ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কথা জাতীয় কংগ্রেস ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই তার প্রায় সমস্ত নেতৃত্বকে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তার করে। কিন্তু আন্দোলন তা সত্ত্বেও দুর্বার গতিতে এগিয়েছিল মূলত স্থানীয় স্তরের হাজার হাজার নেতা কর্মীর স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। বাংলার আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। ছাত্রছাত্রী ও শ্রমিকশ্রেণী বিভিন্ন জেলাতেই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ব্যবসায়ী, পুরসভার জনপ্রতিনিধি সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষও এতে সামিল হয়েছিলেন। জনগণের মধ্যে এক অভূতপূর্ব আবেগ ও উত্তেজনা সর্বত্রই দেখা গিয়েছিল।
কলকাতায় ছাত্র-যুবদের সাথে পুলিশের সংঘাত চলে। ১৭ অগস্ট হাওড়া শিল্পাঞ্চলের নানা কারখানায় শ্রমিকেরা ধর্মঘটে সামিল হন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভারত জুট মিল, ইন্ডিয়া মেশিনারি ফ্যাক্টরি, হাওড়া জুট মিল, অনন্তরাম চ্যাটার্জী অ্যান্ড কোম্পানি, বিজয় বার্ন কোম্পানি, গেস্টকিন উইলিয়াম লিমিটেড, ফকিরদাস মিস্ত্রি অ্যান্ড কোম্পানি, কে দাস অ্যান্ড কোম্পানি ইত্যাদি। শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের কর্মীরাও ধর্মঘটে যোগ দেন। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হাওড়ার নানা জায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন চলে।
আন্দোলন ঘোষণার পরপরই হুগলির বিভিন্ন প্রথম সারির নেতা গ্রেপ্তার হয়ে যান। ১৭ আগস্ট চুঁচুড়াতে, ২৯ আগস্ট, ৫ সেপ্টেম্বর ও ১৪ সেপ্টেম্বর শ্রীরামপুরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রছাত্রীরাও এই ধর্মঘটগুলিতে সামিল ছিলেন। শ্রীরামপুরের দশ জন ও চুঁচুড়ার আট জন সহ হুগলির বিভিন্ন মিউনিসিপ্যালিটির বেশ কয়েকজন কমিশনার আন্দোলনের সমর্থনে তাঁদের পদ থেকে ইস্তফা দেন। ২৭ আগস্ট থেকে কয়েকদিন হুগলির বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করেন। হুগলি কটন মিল, রামপুরিয়া কটন মিল, বঙ্গলক্ষী কটন মিল, বঙ্গেশ্বরী কটন মিল, হিন্দুস্তান বেল্টিং ওয়ার্কস, বেঙ্গল বেল্টিং ওয়ার্কস এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। হুগলি জেলার আন্দোলন সংগঠনে কংগ্রেসের পাশাপাশি ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতা ও কর্মীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন জ্যোতিষ ঘোষ, অশোক ঘোষ, জয়পাল দাস, সমর সোম, শচীন সোম, রমেশ পাল, হরিনারায়ণ চন্দ প্রমুখ। এই জেলায় সোশ্যালিস্ট পার্টির কর্মীরাও বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন। রেললাইন ধ্বংস, ইউনিয়ন বোর্ডের নথিপত্র পোড়ানো, ডাকঘরের কাগজপত্রতে আগুন দেওয়া, টেলিফোন লাইন কাটার মতো নানা নাশকতামূলক পদ্ধতিতে তাঁরা এখানে আন্দোলন জারি রাখেন। সামরিক বাহিনীর জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে পুলিশকে বিশেষ বাধার সম্মুখীন হতে হয়, পুলিশি দমনপীড়নও প্রবল হয়ে ওঠে। পুলিশ নানা জায়গাতেই মিছিলের ওপর গুলি চালায়।
নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরই ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। এছাড়া রানাঘাট, শান্তিপুর ও নবদ্বীপেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। নদীয়া জেলার বিভিন্ন গ্রামীণ অঞ্চলে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মাঝদিয়া, টুঙ্গি, মুড়াগাছা, করিমপুর ইত্যাদি।
বর্ধমান জেলায় অন্যান্য অনেক জেলার মতোই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দিনে ধর্মঘট পালিত হয়। ১৩, ১৬, ১৭ ও ১৮ আগস্ট বর্ধমান শহরে ধর্মঘট হয়েছিল। ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর ধর্মঘট হয় কালনাতে। ১২ অগস্ট থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর – একমাস কাটোয়াতে একটানা ছাত্র ধর্মঘট হয়েছিল। জেলার নানা জায়গায় ডাকঘর পুড়িয়ে, পিকেটিং করে জনগণ বিক্ষোভ দেখায়। কালনা, জামালপুর, ভান্ডারহাটি, পালাসান, কাশীয়ারা, উচালন, মণ্ডলগ্রাম, কুসুমগ্রাম, বেরুগ্রাম, রায়না প্রভৃতি জায়গায় ডাকঘর ধ্বংস করা হয়েছিল।
