেদের এজেন্ডার ইতিহাসে ভরপুর করে দিতে। যেমন, ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইতে টিপু সুলতানকে খাটো করে দেখাতে লেখা হয়েছে ‘টিপু সুলতান ফরাসীদের সাহায্য নিয়ে ইংরেজদের যুদ্ধে পরাস্ত করেছে’। কিন্তু টিপু সুলতানের সময়ে যে গুটি পোকা (রেশম) চাষের সূচনা, ভূমি সংস্কার, কৃষি ঋণ, টাঁকশাল তৈরি হয়েছিল সেসব বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রায় তিনশো বছর ভারত শাসন করা মুঘলদের বহিঃশত্রু রূপে দেখাতেও তারা মরিয়া।

সিবিএসসি বোর্ডের ইতিহাসের বইয়ে মেলে তার নানা নিদর্শন। যেমন কর্ণাটক সরকারের অষ্টম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্য বইয়ের একটি চ্যাপ্টার ‘রাইজ অব নিউ রেলিজিওন’ (নূতন ধর্মের আবির্ভাব), যেখানে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে দুটি নূতন ধর্ম হিসেবে দেখানো হচ্ছে, দুটি ধর্মকেই পাঠ্য বইটিতে মূল হিন্দু ধর্মের দুটি সম্প্রদায় হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই সবর্ণ হিন্দু দলের পক্ষে হজম করা সম্ভব হচ্ছে না যে বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম এবং শিখ ধর্ম ভারত ভূমির তিনটি সত্যিকারের ধর্ম যারা চতুর্বর্ণ প্রথা নিষিদ্ধ করেছিল।

স্কুলের পাঠ্য বই সংশোধন প্রক্রিয়াটি নতুন কারণ এর পূর্বে নিজেদের শাখার বাইরে তারা এসব বাস্তবায়িত করতে পারেনি। তবে চেষ্টা শুরু হয়েছে বিজেপির আগের জমানার সরকার থেকেই। ১৯৯৮ সালে বিজেপি যখন প্রথমবারের জন্যে ক্ষমতায় এলো তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মুরলী মনোহর যোশী তখন ‘পৌরহিত্য’ এবং ‘আচার- অনুষ্ঠান’ স্কুল পঠনপাঠনে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তার মধ্যে একটি ছিল পুত্রের কামনায় ‘পুত্রেষ্ঠী যজ্ঞ’। তাঁর সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে জ্যোতির্বিদ্যার বদলে জ্যোতিষবিদ্যা পড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল। যদিও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

এইসব ভিত্তিহীন বিষয় শিশু মনকে মূর্খতার দিকে ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করে না। গেরুয়া শিবিরের গুরু গোলওয়ালকর চাইতেন না কিশোর মনের বিস্তার হোক, তারা বুদ্ধি, মেধা প্রয়োগ করে বিচার করতে শিখুক, সমালোচনা করতে শিখুক। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকের মুখ্য প্রতিনিধি ভাজপা সরকার গত আট বছর প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে ক্ষমতায় এসে সেই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করছে। সম্প্রতি সিবিএসসি ক্লাস টেনের পাঠ্যসূচি থেকে বেশ কিছু বিষয় সম্পূর্ণ বাদ গেছে যেমন গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, কৃষিতে বিশ্বায়নের প্রভাব, গণ আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িকতা। গেরুয়া শিবিরের শিক্ষা সংস্কৃতির সংস্থা ‘ন্যাস’ বর্তমানে অতীব প্রভাবশালী। তারা সিলেবাস তৈরির প্রতিষ্ঠান এনসিইআরটি-কে চাপ দিচ্ছে বহু বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত না করতে যার মধ্যে অন্যতম হল ২০০২’র গুজরাত দাঙ্গা। এটাই তাদের চাতুরী। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে না বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, জ্যোতিরাও ফুলে, সাবিত্রীবাই ফুলে, রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেনদের কথা। জানবে না জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা ভাবাদর্শের বহু সংগ্রামীদের কথা যাদের রক্তঢালা সংগ্রামে দেশ স্বাধীন হয়েছে।

আরো কত দূর, আরো কতভাবে প্রকৃত ইতিহাস মুছে তাদের মনমতো বানানো ইতিহাস লেখা হবে, আমরা সত্যিই জানি না! তবে এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতেই দেখা যাবে হেডগেওয়ারকে বলা হবে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জনক এবং দামোদর সাভারকর হয়ে যাবেন জাতীয় নায়ক যাকে অনেক কালই ‘বীর’ ভূষণে ভূষিত করা হয়েছে, যিনি আসলে আটবার ব্রিটিশ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন এবং গান্ধী হত্যার অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী। নাথুরাম গডসেই বা বাদ যাবেন কেন! হয়ত স্কুলপাঠ্যে বলা হবে তার জন্যেই রক্ষা পেয়েছিল ভারতীয় হিন্দুরা!

এই গৈরিকরণের শেষ কোথায় কে জানে!

- অভিষেক রায়

খণ্ড-29
সংখ্যা-30