এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
আকাশচুম্বী বেকারি, যে কাজগুলো ছিল তা ক্রমে ক্রমে লুপ্ত হয়ে যাওয়া, নতুন কাজ সৃষ্টি না হওয়া – এমনই এক বিবর্ণ, আতঙ্কজনক কাজের বাজার এবার বয়ে নিয়ে এলো ব্যাপক কর্মী ছাঁটাইয়ের বার্তা।
দেশের ইউনিকর্ণস্টার্টআপগুলো গত ছ’মাসে ১১ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। এবছরের মধ্যে আরও ৬০ হাজার কর্মী কাজ হারাতে চলেছেন। দেশের ২৫টি স্টার্ট আপ এবছর জানুয়ারি মাস থেকে ১১,৭১৫ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে। ওলা- ব্লিনকিট-উনাকাডেমি-ভেডান্টু-কারস্২৪- মোবাইল প্রিমিয়ারলিগ’এর মতো ইউনিকর্ণ স্টার্টআপগুলো এই কর্মীমেধ যজ্ঞে সামিল। ব্লিনকিটকে অধিগ্রহণ করার পরই এই মার্চমাসে জোমাটো কোপ বসাল ১,৬০০ কর্মীর উপর। বাইজুস্ও ইতিমধ্যে বহু কর্মীর কাজ কেড়েছে।
কী এই স্টার্ট আপ? কোন লক্ষ্যেই বা সরকার এইগুলো তৈরি করে?
এই ইউনিকর্ণস্টার্ট আপ হল ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ভ্যালুয়েশনের, কিন্তু স্টক মার্কেটে যা নথিভুক্ত হয় না। আর স্টার্টআপ ইন্ডিয়া হল ভারত সরকারের প্রকল্প, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও সম্পদ সৃষ্টির গালভরা উদ্দেশ্যেই যা নাকি তৈরি হয়। গবেষণার মাধ্যমে নানা প্রকল্পের উদ্ভাবন বৃদ্ধি ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যেই প্রকল্পটি চালু হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এই স্টার্টআপগুলোকে অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে। খুব সহজে রেজিষ্ট্রেশন, সুলভে ব্যাঙ্ক ঋণ, তিন বছরের জন্য কর ছাড়, শ্রম কানুন মুক্ত – এরকম অগাধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে এই স্টার্ট আপগুলোকে।
এই প্রসঙ্গেই মনে পড়ে মোদীর ২৯ মে’র ‘মন কি বাত’এর বক্তৃতার কথা। ওইদিন তিনি এই সমস্ত স্টার্ট আপ’এর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, “এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, প্রতিটা ভারতবাসীর কাছে এই স্টার্ট আপগুলো বিরাট গর্বের বিষয়”। এমন সময় তিনি এই কথাগুলো বলছেন যখন এই সংস্থাগুলোতে ব্যাপক ছাঁটাইয়ের ঢল নেমেছে। মোদী উক্ত ভাষণে বলেন, “কয়েকদিন আগে আমাদের দেশ একটা মাইলফলক ছুঁয়েছে। এটা আমাদের সকলকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি আমাদের মধ্যে ভারতের সক্ষমতা সম্পর্কেবিরাট এক আত্মবিশ্বাস নতুন করে তৈরি করে দেয়।” তিনি আরও জানান ওই মাসের ৫ তারিখে ভারতে স্টার্ট আপ ইউনিকর্ণের সংখ্যা সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছে।
নির্লজ্জ বেহায়া বললেও কম বলা হয়। এমন সময় তিনি এই কথাগুলো জাতির উদ্দেশ্যে বললেন যখন নানা সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত স্টার্ট আপগুলো ছাঁটাইয়ের খড়্গ নিয়ে নেমে পড়েছে, আর, দেশের প্রধানমন্ত্রী ওই স্টার্ট আপগুলোকেই ‘বিরাট গর্বে’র প্রতীক হিসাবে তুলে ধরেন। কিন্তু কোন আর্থিক অনটনের কারণে নয়, অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যেই শুরু হয়েছে এই ছাঁটাই অভিযান। ‘মন কি বাত’ ভাষণে মোদী নিজেই বলেছেন, “দেশের এই সমস্ত ইউনিকর্ণগুলোর মুল্য ৩৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ২৬ লক্ষ কোটি টাকা। যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য অনেকের তুলনায় এই সংস্থাগুলোর গড় বৃদ্ধি অনেক বেশি। এমনকি ঘোর কোভিডের দুঃসময়েও এগুলো ব্যাপক সম্পদ ও মূল্য সৃষ্টি করেছে।” কর্মসংস্থানের ঘোষিত লক্ষ্যে এই স্টার্ট আপগুলো কতটা পূরণ করতে পারল, সে ব্যাপারে টুঁ শব্দটি তিনি করলেন না।
আমজনতার করের টাকায় সরকারি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার দৌলতে ফুলে ফেঁপে ওঠা এই স্টার্ট আপ ইউনিকর্ণগুলো এবার নিজের আখের বুঝে নিচ্ছে চরম সামাজিক মূল্য দিয়ে। আর সরকার চোখ কান বন্ধ করে রেখেছে। নির্বিচারে এই ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনো ভূমিকাই সরকারের তরফ থেকে নিতে দেখা গেল না।
স্ট্যাগফ্লেশনের মুখে ভারত
