প্রশ্নটা হল, কে কাকে ভয় পাচ্ছে?
ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতি এক যুগ সন্ধিক্ষণের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আগামীদিনে কী আমরা এক ধর্মবেষ্টিত, মৌলবাদী, স্বৈরাচারী ও অতি-গরিব রাষ্ট্রের আঙিনায় প্রবেশ করব, নাকি আমাদের সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলিতে বলীয়ান হয়ে এক সুখী-সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ গড়ার লড়াইতে এগিয়ে যেতে পারব? আজ এই মুহূর্তে এই মৌলিক প্রশ্নটির দোরগোড়ায় এসে আমরা হাজির হয়েছি। আগামী দেড়-দু’বছর এক ভয়ঙ্কর আবহের মধ্য দিয়ে আমাদের হয়তো পার হতে হবে। অন্তত ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন অবধি এক আশঙ্কার মেঘ আমাদের তাড়া করে বেড়াবে। কারণ, নির্বাচনী যুদ্ধে আপাত সুবিধাজনক জায়গায় থাকা দিল্লীর কেন্দ্রীয় শাসক এখন আস্তিন গুটোচ্ছে মরণকামড় দেওয়ার জন্য। প্রশ্নটা তাই, ওরা কি ভয় পেয়েছে? ওদের মনেও কি সমান আশঙ্কা?
আমরা জানি, আতঙ্কিত শাসক নিজের ছায়াকেও ভয় পায়। তাই রাতারাতি শাসকের ভোলবদল। কেউ কিছু বোঝার আগেই সিংহকে হিংস্র দাঁত বের করিয়ে সাজিয়ে আনা হল নতুন সংসদ ভবনের টঙে বসানোর জন্য। বলা হল, এইই নাকি নতুন ‘অশোকস্তম্ভ’। পুরনো অশোকস্তম্ভের গরিমা ও তাৎপর্য অবলীলায় ফেলে দেওয়া হল ধুলোর স্তূপে। প্রধানমন্ত্রী আর পুরুতমশাই ছাড়া (ফটোগ্রাফার তো থাকবেই!) কেউই সেই নতুন সিংহের ধারেকাছে ভিড়তে পারলেন না; এমনকি রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত নয়। হয়তো বা, গণৎকারের গণনা-নির্ভর ছিল সমস্ত প্রক্রিয়াটা; যেভাবে আমরা হীরক রাজাকে দেখেছি রাজজ্যোতিষীর পরামর্শে মূর্তি উন্মোচনের দিনক্ষণ ঠিক করতে। সেই রাজজ্যোতিষীই আবার, রাজ্যে গ্রহ-নক্ষত্রের সুঅবস্থান কতদিন থাকবে হীরক রাজার যে প্রশ্নে চটজলদি উত্তর দেন, ‘যতদিন ততদিন’। এই ভেল্কি-উত্তরে হীরক রাজা খুশি হয়েছিলেন, কিন্তু দিল্লীর রাজজ্যোতিষী দিল্লীশ্বরকে কী বলেছেন তা কেউ জানি না। তবে, সামান্য কিছুটা অনুমান করতে পারি যে রাজা ভয় পেয়েছেন। কারণ, তিনি কিছুটা অসংলগ্ন হয়ে পড়েছেন।
সম্রাট অশোক বা সম্রাট সাজাহানের মতো তিনিও চান এক অমূল্য কীর্তি রেখে যেতে। তাই, সেন্ট্রাল ভিস্তা। কিন্তু, অশোকস্তম্ভের ভোল বদলে তাকে নতুন সংসদ ভবনের মাথায় স্থাপিত করে যে শৌর্যের বার্তা তিনি দিতে চাইছেন, তা হিংস্র। আর এরই পাশাপাশি এমন সব পদক্ষেপ তিনি নিচ্ছেন যা তাঁর আতঙ্ককে আরও প্রকট করছে।
প্রথমত, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজেদের পদপ্রার্থীর বিজয়কে সুনিশ্চিত করতে তিনি ও তাঁর দল রকেট লঞ্চারটি ছুঁড়লেন মহারাষ্ট্রে এমন একটি লক্ষ্যে যা ছিল একপ্রকার অব্যর্থ। কারণ, ১৯৮৯ সাল থেকে হিন্দুবাদী দোসর শিবসেনা যে আদতে বিজেপি’র ঘরানারই একটি দল তা উপযুক্ত সময়ে আবারও উন্মোচিত করাটা ছিল উভয় দলের কাছেই একটি ছোটখাটো চ্যালেঞ্জ। সে সমস্যা তারা উভয়েই অতিক্রম করেছে। শিবসেনা ফিরে গেছে বিজেপির বাহুডোরে, উদ্ধব ঠাকরে অথবা সঞ্জয় রাউতের ফিরে আসাটা এখন সময়ের খানিক অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু এই খেলাতেও অর্থ উচ্চৈস্বরে কথা বলেছে। এমন নয় যে, বিনা অর্থ ও ক্ষমতার জোরে সুরাত থেকে গুয়াহাটি হয়ে গোয়া থেকে মুম্বাইয়ে শিন্ডে বাহিনীর প্রত্যাবর্তন। ইলেক্টোরাল বন্ডের রহস্য ও পিএম কেয়ার্সফান্ডের বিনা-অডিটের বেহিসেব যে ভারতীয় রাজনীতির গতিপথকে আরও কলুষিত ও নির্মম করে চলেছে ও করবে, তা বলাই বাহুল্য। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপির পদপ্রার্থীকে জিতিয়ে আনাটাকে ষোলআনা সুনিশ্চিত করতেই যে এই পদক্ষেপ, তা নিয়ে আর কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। কারণ, শিবসেনাকে পাশে না পেলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এনডিএ জোটের মোট ভোট ছিল ৪৮ শতাংশের আশেপাশে। আর এই সন্দেহও অমূলক নয় যে যশবন্ত সিনহা অতীতে বিজেপির একজন প্রভাবশালী নেতা থাকার কারণে, হতে পারে, বাজপেয়ীপন্থী অথবা মোদী বিরোধী কিছু বিজেপি ভোট সন্তর্পণে যশবন্তের পক্ষে পড়ে গেল।
দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম, গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে মামলা করার ‘অপরাধে’ তিস্তা শীতলবাদ সহ আরও কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করল। পাশাপাশি, ‘অল্ট নিউজ’এর কর্ণধার মহম্মদ জুবেইরকে পুলিশ বিনা দোষে আটক করল। বলা হল, জুবেইর’এর করা ট্যুইটে কোনও এক ব্যক্তি নাকি আহত হয়েছেন। অথচ সেই ব্যক্তির আসল পরিচয় এখনও জানা যায়নি। কারণ, ‘তিনি’ একটি ট্যুইট করে বিষয়টি জানিয়েছিলেন বটে কিন্তু জুবেইর গ্রেফতার হতেই সেই ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট’টিও উধাও। অর্থাৎ, সম্পূর্ণ একটি ভুয়ো (উদ্দেশ্যপ্রণোদিত) ট্যুইটের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ জুবেইরকে গ্রেফতার করল। তার ওপর জুবেইর যে ফিল্ম ক্লিপটি তাঁর ২০১৮ সালের ‘বিতর্কিত’ ট্যুইটে জুড়েছিলেন সেটি হৃষিকেশ মুখার্জির একটি জনপ্রিয় ফিল্ম থেকে নেওয়া।
এইসব হাস্যকর অথচ নৃশংস স্বৈরাচারী পদক্ষেপ শুধু এখানেই থেমে থাকল না, হিমাংশু কুমার, মেধা পাটেকরের মতো গান্ধীবাদী নেতাদের ওপরেও নেমে এল। হিমাংশু কুমারকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হল এবং মেধাজীর বিরুদ্ধে হল এফআইআর। আর এই সামগ্রিক রাজনৈতিক উদ্যোগে বিচারব্যবস্থার একাংশ শাসকের সঙ্গে জুড়ে গিয়ে দেশে তৈরি করল এক ভয়ঙ্কর দুরবস্থা। কোনও কথা বলা, লেখা এমনকি শোনা হয়ে দাঁড়াল গর্হিত অপরাধ।
আর সেই সূত্র ধরেই, তৃতীয়ত, আমরা পেলাম এক গুচ্ছ শব্দমালা যা নাকি অসংসদীয়, অব্যবহারযোগ্য। সেগুলিকে সংসদের আলোচনায় ব্যবহার করা যাবেনা; যদি কেউ করেন তাহলে একমাত্র স্পিকারের আদেশেই তা গৃহীত হবে বা হবেনা। ব্যাপারটা কেমন? কারও কোনও কার্যকলাপে কেউ যদি লজ্জিত বোধ করেন, তাহলে তা বলা যাবেনা, কারণ, ‘লজ্জিত’ শব্দটি সংসদের স্পিকার অথবা সেক্রেটারিয়েটের মতে ‘অসংসদীয়’। এমনকি কেউ যদি মনে করেন কোনও তথ্য বা ঘটনা যা পেশ করা হচ্ছে তা অসত্য, তাহলে সে কথাটিও বলা যাবেনা কারণ ‘অসত্য’ শব্দটিও ‘অসংসদীয়’। এই নিদানকে পাগলের প্রলাপ নাকি শব্দসন্ত্রাস — কী বললে যথাযথ হবে তা নিয়ে সম্ভবত মনোবিদরাও হিমশিম খাচ্ছেন।