বাঁকুড়ায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সাঁওতালরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। বাঁকুড়া শহর ও পাত্রশায়রে অনেকগুলি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তালডেংরা, সিমলাপাল, রায়পুর, সোনামুখী, জয়পুর, কোটালপুর, ইন্দাস, সারেঙ্গার ডাকঘরে আগুন দেওয়া হয়। ৪২ এর ৮ অক্টোবর বিষ্ণুপুর বিমান অবতরণ কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ ছিল অত্যন্ত সাহসী ও ব্যতিক্রমী এক ঘটনা।
বীরভূমের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। মায়া ঘোষ, ঊষা হাজরা, সবিতা হাজরা, অপরাজিতা চট্টোপাধ্যায়, মণিপ্রভা মুখোপাধ্যায় প্রমুখরা এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এখানেও আদিবাসী সাঁওতালরা আন্দোলনে বিশেষ সক্রিয় ছিল। ২৯ আগস্ট তারা বোলপুর রেলস্টেশনের ওপর আক্রমণ শানিয়েছিল। এই জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন আরসিপিআই দলের নেতা পান্নালাল দাশগুপ্ত। বোলপুর, দুবরাজপুর, হেতমপুর, রামপুরহাট, মল্লারপুর প্রভৃতি জায়গায় আন্দোলন ছিল জোরদার।
পুরুলিয়া জেলার আন্দোলন সংগঠনের কাজে ছিলেন চুনারাম মাহাতো, গোবিন্দ মাহাতো, গিরিশ মাহাতো, হেম মাহাতো, মগন মাহাতো, মণ্ডল মাহাতো, ভীম মাহাতো, মথন মাহাতো, ধনু মাহাতো, জনার্দন মাহাতো, প্রাণকৃষ্ণ মাহাতো, রামু শবর, লক্ষণ শবর, ছামু শবর প্রমুখ জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরা। বান্দোয়ানে ভজহরি মাহাতো এবং কুশধ্বজ মাহাতোর নেতৃত্ব কয়েক হাজার ভূমিজ, খেড়িয়া, মাহাতো, শবর, সাঁওতাল প্রমুখ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সাহসের সঙ্গে সামরিক ট্রাক ঘিরে ফেলে তার ওপরেও হামলা চালায়। আদ্রা, বলরামপুর, বেড়ো, ঝালদা, রঘুনাথপুর, হুড়া, পুঞ্চা প্রভৃতি পুরুলিয়ার উত্তরাংশে ও জেলার দক্ষিণাংশ জুড়ে এই আন্দোলন চলেছিল। সরকারী রিপোর্ট জানাচ্ছে পুরুলিয়া থেকে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের জন্য পুলিশ ৪৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল।
মুর্শিদাবাদ জেলায় ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন জাতীয় কংগ্রেস, আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতৃবৃন্দ। এই জেলাতেও বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন দিনে আলাদা আলাদাভাবে ধর্মঘট পালিত হয়েছিল। ৪২ সালের ১১, ১৫, ১৬ আগস্ট ও ৬ সেপ্টেম্বর বহরমপুরে ছাত্রদের উদ্যোগে ধর্মঘট হয়। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ মহাবিদ্যালয়ের ছাত্ররা এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জিয়াগঞ্জে মিছিল ও কান্দীতে পিকেটিং সংগঠিত হয়েছিল। খাগড়াতেও প্রতিবাদ হয়। রেল ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করার বিভিন্ন উদ্যোগ বিভিন্ন সময়ে নেওয়া হয়েছিল। জিয়াগঞ্জে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের কর্মকাণ্ড ছিল বেশ সক্রিয়। এটি এই অঞ্চলে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিকাশে বিশেষ সহায়তা করেছিল। এই দুই বিপ্লবী গোষ্ঠীর যে সমস্ত নেতারা এই আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কমল পাণ্ডে, মনোরঞ্জন ভাস্কর, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, দুর্গাপদ সিংহ, জগদানন্দ বাজপেয়ী, অভিরঞ্জন সাহা, কালীনারায়ণ সিংহ প্রমুখ। এখানকার আন্দোলনে তিন মহিলার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁরা হলেন মৃণাল দেবী, মণিমালা দেবী ও চুন্নু কুমারী পাণ্ডে। বেলডাঙাতেও আন্দোলন ছড়িয়েছিল। এখানকার আন্দোলন সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃসিংহ সাহা, বিমলপদ হালদার, কালীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অতুল হাজরা প্রমুখ।
