ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিছু ধান তারা কেনে। আর বেশিটাই কেনে রাজ্য সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার বলতে চায় তারা বছর বছর ধানের সহায়ক মূল্য বাড়াচ্ছেন। গত দশ বছরে কুইন্টাল পিছু তা প্রায় ৭০০ টাকা বেড়েছে। রাজ্য সরকার প্রচার করে ২০১১ সালে সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০ লক্ষ টন ধান কেনার, সেটা বেড়ে ২০২১ সালে হয়েছে ৫২ লক্ষ টন।
কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের এত ‘কৃষকবন্ধু’ অবস্থানের প্রচারের পরেও বাংলার লক্ষ লক্ষ ধানচাষির অভাব অভিযোগ এত তীব্র কেন? কেন তারা বলছেন বিক্রির সময় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য তারা পাচ্ছেন না?
চাষিদের বক্তব্য সরকার যত বেশি ধান কেনে, তত বেশি পকেট আসলে ভরে ফড়েদের। সাধারণ গরীব প্রান্তিক বা ছোট চাষির লাভ হয় না। সরকারি কড়াকড়ি যে লোক দেখানো, ৭০ শতাংশ বা অনেক জায়গায় তার চেয়েও বেশি পরিমাণ ধান ফড়েরাই যে সরকারকে সরবরাহ করে — তা গ্রামের মাটিতে এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তব। সরকারি ঘোষণা ও প্রচারের আড়ালে এই ছবি কেন(?) তার উত্তরে চাষিরা বলেন যে কবে ধান কেনা হবে সেই খবর চাষিরা পান না। আগাম খবর যায় পঞ্চায়েত ও শাসক দলের মাথাদের কাছে। ধর্ণা দিয়ে চাষি মান্ডি বা চালকল থেকে ধান বিক্রির টোকেন পেলেও তার দিন পায় অনেক পরে। শিবিরে ধান বিক্রি করতে নিয়ে গিয়েও অনেক সময় গাড়িভাড়া গচ্চা দিয়ে ধান নিয়ে ফিরে আসতে হয়। চালকল ধান কিনলেও কুইন্টাল পিছু ছয়-সাত কিলো প্রায়ই বাদ দিয়ে দেয়। প্রায় ষাট-সত্তর কিলো ধানের দাম হারাতে হয় ছোটো চাষিকে।
ছোটো চাষির মূল সমস্যা ধান বিক্রি করার জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ তার নেই। ঘরে ধান কিছুদিন রেখে দেওয়া, তারপর আরো অনেকদিন অ্যাকাউন্টে সরকারি টাকা ঢোকার অপেক্ষায় বসে থাকার সুযোগ তাদের নেই। অন্তত দশ বারো বিঘের মালিক যারা, একেবারে তিরিশপঁয়ত্রিশ কুইন্টাল ধান বিক্রি করতে পারেন — তারাই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধেটা নিতে পারেন। দুই আড়াই বিঘের চাষিরা ধান দ্রুত বিক্রি করে আলু চাষে নেমে পড়েন, আলু বিক্রি করেই আবার নামেন ধান চাষে। এই চক্রের বাইরে তাঁরা বেরোতে পারেন না।
যে ফড়েরা লাভের গুড় খেয়ে যান, কম দামে চাষির থেকে অভাবী ফসল কিনে পরে বেশি দামে সরকার বা চালকল মালিককে বেচে দেন, তারা গ্রামের রাজনীতি অর্থনীতির বাইরের কেউ নন। এরা মূলত বড় চাষি, চালকল মালিকের এজেন্ট, সার বীজের ডিলার, কোল্ড স্টোরেজের মালিক বা বড় ব্যবসায়ী। চাষির ধান এইসব ফড়ে ব্যবসায়ীরা আগেই কম দামে কিনে রাখে, পরে বেশি দামে বেচে দেয়। কিছুটা পুঁজি বা জমানো টাকা আছে বলে তারা এইভাবে চাষির পরিশ্রমের ফসল থেকে লাভের গুড়টা খেয়ে যেতে পারে।
চালকল মালিক আর খাদ্য দফতরের কর্মীদের মিলিত দুর্নীতির জন্য বহু ধান কেনা হয় কেবল খাতায় কলমে। ধান অডিট করার কোনও ব্যবস্থা আজও বাংলায় চালু হয়নি। প্রতিটা ব্লকে কৃষক মান্ডি করে আদতে চাষির কোনও লাভ হয়নি। গ্রামে গিয়ে চাষির ঘর থেকে ধান কেনার ব্যবস্থা হলে চাষি প্রকৃতপক্ষে লাভবান হতে পারেন। এইগুলো হয় না, কারণ গ্রামীণ রাজনীতির ক্ষমতাবান অংশটিকে খুশি রেখেই শাসক দলের রাজনীতি চলে। ফড়ে রাজ নির্মূলের লড়াইটা বামপন্থীরা যদি সাহসের সঙ্গে লড়তে পারেন, তাহলে তাদের সংগঠন ও জনসমর্থনে আবার জোয়ার আসতে পারে।
- সৌভিক ঘোষাল