প্রখ্যাত অর্থশাস্ত্রী কৌশিক বসুর থেকেই শুরু করা যাক। তিনি একটা টুইটে দেখিয়েছেন যে, পৃথিবীতে বেকারত্বের প্রশ্নে ভারতের স্থান পঞ্চম ধাপে। পাকিস্তান বা বাংলাদেশ এমনকি শ্রীলঙ্কাও ভারতের উপরে রয়েছে। ভারতের উপরে যে চারটি দেশ রয়েছে, সেগুলো হল – আলজেরিয়া, ব্রাজিল, তুরস্ক ও ইয়েমেন। তাঁর মতে, ভারত এখন স্ট্যাগফ্লেশন’এর মুখে দাঁড়িয়ে। এটা এমনই এক অর্থনৈতিক অবস্থা যখন মূল্যবৃদ্ধি এবং বেকারত্ব দুয়েরই হার অস্বাভাবিক উঁচু থাকে এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বা জিডিপি বৃদ্ধির হার ও চাহিদা একটা স্তরে এসে থমকে যায়। অর্থাৎ, ইনফ্লেশন ইন প্রাইসেস এবং স্ট্যাগনেশন ইন ডিমান্ড।
বর্তমান ভারতে বৃহত্তম আর্থিক সমস্যা হল বেকারি ও মূল্যস্ফীতি। সেন্টার ফর মনিটারিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)’র প্রকাশিত জুন মাসের রিপোর্ট বিরাট উদ্বেগ বহন করে নিয়ে এলো। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধুমাত্র জুন মাসে ১.৩০ কোটি কাজ খোয়া গেল! জুন মাসে দেশে বেকারির হার বেড়ে হয়েছে ৭.৮০ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ৭.১২ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বিরাটভাবে বেড়ে যাওয়াই এর মূল কারণ। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুন মাসে বেকার হয়েছেন ৩০ লক্ষ। বিরাট সংখ্যক মানুষ কাজের বাজার ছেড়েই পালিয়েছে। কাজ খুঁজতে মানুষের সংখ্যা বা লেবার ফোর্স এক কোটি কমেছে। জুনে কাজ হারিয়েছেন ২৫ লক্ষ চাকুরিজীবী। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মহীনতা বেশি।
১৮ মাসে ১০ লক্ষ কর্মসংস্থানের মোদীর ঘোষণা – কতটা বাস্তব
প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে ১০ লক্ষ মানুষকে সরকারি দপ্তরে নিয়োগ করবেন। এই লক্ষ্য পূরণে কেন্দ্রীয় কোষাগার থেকে দিতে হবে বছরে ৫৪,০০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে ৯০ শতাংশ বা তার বেশি কাজগুলো যে সমস্ত শূন্যপদ বা নতুন করে নিয়োগ না করায় উদ্ভুত, তা রয়েছে গ্রুপ-সি বর্গে – ক্লার্ক, পিয়ন, অর্ধদক্ষ বর্গগুলোতে। গ্রুপ-সি – এই নতুন পদগুলোতে নিয়োগের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের গ্যাঁটের কড়ি খরচ হবে প্রতি মাসে ৪০,০০০ কোটি টাকা। সরকারের পক্ষে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে এই পরিমাণ নিয়োগ সম্ভবপর কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সরকারি তথ্য বলছে, ১ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত ৭৭ মন্ত্রকে ৮.৭২ লক্ষ শূন্যপদ রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৫টি মন্ত্রক – প্রতিরক্ষা (অসামরিক), রেল, স্বরাষ্ট্র, ডাক ও রাজস্ব – শূন্যপদের সংখ্যা ৯০ শতাংশ। ৩০ মার্চ ২০২০তে লোকসভায় জিতেন্দ্র সিং, পার্সোনাল, পাবলিক গ্রিভান্স, পেনশন’এর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী লিখিত বক্তব্য পেশ করে জানান, ৭৭টি মন্ত্রকে ১ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত অনুমোদিত কর্মীসংখ্যা ৪০.০৪ লক্ষ থাকলেও বাস্তবে রয়েছে ৩১.৩২ লক্ষ নিয়মিত কর্মী সংখ্যা। উক্ত মন্ত্রকগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ২.৪৭ লক্ষ শূন্যপদ পড়ে রয়েছে প্রতিরক্ষায় (অসামরিক), তারপর রেল (২.৩৭ লক্ষ), স্বরাষ্ট্র (১.২৮ লক্ষ), ডাক (৯০,০৫০) এবং রাজস্ব বিভাগে (৭৬,৩২৭)। মোট ৮.৭২ লক্ষ শূন্যপদের মধ্যে ৭.৫৬ লক্ষ শূন্যপদই গ্রুপ সি’র মধ্যে রয়েছে। ৬ষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশের পর গ্রুপ-ডি পদগুলো গ্রুপ-সি’র সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
মোদীর উক্ত ঘোষণা এমন সময় করা হল, যখন শহুরে যুবকদের বেকারির হার ২০ শতাংশের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল, কোভিড লাখে লাখে মানুষকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে শূন্য পদের সংখ্যা হুহু করে বাড়লেও নতুন নিয়োগ হয়নি। কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং, স্টাফ সিলেকশন কমিশন ও ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন যে সমস্ত তথ্য দেন তাতে দেখা যাচ্ছে যথাক্রমে ১,৮৫,৭৩৪ ও ২৭,৭৬৪ পদে নতুন নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দিলেও ২০১৭-১৮ এবং ২০২১- ২২’র মধ্যে নিয়োগ হয় যথাক্রমে ১,৭৪,৭৪৪ ও ২৪, ৮৩৬ জন। অর্থাৎ, যত পদের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তত সংখ্যক পদে শেষ পর্যন্ত নিয়োগ হচ্ছে না। এ বড় বিচিত্র খেলা!