মেদিনীপুর জেলা ও তমলুক জাতীয় সরকার
ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল মেদিনীপুর জেলা। তমলুক মহকুমা ও কাঁথি মহকুমাতে আন্দোলন সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছিল। ঝাড়গ্রাম মহকুমার আন্দোলনে আদিবাসী সমাজের বিশেষ ভূমিকা ছিল। কাঁথি মহকুমার খেজুরি, পটাশপুর, ভগবানপুর, কাঁথি, এগরা, রামনগর থানা এলাকাগুলিতে আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর কাঁথি শহরে দশ হাজার লোকের বিশাল মিছিল হয়েছিল। কাঁথি শহরের বাজার একটানা তিন সপ্তাহ বন্ধ ছিল। ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জনগণ খেজুরি থানায় আক্রমণ চালিয়ে থানাটিকে ভস্মীভূত ও ধ্বংস করে। এই অভিযানে প্রাত সাত হাজার মানুষ সামিল হয়েছিলেন। থানা ধ্বংসের পর আক্রমণ শানানো হয় রেজিস্ট্রি অফিস, সাব রেজিস্ট্রি অফিস, বিভিন্ন পোস্ট অফিসে। রাস্তা কাটা, টেলিগ্রাফ পোস্ট উপড়ে ফেলা, টেলিগ্রাফের তার কাটা, পুল ও কালভার্ট ধ্বংস ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনকে বিচ্ছিন্ন করার একাধিক সচেতন প্রয়াস নেওয়া হয়। ১ সেপ্টেম্বর থেকে কাঁথি মহকুমার বিভিন্ন অঞ্চলে ৫০০ সেনা মোতায়েন করে ব্রিটিশ সরকার।
তমলুকে আন্দোলন সংগঠনে সতীশ সামন্ত ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই তমলুকের বিশিষ্ট নেতা সুশীলকুমার ধাড়ার পরিকল্পনা অনুসারে বিদ্যুৎবাহিনী ও ভগিনী সেনা গঠিত হয়েছিল। বিদ্যুৎ বাহিনীতে প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য ছিলেন। সোভিয়েত রেড আর্মির প্রভাব এর মধ্যে ছিল।
'৪২-র ১৪ সেপ্টেম্বরের এক সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৯ সেপ্টেম্বর তমলুকে গণ প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করার কথা হয়েছিল। তার আগেই তমলুককে আশপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজ শুরু হয়ে যায় রাস্তা কাটা, টেলিফোন টেলিগ্রাফ লাইন বিচ্ছিন্ন করা, টেলিগ্রাফের পোস্ট ভাঙা, কালভার্ট, পুল ধ্বংস করা, কোশি ও হুগলি নদীর খেয়া ধ্বংস করা ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে।
২৯ সেপ্টেম্বর তমলুক থানা ধ্বংস করার জন্য বিকেলের দিকে রওনা দেয় ৫ টি আলাদা রাস্তা দিয়ে পঞ্চাশ হাজার জনতার বিশাল উদ্দীপ্ত মিছিল। পুলিশ মিছিলের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। মোট দশজন শহীদ হন। এনাদের একজন ছিলেন ৭৩ বছরের মাতঙ্গিনী হাজরা। অভিযান চলে মহিষাদল থানা দখলের উদ্দেশ্যেও। এখানেও অন্তত দশহাজার মানুষ মিছিলে সামিল ছিলেন। এই মিছিলের ওপরেও পুলিশ গুলি চালায়। অনেকে হতাহত হন। এঁদের মধ্যে ছিলেন শেখ সুরা ও শেখ আলির মতো মুসলিম যুবকেরাও। মুসলিম লীগের নির্দেশ অমান্য করেই এখানে মুসলিমরা আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। সুতাহাটা থানাতেও অভিযান হয়েছিল এবং সেটি দখল করে নেওয়া সম্ভব হয়।
তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, যা ১৯৪২ এর ১৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় ও দীর্ঘদিন স্বাধীনভাবে টিঁকে থাকে, তা স্বতন্ত্র এক নিবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনাযোগ্য। এই সরকারের মুখপত্র বিপ্লবীর প্রতিটি সংখ্যাই আন্দোলন সংক্রান্ত ইতিহাস রচনার মূল্যবান দলিল। রাধাকৃষ্ণ বাড়ি তাঁর লেখা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার বইতে এই আন্দোলনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। আমরা সে সংক্রান্ত আলোচনা এখানে করলাম না। বাদ রইলো উত্তরবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের জেলাগুলিতে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয়তা নিয়ে আলোচনা, করা হবে সেইসব ফিরে দেখা আলোচনাও।
– সৌভিক ঘোষাল