চতুর্থত, শুধু এটুকুতেও নয়। জোর গলায় তিনি জনসভায় বলছেন, জনতাকে ‘রেউড়ি’ খাইয়ে ভোট আদায়ের চেষ্টার বিরুদ্ধে সকলকে সজাগ হতে। অর্থাৎ, যারা জনকল্যাণের রাজনীতি করছেন, তাঁদের কার্যকলাপকেও তিনি দেগে দিচ্ছেন। একের পর এক সরকারি সংস্থার বেসরকারিকরণ, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে গুটি কয়েক শিল্পপতিদের হাতের তালুতে বন্দী করে আনা, টাকার মূল্যের রেকর্ড পতন, এলপিজি, পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিনের মূল্যকে আকাশছোঁয়া করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামকে সাধারণের নাগালের বাইরে নিয়ে যাওয়া — এই যখন একটি সরকারের মূল নীতি, তখন স্বভাবতই জনকল্যাণের রাজনীতি তাঁদের কাছে ‘রেউড়ি’ বিলির মতো লাগবে। কিন্তু সমস্যা হল, জনকল্যাণের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভয়ের পরিবেশ কিন্তু মাঠ ছাড়া যাবে না তিনি যে জনমত গড়ে তুলতে চাইছেন তা সফল হলে দেশে নেমে আসবে এক ভয়ঙ্কর অরাজকতা ও দারিদ্র্য। তাই পথ একটাই — পেশির জোর ও হিন্দুত্বের মিথ্যাচার। তা দিয়ে যদি তাঁরা দেশ পরিচালনার রাশ নিজেদের হাতে রাখতে পারে, তাহলে আগামী দিন যে কী ভয়াবহ, আশাকরি আন্দাজ করা যাচ্ছে।
পঞ্চমত, সংসদে এবারের বাদল অধিবেশনে পেশ হতে চলেছে প্রেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অফ পিরিওডিকালস বিল, ২০২২ যা মুদ্রণ ও ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নতুন করে একপ্রস্থ বিধিনিষেধ আরোপ করে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আরও এক কোপ মারতে চলেছে। সেই ২০১২ সাল থেকে, আগে মাঠে নেমে, বিজেপি’র আইটি সেল এতদিন সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল ভুবনের চত্বরে একচেটিয়া আধিপত্য করে এসেছে। এখন সে দিন গিয়েছে। বহু মানুষ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে এক বিরুদ্ধ স্রোত গড়ে তুলেছেন। কেন্দ্রীয় শাসক এই স্রোতকে ভয় পাচ্ছে। তাই তার কন্ঠরোধ করার চেষ্টা। ‘অল্ট নিউজ’এর মতো আরও বহু স্বাধীন পোর্টালের মাজা ভেঙে দিতে তারা এখন আসরে।
ষষ্ঠত, এই বাদল অধিবেশনেই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের বিল আনতেও মোদী বেপরোয়া। এইভাবে প্রায় সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে বেচে দিয়ে ভারতীয় জনতার যে অর্থনৈতিক রক্ষাকবচ (যা ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দা থেকে আমাদের দেশের সাধারণজনকে অনেকটা রক্ষা করেছিল) এতদিন আমাদের মাথার ওপর ছিল, তার সলিল সমাধি হতে চলেছে। মানুষ এবার যাবে কোথায়?
এই শঙ্কা যে শুধু আম-আদমির, তাই নয়। এ শঙ্কা কেন্দ্রীয় শাসকেরও। কারণ, তারা জানে, এমনতর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে দেশ কেমন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে। আর সেই জন্যই তারা হাতিয়ার করেছে ধর্মের রাজনীতিকে। একদিকে পেশিশক্তির জোর, অন্যদিকে ধর্মের আফিম — এই দুইয়ের যোগে কেন্দ্রীয় শাসক নেমেছে এক মারণঘাতী খেলায়। কিন্তু সে খেলায় অনেক ঝুঁকি আছে। দু’তরফেই (শাসক-বিরোধী)। তবে ধর্মের রাজনীতি দিয়ে যেহেতু অনেক সহজে কাজ হাসিল করা যায়, তাই বিজেপি রয়েছে এক সুবিধাজনক অবস্থায়। আমাদের দেশের মানুষ অতীতে নানাবিধ সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি দেখেছেন, তার মোকাবিলা করেছেন। নানা কারণে কিছু সময়ের জন্য মানুষ হয়তো টাল খেয়ে যান (মূল ধারার বিরোধীরাও কম দায়ী নয়), কিন্তু শেষ বিচারে, ২০২৪’র আগে যে বিপর্যয়কর রাজনীতির আগুন আরও লেলিহান করে তুলতে বিজেপি মরীয়া, তা নিশ্চিত ব্যর্থ হবে বলেই আমার ধারণা।
- অনিন্দ্য ভট্টাচার্য