সপ্তম বেতন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা যায়, কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরগুলোতে ১৯৯৪ সালে মোট অনুমোদিত ৪১.৭৬ লক্ষ পদ সংকুচিত হয়ে নেমে আসে ৩৮.৫ লক্ষে। আর, ২০২১’র বাজেট রিপোর্টথেকে জানা যায়, কেন্দ্রীয় দপ্তরে মোট পদের সংখ্যা ৩৪.৫ লক্ষ। ২০০৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে প্রতি বছরে এক লাখের সামান্য বেশি নিয়োগ করে। এই সমস্ত তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে সরকারি দপ্তরগুলোর নতুন নিয়োগের ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে, সমগ্র শ্রমশক্তির একটা ছোট্ট অংশই কোনক্রমে ঠাঁই পাচ্ছে সরকারি দপ্তরে। একথা বেতন কমিশনও স্বীকার করে বলেছে, “কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার এখন বড়জোর নিজের অবস্থানকে এক প্রান্তিক জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে”।
ক্রম প্রসারমান পরিষেবামূলক ক্ষেত্র বা সার্ভিস সেক্টর অত্যন্ত স্বল্প পরিমানে কর্মী নিয়োগ করে থাকে। তাও আবার সেই কর্মীর চরিত্র হচ্ছে দক্ষ। এদিকে, পড়ে থাকলো গিগ অর্থনীতি, যেখানে অদক্ষ শ্রমশক্তি কাজ খুঁজে পাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবছর কাজের বাজারে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রবেশ করছে, তাদের স্থান দিতে পারবেনা এই গিগ প্ল্যাটফর্ম। গ্রামাঞ্চলের উদ্বৃত্ত শ্রমশক্তিকে জায়গা করে দিতে এমন কোনো উৎপাদন শিল্প এখন আর সেইভাবে দেখা যাচ্ছে না। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে যে ডিজিটাল প্রযুক্তি আজ উৎপাদন শিল্পে ক্রমেই আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছে, তা ব্যাপক ভাবে কর্মী সংকোচন করছে, এই প্রতিবেদনের শুরুতেই আমরা দেখিয়েছি, স্টার্ট আপ শিল্পগুলো কী বিরাট বহরের ছাঁটাই শুরু করেছে।
ভারতে বেকারত্বের ছবি দিনের পর দিন ভয়ংকর হয়ে উঠছে। মাত্র ২০ শতাংশ মানুষ বেতনভুক, ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ স্বনিযুক্ত, আর বাকি অংশটি দৈনিক মজুরের কাজ করেন। সিএমআইই’এর তথ্য থেকে আরও উঠে আসছে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর মাসিক আয় ১৫,০০০ টাকা। এরকম এক গভীর সংকটময় কাজের বাজারে যে পরিবার একজন রোজগেরের উপর নির্ভরশীল (যে সংখ্যাটা ৬৮ শতাংশ), অতিমারীর সময়ে সেই কাজটাও চলে গেলে কী নিদারুণ সংকটে পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। দেশজুড়েই এখন বাড়ছে দারিদ্র, অপুষ্টি ও অনাহার।
ভারতের সামনে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হল বেকারি। কিন্তু, এ সম্পর্কে রাষ্ট্রনেতারা বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়। অগ্নিপথ প্রকল্পকে ঘিরে যে নজিরবিহীন যুব উত্থান দেশবাসী প্রত্যক্ষ করলেন তা আদতে কর্মসংস্থানের বিরাট সংকটকেই দেখিয়ে দেয়। আরও সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থগুলোর আরও প্রসার ঘটিয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা, সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে অর্থবহ কর্মসংস্থানে সরকারের প্রধান ভূমিকা নেওয়া – অতিমারির থেকে শিক্ষা নিয়ে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করেতে বরেন্য অর্থনীতিবিদদের এই সমস্ত সুপরামর্শকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে মোদী দেশটাকে জাহান্নমে পাঠানোর সংকল্প নিয়েছে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
- অতনু চক্রবর্তী